সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে প্রদীপ গুপ্ত (পর্ব – ২৯)

বাউল রাজা
তৃতীয় খণ্ড
সমস্ত জগৎ চরাচর স্তব্ধ হয়ে যেন শুনছে কানাইদার কথা। মিলনের লেগ্যে ব্যাকুল না হলে সে মিলন হবে ক্যামনে? কী আশ্চর্য সুন্দর ব্যাখ্যা! মনের ভেতর হাজার প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। নদী যেন হঠাৎ কুলুকুলু করে বলতে শুরু করে দিলো — আমিও তো তাঁর সাতে মিলনের লেগ্যে ব্যাকুল হয়ে ছুটে চলেচি, তালেপরে আমিও কী বাউল নাকি গো গোঁসাই! কানাইদার গোঁফের নীচটা যেন একটু চলকে উঠলো। দুঠোঁটের মাঝে গোঁফের যে ঈশৎ বাদামী রেখা, সে রেখা ভেদ করে যেন বলাকাশুভ্র দাঁতের ঝিলিক দেখলাম। কিছু যেন বলতে চাইছে কানাইদা।
হঠাৎ করে আমার শ্রীরাধিকার অভিসারের কথা মনে পড়ে গেলো, কৃষ্ণকানাইয়ার সাথে মিলনে যাবে বলে রাধার সে কী ব্যাকুলতা! সে অভিসারের কথা যেন কেউ টের না পান, সেজন্য কত কীই না আত্মপীড়ন করছেন তিনি, গমনকালে পথমধ্যে পায়ে কাঁটা বিঁধলে যদি তিনি কাতর হয়ে শব্দ করে ফেলেন, তাহলে তো ধরা পড়ে যাবেন, সেকারনে পথ কণ্টকাকীর্ণ করে সে পথে রাধারানী হাঁটা অনুশীলন করছেন। পথে ঝড়বৃষ্টি হলে যদি পথ পিচ্ছিল হয়ে পড়ে, আর তিনি পা হড়কে চিৎকার করে ওঠেন, তাই তিনি পথিমধ্যে ভরা গাগরীর জল ঢেলে পথকে পিচ্ছিল করে হাঁটা অনুশীলন করছেন।
আচ্ছা কানাইদা, তাহলে তো শ্রীরাধিকে…
কানাইদা তার দুহাত জড়ো করে কপালে ছোঁয়ালেন। তাঁর থেকেই তো শিক্ষে নেওয়ার শুরু গো পদীপদাদা। তিনি তো বৈষ্ণবদের পরম। সে আকুলি, সে ব্যাকুলি যার পরাণে আচে, সে তো বৈষ্ণব না হয়েও বৈষ্ণবগো। বাউল না হয়েও বাউল। সত্যি বলতে নজ্জা নেই, তোমার মনে যে বাউলের বাস, সে বাউলই না তোমাকে বাউলনিদের শিরোমণি ছিরাদিকের খপর দিলে।
কানাইদা আমার ভেতর কোন বাউলকে খুঁজে পান কে জানে, তবে এঁনাদের যে যাপন প্রক্রিয়া সে প্রক্রিয়ায় আমি কোনোদিনও নিজেকে সামিল করতে পারবো না এ কথা দিনের আলোর মতো সত্য।
এনারা সঞ্চয় জানেন না। শুধুমাত্র শরীর ধারণ করার প্রয়োজনে যেটুকু ক্ষুন্নিবৃত্তির প্রয়োজন সেটুকুই মাত্র মাধুকরীবৃত্তির মাধ্যমে সংগ্রহ করে আনেন।
— তোমার ভাবনায় বুজিবা সামান্য ফাঁকি তেকে গেলো গো ঠাকুর।
কৃষ্ণভামার কথায় ভাবনার ঘোর ভেঙে গেলো।
— বাউলরাও সঞ্চয় করে গো ঠাকুর। বালোবাসা সঞ্চয় করে মনের জটরে জইমে রাকে। বালোবাসার মাদুকরী করে মনের জটরযাতনাকে যোগান দে যেটুকু বেঁচে থাকে সে বাড়তি বালোবাসা পেমের সঞ্চয়ের হাঁড়িতে ডেলে রেকে পূঁজি বারিয়ে চলার ধম্মের নামই বাউলধম্ম।
— বাহ্, খুব সুন্দর বললে তো বাউলদিদি। অন্নের সঞ্চয় যারা করেন তারা গৃহী আর ভালোবাসার সঞ্চয় যারা করেন তারা বাউল! অপূর্ব। এরচাইতে সহজসরল আর সুন্দর ব্যাখা আমি এর আগে কখনও শুনিনি। সেজন্যই বুঝি সে ভালোবাসার সঞ্চয়ের ঝুলিকে উপুড় করে ঢেলে দেওয়ার নামই ব্যাকুলতা। আর সে ব্যাকুলিত জীবন যাপনের আধিকারী যারা তারাই না বাউল!
আকাশে কার ব্যাকুলতা,
বাতাস বহে কার বারতা,
তোমার মতো এমন টানে
কেউ তো টানে না,
তুমি ডাক দিয়েছো কোন সকালে
কেউ তা জানে না!
ক্রমশ