সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে প্রদীপ গুপ্ত (পর্ব – ৩১)

পদচিহ্ন
সেইসময় আমাদের গাঁয়ের বাড়ি দক্ষিণ পাথর বেড়িয়ায় নতুন বাড়ি বানানো হচ্ছে। আপনি তো জানেন বাবা শিবপুর বি ই কলেজে চাকরি করতেন, ওখানে ক্যাম্পাসেই থাকতাম আমরা। আমারও যাবতীয় টিউশনও হাওড়া জেলাতেই ছিলো। সেইসব টিউশন ছেড়ে এসে গ্রামের বাড়িতে থাকাটা আমার পক্ষেও কঠিন ছিলো। হাওড়ার বাড়িতেই আমার দুই মেয়ে জন্মালো। বড়ো মেয়ের সাথে ছোট মেয়ের বয়েসের পার্থক্য ছিলো প্রায় সাড়ে সাত বছর। ছোট মেয়ে হওয়ার কিছুদিন আগে থেকেই আমার স্ত্রীর সাথে আমার কিছুকিছু বিষয়ে তীব্র মতবিরোধ শুরু হয়েছিলো। ফলশ্রুতিতে আমার ছোট মেয়ে যখন একেবারেই ছোট সেসময় আমাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। মাতৃহারা দুই মেয়েকে নিয়ে তখন আমার বিপর্যস্ত অবস্থা। ছোট মেয়েটির শরীর স্বাস্থ্য এতোটাই খারাপ হয়ে গেছিলো যে আমি কী করবো, আমার কী করা উচিত সেসব নিয়ে আমার মাথা কোনো কাজ করছিলো না।
হাওড়ার বাসাবাড়ি ছেড়ে আমি আমাদের গ্রামের বাড়ি দক্ষিণ পাথর বেড়িয়া চলে এলাম। চিন্তা করুন আমার কী করুণ অবস্থা তখন। ছোট মেয়েটাকে আমি যখন পেলাম, না খেয়ে খেয়ে ওর যা চেহারা দাঁড়িয়েছে সে দিকে তাকানো যায় না।
সেটা দুহাজার বারো সাল। আপনার মনে আছে কি না জানা নেই। সারাবাংলা জুড়ে সেবার প্রবল শীতের দাপট চলছে। বারো সালের জানুয়ারি মাসে সেরকমই এক প্রবল শীতের সকালে দুই মেয়ের হাত ধরে এসে দাড়ালাম এই অনাথ আশ্রমে আশ্রয় পাওয়ার আশায়। বলরামকাকু তার বিশাল বুকে ঠাঁই দিলেন আমায়। আমায় একটি নির্দিষ্ট ঘরের ব্যবস্থা করে দিলেন। আশ্রমের ছাত্রদের পড়ানোর জন্য একজন শিক্ষক হিসেবে আমাকে কিছু মাসিক বেতনের ব্যাবস্থাও করে দিলেন। সেই থেকে আমার বাড়ি বলুন বাড়ি, ঘর বলুন ঘর, ঠিকানা বলুন ঠিকানা সবকিছুই হয়ে গেলো পাঁউশি অন্ত্যোদয় অনাথ আশ্রম। ধীরেধীরে আমাকে পড়ানোর হাত থেকে রেহাই দিয়ে আমাকে পরিচালন কমিটির একজন সদস্য হিসেবে স্থান করে দিলেন এই আশ্রমে। এখন আর এই আশ্রম শুধুমাত্র আমার ঠিকানাই না, আমার গর্বের বাসস্থান।
আমার বড়ো মেয়ে এখন কলকাতায় নার্সিং পড়ছে, এবারই ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে, আমার ছোট মেয়ে এবার ক্লাস এইটে উঠবে। শুধু আমাকেই না, বলরামকাকু আমার সাথে সাথে আমার দুই মেয়েকেও জীবনে প্রতিষ্ঠার পথ দেখিয়েছেন। স্বপ্ন দেখিয়েছেন কীভাবে একজন প্রকৃত মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা যায়। সত্যি কথা বলতে কি, বলরামকাকু আমার জীবনে একজন ইশ্বরের দূত। তিনি না থাকলে বুঝি…
কথা বলতে বলতে বুদ্ধদেব মাষ্টারের গলা ধরে আসে। পঁয়তাল্লিশ বছরের বুদ্ধদেব বুঝি নিজের চোখের জলকেও আড়াল করার কায়দা শেখেন নি।
এভাবে কতোজন বুদ্ধদেবের অশ্রুসিক্ত কাহিনীই যে ঘুরে বেড়াচ্ছে অন্ত্যোদয় অনাথ আশ্রমের কোণায় কোণায়, গাছগাছালির ফাঁকেফোকড়ে, আর সমস্ত কাহিনীকে বুকে আগলে রেখে আকাশে যার মাথা ছুঁয়ে যাচ্ছে সেই বলরাম করণ, একটা পাজামার ওপর বাংলা শার্ট গায়ে দিয়ে, তার ওপরে কখনও একটা হাফহাতা সোয়েটার, কখনও হাল্কা কম্বল জড়িয়ে নিয়ে ভিক্ষার পাত্র হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন চতুর্দিকে, তার স্বপ্নের আশ্রমের ভালোবাসার আশ্রমিকদের, এই শীতের দিনে সামান্য ওমটুকুর ব্যবস্থা করতে পারেন কিনা তার জন্য।
ক্রমশ