সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে প্রদীপ গুপ্ত (পর্ব – ১)

পদাতিক
–” বাড়ি যাচ্ছি জ্যেঠু ”
বিকেলবেলা চা খাবো বলে আমি আর বুদ্ধদেব মাস্টার খাওয়ার ঘরের বাইরে রাখা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে গল্প করছিলাম। বিকেল বললে ভুল হবে, দিনচূড়ামণি তখন পলাশ গাছটার পাতায় পাতায় রঙ ছড়িয়ে ঘরে ফিরতে ব্যস্ত। মনে হচ্ছে যেন মগডাল থেকে লাট খেতে খেতে সবচাইতে নীচের ডালটার ডগায় ঝুলে আছেন। এরপরেই টুপুস করে দিনের দোলনায় দোল খেয়ে ঘরের দোরে পা রাখবেন।
গল্প করছিলাম বলতে আমি মাষ্টারের সাথে কথাচ্ছলে আশ্রম সম্পর্কে আমার অনন্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলাম। জীবনের উপান্তে এসে মন বুঝি সংসারের বাইরে শান্তি খুঁজে পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে। এমনিতেই চির বাউন্ডুলে মন নিয়ে সারাটা জীবন সুর, রঙ, আলো আর মানুষ খুঁজে বেরিয়েছি। এখন এসে নোঙর বেঁধেছি বাগদা নদীর গেরুয়া জলপ্রবাহের ধারে এই অনাথ আশ্রমের ঠাঁয়ে।
মুখ তুলে চাইলাম। একজন সদ্য যৌবনা কন্যা, আলো ঝলমলে মুখে আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালো। সারা মুখজোড়া গ্রাম্য সরলতায় বুদ্ধির দীপ্তি ঠিকরে বেরোচ্ছে। মেয়েটিকে চেনার চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছুতেই ওর এতো সুন্দর হাস্যজ্জ্বল মুখটা আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।
–” বেশ, কবে ফিরবে বাড়ি থেকে? ”
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো ওরা।
বুঝলাম কিছু একটা ভুল হলো। নিটোল দুটো চোখের পাতা পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে নামানো।
— ” আমার ছুটি হলো আজ। বাবা মা নিতে এসেছেন। শান বাঁধানো আমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছেন ওরা। ”
আমি নীরবে মাথা নাড়লাম। এবারে মেয়েটি এগিয়ে গিয়ে বুদ্ধ মাস্টারের পা ছুঁলো।
–” আসি স্যার।”
বুদ্ধ মাস্টার ওর মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন।
–” ভালো থেকো। পড়াশোনাটা ছেড়ো না। পাশের খবর পেলে আশ্রমে এসে জানিয়ে যেও। ছেলেটি কি এখনও রাজী আছে? ”
মেয়েটি মাথা কাৎ করলো। শুধুমাত্র এটুকুতেই বুঝি ওর স্যারের সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলো মেয়েটি।
ধীরেধীরে সন্ধ্যা তার ছায়া মেলছে। মেয়েটি ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে ওর মুক্ত জীবনের দিকে। যেখানে ওর বাবা মা ছাড়াও হয়তো অন্য কেউ অপেক্ষায় আছে ওর ঘরে ফেরার।
মুখ তুলে বুদ্ধ মাস্টারের দিকে চাইলাম। সেই চাউনিতে বোধহয় একটা প্রশ্ন লুকিয়ে ছিলো। বুদ্ধ অবলীলায় সে প্রশ্ন পড়ে নিলো।
— ” মেয়েটি বছর দেড়েক হয় এই আশ্রমে এসেছিলো। একটি ছেলের সাথে পালিয়ে বিয়ে করার পর ওর বাবামা অপহরণের মামলা করে। তখন ও সবে সাড়ে ষোলোর নাবালিকা। পুলিশ খুঁজে বের করে আমাদের এই আশ্রমে দিয়ে যায়। আশ্রমে থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিলো এবারে। আঠেরো হয়ে যাওয়ায় ও মুক্তি পেলো। এবার আর ঘর বাঁধতে ওর কোনো বাধা নেই। আমার মনে হয় গেটের বাইরে ছেলেটিও ওর অপেক্ষায় আছে।”
আমার খুব ইচ্ছে করছিলো ওদের দু’জনকে একবার প্রাণভরে দেখতে।
–” আচ্ছা মাষ্টার পরীক্ষার ফল কবে বেরোবে? ”
— ” কোন পরীক্ষা? ওর সামনে এখন অনেকগুলো পরীক্ষা জেঠু। অনেকগুলো পরীক্ষায় এখন ওকে পাশ করতে হবে। ”
–” ওকে যে আমার আশীর্বাদ করা হলো না মাষ্টার? আমার যে খুব ইচ্ছে হচ্ছে ওকে আশীর্বাদ করতে! ”
— আপনি হয়তো মাথায় হাত রাখেন নি, কিন্তু মনে মনে যে শুভকামনা করলেন, সে শুভেচ্ছা ফুল হয়ে ওর পথে ছড়িয়ে পড়বে জেঠু। ”
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম এই গ্রাম্য মানুষটির দিকে। আমরা কেন যে শুধুশুধু শিক্ষার বড়াই করি! জীবনে কতোবার যে আমার মাথা নীচু করলাম এইসব সরল মানুষগুলোর কাছে তার ইয়ত্তা নেই।
— ” বিকেলে মুড়ি খাবে জেঠু? ” সীমা এসে সামনে দাঁড়ালো।
ক্রমশ