• Uncategorized
  • 0

গদ্যানুশীলনে পায়েল চ্যাটার্জি

কর্মক্ষেত্র- আকাশবানী কলকাতা শখ- লেখালিখি, বইপড়া, গীটার বাজানো, ছবি তোলা।

স্কুল – বেলা, রং, স্মৃতি…..

-আবার গোলাপি? গতকালেরটার রঙও গোলাপী ছিল না?
-উঁহু। হালকা, এতটা গাঢ় নয়। আর এটার রং গোলাপের পাপড়ির মত ।
-আমার তো বাপু তেমন কোনো তফাত চোখে পড়ছে না! এটা কেনার জন্য এদ্দূর নিয়ে এলি?
গায়ে তখনো কিশোরীবেলার গন্ধ। মফঃস্বলের স্কুল। বাড়ি থেকে অনেকখানি দূরে। একটা ঝিল পেরিয়ে যেতে হতো। ঝিলের পাশের রাস্তা। বাস। বাসের জানালার ধারের সিটটা আমার চাই। পাশে মা। আরেক নেশা ছিল আমার সঙ্গী। ‘পেন’। না, যন্ত্রণার সঙ্গে তখনো কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়নি। লেখা। ভালোবাসা তখন থেকেই। লাল, নীল, কালো সব রঙের মায়াজাল। কাগজে ছোঁয়ালেই কত রং। খাতায় জমা হওয়া শব্দ, অক্ষর। লিখতে বড় ভালবাসতাম। যে পড়া মুখস্থ হয়ে গেছে তাও আবার লিখতাম। এই অভ্যাস ছিল বন্ধুর মতোই।
এক বন্ধুকে সুরক্ষিত রাখতে স্কুলের পাশের দোকানগুলোতে প্রায় রোজই ঢুঁ মারতাম আরেক বন্ধুর সঙ্গে। মা। আমার স্কুল-পথের সঙ্গী। রোজকার যাওয়া-আসা তখনও ‘নিত্যদিন কাল হরণের গ্লানি’তে পরিণত হয়নি। স্কুল ছুটি হলেই ঝাল-মুড়ি, আচার, লজেন্সের রঙিন গল্প। স্কুলের পাহাড়প্রমাণ দরজার বাইরে মা দাঁড়িয়ে থাকতো বেশিরভাগ দিনই নীল রঙের শাড়ি পরে। স্কুল-ছুটির ঘন্টা। একটা হাসি-হাসি মুখ। এবার শুরু হবে আমাদের রঙিন যাত্রা। স্কুলে আসার সময় হাতে সময় সেভাবে থাকত না, তাই সেই যাত্রাপথ স্বাভাবিকভাবেই ছিল বর্ণহীন।
ফুচকা বা লজেন্সের বায়নার শেষে অবশ্যই যোগ হত একটা নাম। ‘পেন’। ‘অমুক পেনটায় কালি পড়ছে না’, ‘তমুক পেনটার নিব ভেঙ্গে গেছে’ এইসব আজগুবি বাহানায় মাকে ভুলিয়ে নিয়ে যেতাম পেনের দোকানে। মা হয়তো বুঝতো সবটাই আজগুবি, কাল্পনিক। তবে ঠিক ‘মিথ্যে’র বিভাগে পড়ে না। তাই হয়তো প্রশ্রয় দিত।
এদিকে স্কুল শেষে পেনের দোকানেও তখন বেশ ভিড়। আ….হা বই, খাতা, পেনের দোকান মানেই আমার কাছে এক আশ্চর্য মায়া-জগত। আলাদা সুগন্ধময় এক পৃথিবী। সেই স্মৃতি-গন্ধের ওম আজও লেগে আছে মনে।
দোকানে পৌঁছেই ভিড়ে নিজের জায়গা করে নিতে ব্যর্থ হতাম। মা বলতো ‘অপেক্ষা কর’। সহনশীলতার চারাগাছ মনের গভীরে প্রোথিত করেছিল সেই সময় থেকেই। তারপর ভিড় কমলে সযত্নে হাত ধরে নিয়ে ঢুকতো দোকানে।
এদিকে রসগোল্লার মতো টপাটপ পেন বাছতাম আমি। মনে থাকতো না আর্থিক সীমাবদ্ধতার কথা। মা বলতো ”সব একদিনেই কিনে নিবি নাকি ? কিছু বাকি রাখতে হয় পরের জন্য। না হলে তো আনন্দ ফুরিয়ে যাবে”
বাধ্য সন্তানের বিভাগে আমার নাম নথিভুক্ত ছিল বরাবর। আজও তাই। একটা বা দুটো পেন হাতে নিয়ে বিশ্ব জয় করার আনন্দে বাড়ি ফিরতাম। কোন কিছুই ‘ফুরিয়ে’ যাওয়ার ভয় থাকতো না। অপেক্ষা, আনন্দ।
