বিলাসী স্বপ্নে শব্দের ভিড় ঠেলে ‘রোদ মাখানো স্মৃতির উপকথা’ পড়ছি।একটা অযাচিত সময়ের সামনে ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে….। নীরবতা যেন উপহাস করছে।
হঠাৎ কানে এলো একটা অস্ফুট শব্দ।
“কাকু.. একবারটি এসো।”
বইয়ের পাতা থেকে চোখ তুলে দেখি পাশের বাড়ির জন্টি।
“বল রে…”
“দাদুর কাছে চলো..! সকাল থেকে অস্থির হয়ে পড়েছে। বাবার সঙ্গে অনেকদিন কথা বলে নি তো..!”
ওর মুখে উদ্বেগের ছাপ।
বুঝলাম,আবার মঞ্চে ডাক পড়েছে। পাঁচ মিনিটের ছোট্ট নাটক। ‘পিতা ও পুত্রের কথামালা।’
“চল..” একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে ইশারা করলাম ওকে।
বাইরে ঝিমঝিমে আশ্বিনের বৃষ্টি।তির তির করে ঠান্ডা বাতাসও বইছে।যেন শীতের আপ্যায়নে আগমনী গান ধরেছে।
জন্টির পিছু পিছু শ্যাওলা ইঁটের উপর সাবধানী পা ফেলে এগুলাম ওর বাড়ির দিকে। বাড়িতে পা দিতেই দেখি রাকাবৌদি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে।এই হাসিটা আমি চিনি দীর্ঘদিন।ভিতরের কষ্টটা বাষ্প হয়ে কান্না নয়,হাসি হয়ে ঝরে পড়তে দেখি প্রতিদিনই।
সুজয়দা বছর দুয়েক হলো নেই।পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন খুব কষ্টে। মার্কিন মুলুকে এক বর্নবৈষম্যবাদীর গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল সুজয়দার বুক। স্বামীর এমন পরিণতি নীলকণ্ঠ পাখির মতো পান করেছিলেন রাকাবৌদি। অসুস্থ হৃদয়ের ভারে আক্রান্ত শশুরমশাই বিছানায় শয্যাশায়ী বছর তিনেক।সুজয়দা সপ্তাহে একবার করে ফোনে বাবার সঙ্গে কথা বলতেন।ভারতে আসার দিন পাঁচেক আগেও কথা হয়েছিল বাবা-ছেলের।আর সেদিনই দুপুরে মিডল্যান্ড পার্কে ঘটে গিয়েছিল নির্মম ঘটনাটা।ওঃ.. কি মর্মান্তিক..!
“আমিতো প্রতিদিনই শাঁখা সিঁদুর পরে ওনার সামনে দাঁড়াই।তুমি সপ্তাহে একদিন পারবে না ? আসলে ফোনে তোমার স্বরের সাথে তোমার দাদার খুব মিল,জানো ভাই…!এটা জন্টিও বলে।”
এই কথার পর আমি আর ‘না’ বলতে পারি নি।
তারপর থেকে রাকাবৌদির অনুরোধে ‘প্রক্সি’ দিয়ে যাচ্ছি বছরদুয়েক।ফোনে ‘সুজয়দা সেজে’ সপ্তাহে একবার।
“এসো ভাই…কাল থেকে বাবা ছটফট করছে।কাল রাতে নাকি ওকে নিয়ে খারাপ স্বপ্ন দেখেছে…সকালে উঠে থেকে বলছে,সুজয়ের ফোন আসবে না…?”
ফিসফিস করে বলে চললেন রাকাবৌদি।
“আমি উপরে গিয়ে ফোন করছি,জেঠুর কাছে আপনি যান..”
আমি পা টিপে টিপে উপরে চলে গেলাম। সুজয়দার স্মৃতিমেদুর ঘরটায় ওনার বড় প্রতিকৃতির সামনে একটা চেয়ারে বসে স্পিড ডায়ালে ‘এক’ টিপতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠলো,’মুখার্জি জেঠু..’
আর পাঁচটা দিনের মতোই অপর প্রান্তে ফোনটা রিসিভ হতেই অভিনয় শুরু করে দিলাম।
“হ্যালো… বাবা…সুজয় বলছি..। কেমন আছো?”
“আমি ভালো নেই রে বাবা..”
অন্য দিনের মতো জেঠুর কন্ঠে উচ্ছাস নেই..! কি ব্যাপার? উদ্বেগ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
“কেন কি হয়েছে তোমার?”
“কবে আসবি রে মানিক? তোকে যে বড় দেখতে ইচ্ছে করছে….”
জেঠুর চোখে জল আমি মানসচক্ষে দেখতে পেলাম। নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না..!মনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছি, বেশ বুঝতে পারছি। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে মুখ থেকে একটা শব্দ বেরিয়ে এলো,
“বাবা…!”
“বল মানিক….”
বৃদ্ধ পিতার করুন আর্তি তিরের মত বুকে বিঁধলো।
হঠাৎ চোখ চলে গেল সুজয়দার ছবির দিকে।
এ কি..! সুজয়দার হাসিমুখের ছবিটা অদ্ভুতভাবে অবসাদগ্রস্ত দেখাচ্ছে আজকে।
অনুভবে বাবাকে দীর্ঘদিন না দেখার আকুতিটা যেন চেপে বসছে আমার বুকের ভিতর..! জেঠুর মুখটা ‘পিতার মুখ’ হয়ে ধরা দিচ্ছে যেন চোখের সামনে..।
বুঝতে পারছি সুজয়দা আমার ভিতরে যেন ঢুকে পড়ছে ধীরে ধীরে।আমরা দুজনে এক মন এক প্রাণ হয়ে পড়ছি ক্রমশঃ । কেন এমন হচ্ছে আজ?
দু’বছর ধরে যাপন করা আবেগঘন শব্দগুলো অবিরাম হাতুড়ির মতো ঘা মারছে বুকের ভিতর।
আঃ…! আর পারছি না সহ্য করতে ঈশ্বর।আমায় ঘুম দাও..!
“আমার আর কোনোদিন ফেরা হবে না বাবা….!”
হঠাৎ একটা বিকট শব্দ করে চীৎকার করে উঠলাম আমি। মনের আকাশে জমে থাকা কালো মেঘেরা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তে লাগলো অবিশ্রান্ত ধারায়।
অপর প্রান্তে মুঠোফোনে তখন জন্টির আওয়াজ ভেসে আসছে,”কাকু…তুমি নেমে এসো। দাদু কেমন করছে…!”