• Uncategorized
  • 0

গদ্যানুশীলনে প্রদীপ গুপ্ত

সিঁথি

মৃতদেহ নিয়ে শ্মশানে যাওয়ার মুহূর্ত থেকে শুরু করে বাড়ি ফিরে আসা পর্যন্ত ভীষণ এক মনোকষ্টে কাটিয়েছে অরুণাভ। কিছুতেই বিষয়টিকে মেনে নিতে পারছে না সে। সুনন্দা….. নাহ্, সুনন্দা এটা না করলেও পারতো আজ। অরুণাভ মানছে যে কোনোরকম কুসংস্কারের ধার ধারে না সুনন্দা, কিন্তু তাই বলে —
ভোর প্রায় সাড়ে চারটের সময় মোবাইলটা বেজে উঠেছিলো অরুণাভর। যতোক্ষণে চোখ কচলে ফোনটার দিকে হাত বাড়ালো সে, ততোক্ষণে ফোনটা নীরব হয়ে গেছে। ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলো, তিন তিনটে, মিসড কল হয়ে আছে। চৌধুরীদার কল। একমিনিট চুপ করে ভাবলো অরুণাভ। কী করা উচিত আর কী করা উচিত না। কলব্যাক করবে নাকি?
সুদীপ চৌধুরী আর অরুণাভ একই দিনে গৃহপ্রবেশের পুজো দিয়েছিলো। একই দিনে প্যাকার্স এন্ড মুভার্সের কন্টেনার এসে দুজনের দুটো ফ্ল্যাটে মাল খালি করে আসবাবপত্রে সাজিয়ে দিয়ে গেছিলো দুজনের ফ্ল্যাট। দক্ষিণ শহরতলীর এই ছিমছাম এপার্টমেন্টে অরুণাভ ব্যানার্জি আর সুদীপ চৌধুরীর পরিবার তাদের গৃহপ্রবেশের প্রথম দিন থেকেই তাই একটা পারিবারিক বন্ধুত্বের বাঁধনে বাঁধা পড়েছিলো। শুধু একটাই পার্থক্য, সুদীপবাবু একজন রিটায়ার্ড বিসিএস, আর অরুনাভ ইনকাম ট্যাক্সের একজন বড়ো চাকুরে।
ফোনটা আবার বেজে ওঠে। অরুণাভ ধরে ফোনটাকে। ওপার থেকে সুদীপ চৌধুরীর কাঁপা কাঁপা গলা ভেসে আসে —
–” হ্যালো অরুণাভ, তোমার বৌদি –”
–” কী হয়েছে বৌদির — কখন? কোথায়? ”
একসাথে এতোগুলো প্রশ্ন করেই অরুণাভ হালকা ঠেলা দিলো ঘুমন্ত সুনন্দার শরীরে।
–” এই শুনেছো? একটু ওঠো না গো, প্লিজ। চৌধুরীদা ফোন করছেন। বৌদি নাকি –! কী গো, শুনেছো! ওঠো না, প্লিজ, একটু চা করে দাও না, আমায় এখুনি বেরোতে হবে। ”
চৌধুরীবৌদি দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু সে অসুস্থতা কাটিয়েও উঠেছিলেন। দিব্যি হাসিখুশি, এই তো সেদিনও মাংসের ঘুগনি করে ঘরে ডেকে কতো যত্ন করে খাওয়ালেন। কিন্তু কোনো কথা নেই বার্তা নেই, এরকম দুম করে –।
মারা যাওয়ার পর চার ঘন্টা তখনও হয়নি। নার্সিংহোমের নীচের কফিশপে চৌধুরীদা দাঁড়িয়ে আছেন। প্রায় আশী ছুঁই ছুঁই। কিন্তু, ঋজু ছিপছিপে শরীরে এতোটুকু মেদ জমতে পারে নি। প্রায় বাইশ বছর একই এপার্টমেন্টে কেটে গেলো। অরুণাভরও এখন ষাট পেরিয়ে গেছে। অরুণাভকে হাতের সামনে পেয়েই জড়িয়ে ধরতে গিয়েও সামলে নিলেন সুদীপবাবু। ওর কাঁধে হাত রেখে হাতের আড়ালে একমুহূর্ত মুখ লুকোলেন। ততোক্ষণে অন্যান্য আত্মীয়স্বজনেরাও এসে পৌঁছে গেছেন। একমাত্র মেয়ে নীলা, নীলার হাসব্যান্ডও এসে কফিশপের চেয়ারে বসে আছে।
–” বডি কীভাবে নেবেন, চৌধুরী জ্যেঠু ? ”
ওঁর এক আত্মীয় এসে প্রশ্ন করে সুদীপবাবুকে।
‘ বডি ‘
কথাটা ধ্বক করে এসে কানে বাজে অরুণাভর। কয়েকঘন্টা আগেও তো বৌদি —
আজকাল আর মৃত্যু কাউকে নাড়া দেয় না। কিছুদিন, কয়েকবছর আগেও কেউ একজন মারা গেলে সারা পাড়া এসে ভেঙে পড়তো। আর এখন!
