অথ শ্রী উপন্যাস কথা-তে প্রদীপ গুপ্ত – ধারাবাহিক – তৃতীয় পর্ব

পশমিনা

কাশ্মীর উপত্যকার দৈনন্দিন সমস্যা, রাজনৈতিক ঘাতপ্রতিঘাত ও প্রেমের এক অনুভূতিশীল জীবনালেখ্য।

দুধসাদা বরফের বুক গলে তৈরী হয়েছে এক নির্ঝরিণী। যেন কোনো মাতৃস্তন্যনির্গত দুধের মতো রঙ সেই ঝর্ণাধারার। একেরপর এক নির্ঝরিণী এসে যেন কী এক নৈসর্গিক খেলায় মেতেছে। বরফের বুকে তৈরী খাত বেয়ে খলবল করে সেই জলরাশি নেমে আসছে, যেন দিগবালিকারা একে অন্যের কোমরে হাত দিয়ে, খোঁপায় সাদা রঙের ফুল গুঁজে নাচতে নাচতে নেমে আসছে আকাশের বুক থেকে কুলুকুলুস্বরে গাইতে গাইতে। স্থানীয় মানুষেরা বড়ো আদর করে সেই নদীর নাম রেখেছেন দুধগঙ্গা, আর পাহাড়কে ডাকেন দুধপাতরি বা দুধপাথরি বলে। আকাশছোঁয়া পাইন, দেওদার আর ঝাউবনে যেনো নিরালা কোনো তপোবনের শান্তি। উপত্যকা থেকে একেবেঁকে, কখনও ভয়ঙ্কর খাড়াই বেয়ে এগিয়ে চলেছে পথ। একটা সরকারী স্কুল থেকে কলকলিয়ে বেরিয়ে আসছে শিশুকিশোরের দল, ঠিক যেমন কলকল করে নীচের দিকে আছড়ে পড়ছে দুধগঙ্গার ধারা।

সূর্যের আলোও যেন প্রবেশের জন্য অনুমতি চায় পাইন বনের কাছে। এতো ঘন সে বন। স্কুল থেকে ফেরার পথে সে পাইনের আঁধারে ছাওয়া পথে মাথার থেকে হিজাবটাকে মাথার পেছনে সরিয়ে নাচের ছন্দে বাড়ির দিকে ফেরার পথে শাহানারা জানতেও পারেনা কখনও যে একটি কিশোর পাইনগাছের গুড়ির পেছনে পেছনে রোজ ওকে দেখতে দেখতে ওর বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসে।
হঠাৎই একদিন এক অসতর্ক মুহূর্তে কিশোরের পায়ের নীচে শুকনো পাইন কাঠ শব্দ করে ভেঙে যেতেই চমকে পেছনে ফেরে শাহানারা।
— কৌন?
গোলাপী আপেলের মতো কপালের ওপর ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া কুচবর্ণের কুঞ্চিত কেশ এসে লুটিয়ে পড়েছে। লাল দুটো ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে। বুকের ওপর হাতদুটো জড়ো করে সেই কিশোর তার নীল হ্রদের মতো চোখদুটো মাটির দিকে করে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে। অবস্থা দেখে মনে মনে একচোট হেসে নিলো শাহানারা। কাশ্মিরী কন্যা ভয় কাকে বলে জানেনা।
— কৌন হ্যায় আপ? কাঁহা রহেতে হো?
— ইসি জাঁহা মে।
মাথা নীচু করে উত্তর দেয় কিশোর। মনে মনে কিশোরের রসবোধের তারিফ করে শাহানারা।
— নেহি তো আপনে জিব্রাইল হো?
— বিলকুল নেহি জ্বি, ম্যায়নে কোই ফেরেশতা নহি, বান্দাকা নাম সেলিম। লেকিন ইয়ে ইস বান্দেকা গুনাহ নেহি।
— তো?
— ইসি জান্নাত মে কোই মিফতাহুলজান্নাত মিলে হুই থে
— কাঁহা
— ইহা, এহি গাঁওমে। এহি রাহা পর।

দুজন দুজনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, কিন্তু কেউ চোখ তুলে অন্যের দিকে তাকাতে পারছে না।
হঠাৎ করে যেন হাজার হাজার কালিজ পাখি ডেকে উঠলো পাইনের বন জুড়ে। ঝিরিঝিরি পাতায় পাতায় বাতাসের নাচের শব্দে ভরে উঠলো। চঞ্চল হয়ে উঠলো দুটো অপাপবিদ্ধ হৃদয়।
— হায় আল্লাহ —
অস্ফুটে একটা শব্দ বেরিয়ে এলো শাহানারার মুখ থেকে।
মাথা নীচু করে ফিরে যাচ্ছে শাহানারা ওর বাড়ির দিকে, আর নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেলিম, পায়ের গোড়ালি দিয়ে ক্ষত করতে লাগলো মাটির বুকে। সবার অলক্ষ্যে শুরু হলো এক অমর প্রেমকাব্য।

( চলবে )

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *