অথ শ্রী উপন্যাস কথা-তে প্রদীপ গুপ্ত – ধারাবাহিক – ষষ্ঠ পর্ব

পশমিনা
কাশ্মীর উপত্যকার দৈনন্দিন সমস্যা, রাজনৈতিক ঘাতপ্রতিঘাত ও প্রেমের এক অনুভূতিশীল জীবনালেখ্য।
— আমার মধ্যে স্বর্গে প্রবেশের চাবি খুঁজে পেয়েছে ওই বালক! কি বললো ও মিফতাহুলজান্নাত! হায় আল্লাহ্! এ কথা শোনার পর এমন কোন হুরিপরী আছে যে ওই দুধগঙ্গার নীল জলে এক মুহূর্তের জন্য হলেও তার মুখ দেখতে বসবে না! একবারের জন্য হলেও প্রজাপতির মতো পাখা মেলে মনেমনে উড়ে বেড়াবে না এই পাইনের পাতায়পাতায়! ইনশাল্লাহ, আমি কি প্রেমে পড়ে গেলাম! যদি নাই পড়ি তাহলে এতো খুশবুদার হয়ে উঠেছে কেন বাতাস! এতো রঙ্গিন আলোয় ভরে উঠছে কেন মনের আকাশ? ওই থরথর করে কাঁপতে থাকা লাল চেরিফুলের মতো ঠোঁট, দূর আসমান কি তরাহ আঁখমে ছায়ে হুঁয়ে প্যার কা খোয়াব! না না এতো সুন্দর একটা ছেলে আমায় কেন?
সমস্ত চিন্তাগুলো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে আসে শাহানারার। ওর মনের মধ্যে যেন ভরা বর্ষার লিডার নদীর প্লাবন ডাকে, ওর মনের দুকুল ভেঙে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে থাকে।
শাহানারা কি বেশরম হয়ে যাচ্ছে! তা নাহলে ওর চলার ভেতর ছন্দ আসছে কেন! ঝাউ পাইনের ঝিরি পাতাগুলোর বুক থেকে সমানে ঘুঙ্গুট বাজিয়ে ওর নাচের ছন্দের সাথে তাল মেলাচ্ছে কে?
— আরে ইয়ে তো গুনাহ হ্যায় রে বিটিয়া, পাপ হ্যায় পাপ, হামারা সমাজমে ইসব নহি চলতি হ্যায়রে! হাদিস কা পাঠ নেহি লিয়া তুমনে! আমাদের মুরুব্বিরা একথা জানলে আগে তোকে কাটবে তারপর ওই ছেলেটাকে।
মনের ভেতর থেকে মা যেন চাপাগলায় চিৎকার করে উঠলেন।
সবকিছু জানে শাহানারা — সবকিছু জানে, জানে ঝিলমের বুকে ভাসিয়ে দেওয়া মজনুর লাশের কথা। কিন্তু প্রেম তো বুনো ঘোড়ার মতোই ঘাড় ঝাঁকিয়ে বশ্যতাকে অস্বীকার করে, ঝড়ের মতোই এসে লণ্ডভণ্ড করে দেয় মনের সাজানো বাগান, ফুঁসে ওঠা লহর কি তরাহ ভাসিয়ে নিয়ে চলে একুল ওকুল। কি করবে শাহানারা! ওর মনের আনন্দের রঙিন আকাশ এরকমভাবে কালো মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে কেন? ওর মনে হলো চিৎকার করে ছেলেটাকে ডাক দেয় সেলিম তুম কাঁহা হো? যারা তো আও মেরে জিব্রাইল…
কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ওর গলা থেকে একটুকরো শব্দও বের করতে পারছেনা শাহানারা। একটা মোটা পাইনের শরীরে ও বুনো গোলাপলতার মতো এলিয়ে পড়লো।
হঠাৎ করেই যেন ওর মাথার ওপর কিছু ঝিরিপাতা ঝরে পড়লো। ওর মনে হলো কালিজ পাখির সুরেলা শিসে কে যেন ওকে বলে উঠলো —
— মুঝে কিঁউ ইয়াদ কিয়া মেরা মিফতাহুলজান্নাত!
শাহানারার দুচোখে তখন সেলিমের গুলাবি হোঁট , আর ওর মাথার চুলে আঙুল বুলিয়ে দিচ্ছে টিউলিপের ডাঁটির মতো নরম আঙুল।
ওকি খোয়াব দেখছে নাকি সহিসে সেলিমনেহি আয়া উনকি পাশ, কিছুই বুঝতে পারছেনা শাহানারা। তবে খোয়াবই হোক আর যাই হোক প্রেম যে ইস ধরতি কা লিয়ে নহী, স্রেফ বেহেস্তকা, সেটুকু বুঝতে পারছে শাহানারা। পাইনের জঙ্গলে তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। এখনও জোরে পা চালালেও দশ মিনিট তো লাগবেই। পেছনের কামিজ ঝেড়ে নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালে শাহানারা।
(চলবে)