বৌদিকে ঘরে এনে শোয়ানো হয়েছে। মেঝেতে একটা তোষক পাতা, তার ওপরে শুয়ে বৌদি মনে হয় এখনও ওঁর পাতলা ঠোঁট দুটোকে ছড়িয়ে দিয়ে মিটিমিটি হাসছেন। বাড়ির মহিলারা ওঁকে আলতা পরিয়ে, কপালে সিঁদুরের টিপ পরিয়ে সাজাচ্ছেন।
সবাই একে একে এসে বৌদির কপালে সিঁদুরের টিপ পরিয়ে দিচ্ছেন। সুনন্দা ঘরের এককোণে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে। দু’টো চোখে আষাঢ় জমে আছে। যে কোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামতে পারে।
অরুণাভ ইঙ্গিতে সুনন্দাকে সিঁদুর পরাতে বললো। সুনন্দা অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিলো। অরুণাভ একটু সরে এসে সুনন্দার মুখোমুখি দাঁড়ালো। ফের ইঙ্গিত করলো, সিঁদুর পরানোর জন্য। সুনন্দার মুখে যেন একরাশ বিরক্তি ঝরে পড়লো। ও সেই ঘর ছেড়ে ভেতরের ঘরের বিছানায় গিয়ে বসলো।
বৌদিকে স্ট্রেচারে তোলা হচ্ছে। বেলা প্রায় বারোটা বাজতে চলেছে। অরুণাভ সকাল থেকে কিচ্ছুটি খায় নি। শুধু চা বিস্কুটের ওপর দিয়ে কাটিয়েছে। সুনন্দা এগিয়ে এসে ওর হাতের মধ্যে একটা প্যাকেট দিতে গেলো।
— ” দু’টো বিস্কুট আর জল খেয়ে ওষুধগুলো খেয়ে নিও। কিছু খেয়েছো সকাল থেকে? ”
অরুণাভ কোনো উত্তর দিলো না। ওষুধের প্যাকেটটা বুকপকেটে রেখে নীরবে এগিয়ে গেলো।
ছি ছি, সুনন্দা নিজেকে কী ভাবে? খুব আধুনিকমনস্ক একজন মহিলা? সবাই যখন — তখন কি ও পারতো না –?
কালীঘাটের চুল্লিতে তখন বৌদির শরীরটাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে লকলকে আগুন। আর অরুণাভর মনেও যেন — ছিঃ, এতোদিন বৌদির সাথে একসাথে কতোদিনই না হাসিঠাট্টায় কাটিয়েছে সুনন্দা! আর আজ যখন শেষবারের মতো… মনের মধ্যে একটা বীভৎস অনুশোচনার আগুনে যেন জ্বলছে অরুণাভ। বাড়ি ফিরে শাওয়ারের নীচে দীর্ঘক্ষণ ধরে ভিজেও ঠান্ডা হচ্ছে না ওর শরীর।
–” ওষুধগুলো খেয়েছিলে মনে করে? ”
অরুণাভ নিরুত্তর।
–” সকাল থেকে খেয়েছো কিছু? ”
অরুণাভ চুপ।
এবার এগিয়ে এসে ওর দুটো কাঁধকে আঁকড়ে ধরে ঝাঁকুনি দেয় সুনন্দা।
–” কী? কী হয়েছে কী, তোমার? কিছু না বুঝেই কেন এতো রাগ করো? ”
অরুণাভ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে।
–” যারা বৌদিকে সিঁদুর পরালো, তারা বৌদির মতোই সবাইকে ছেড়ে আগেই চলে যাওয়ার মানত করলো। আচ্ছা, আমি তোমাকে একা ফেলে কীভাবে আগে চলে যাই, বলোতো? তুমি যে একগ্লাস জলও ভরে খেতে জানো না, আমি আগে চলে গেলে –। আমি তোমায় একা ফেলে রেখে কিছুতেই আগে চলে যেতে পারবো না গো, কিছুতেই পারবো না। কিছুতেই –”
একটা কেটে ফেলা ধানের চারার মতো অরুণাভর শরীরে লুটিয়ে পড়লো সুনন্দার শরীর। অরুণাভ বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সুনন্দার দিকে। সত্যিই সে কি ভুলই না ভেবেছে, এতোক্ষণ ধরে! সত্যিই সুনন্দা তাকে এতোটা —
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।