এদিকে বাড়ি ফেরার পথে বাসে ওঠার আগেই শুরু হতো গোলমাল। ওই নির্দিষ্ট রুটে বাসের সংখ্যা ছিল সীমিত, তাই তার পেট-ভর্তি। আর লোক তোলা যাবে না। ‌ অগত্যা আবার অপেক্ষা। অবশেষে মিলত বাস। ঝিলের পাশের রাস্তা। বিকেল সন্ধ্যের যোগ-বিয়োগ। ফুরফুরে হাওয়া। বাড়ি ফিরে কোন দিন কদবেল-মাখা বা মুড়ি-মাখা। কোন কোন সন্ধ্যে ইলেকট্রিসিটিবিহীন। হ্যারিকেনের আলোয় লেখাপড়া। বাড়ি ফিরে এসেই নতুন পেনগুলো বারবার ছুঁয়ে দেখতাম। কি যে মজা হত! তারপর নতুন পেনের গন্তব্য ছিল পড়ার ঘরের তাক। ‘দুদিন পরে ব্যবহার করিস’। আমি বেশি করে শব্দ খুঁজতাম। লিখতাম আরো। পুরনো পেনের কালি শেষ হলেই নতুনগুলো ব্যবহার করব। অপেক্ষা আর আনন্দের যোগফল।
তখন জীবন, মৃত্যু, জরা এসবের কাটাকুটি খেলা ছিল না। অনুভূতিশূন্যতা গ্রাস করেনি জীবনকে।
‘বিপ্রদাস পুস্তকালয়’। স্কুল থেকে প্রায় দুই-তিন কিলোমিটার দূরের এক মেঠো পথ। কোন নতুন পেন বিজ্ঞাপনে দেখা আর এই দোকানে পাওয়ার মধ্যে নাকি খুব একটা বেশি দিনের তফাৎ থাকে না। ইচ্ছে অনেক দিনই ছিল ওখানে যাওয়ার। কিন্তু হয়ে ওঠেনি।
‘দ্যাখ দ্যাখ পুতুলের ছবি দেওয়া পেন’! বন্ধুরা সব বলতাম বার্বি-পেন। এক বান্ধবীর পেন্সিল বক্সে আমার কাঙ্খিত কলমটা দেখে চোখ চিকচিক করে উঠেছিল সেদিন। ঠিক আজ যেমন কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যাটা শূন্য দেখলে চকচক করে চোখ। ওই বান্ধবীর কাছ থেকে জেনে নিয়েছিলাম আমার পছন্দের পেনের প্রাপ্তিস্থান।
বিকেলে স্কুলের পরে মায়ের হাত ধরে পৌঁছলাম সেই রঙিন ইচ্ছে-জগতে। তখন ছোট ছোট ইচ্ছেগুলোয় অতি আধুনিকতার ছাপ পড়েনি।
‘বিপ্রদাস পুস্তকালয়ে যাব’ ভেবেই মন তখন শিহরিত। একটা গোলাপী বার্বি-পেন হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরে ছিলাম সেদিন।
পরের দিন স্কুলে আমার গচ্ছিত কলম কেউ না দেখতে চাইলেও জোর করে দেখাচ্ছিলাম। আমি তখন আহ্লাদে আটখানা। এদিকে বিকেল হতে না হতেই আমার সাধের পেনের ঢাকনাখানা গায়েব। আতিপাতি করে ক্লাসরুমে খুঁজেও কোথাও পাইনি তার হদিশ। সকালের আনন্দ তখন বিকেলের আফশোসে পরিণত হয়েছে। মা বলেছিল ক’দিন পরে ব্যবহার করতে পেনটা। পেনের অর্ধেক পোশাক হারিয়ে আমার শুধু চোখ দিয়ে জল পড়াটা বাকি। মাঝে মাঝে ভারী অদ্ভুত লাগে, কত ছোট ছোট বিষয়ে কষ্ট পেতাম সে সময়। আর এখন দুঃখের প্রতি অনাক্রম্যতা তৈরি হয়েছে। তাই বোধহয় গায়ে লাগেনা।
স্কুল ছুটির পর আমার গাল ফোলানো মুখ, ভারী চোখের পাতা দেখে মা বুঝল কিছু একটা অঘটন ঘটেছে। ‘মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে না’। মায়ের কথায় হাসি ফুটল আমার মুখে। আগামী এক মাস পেন কেনার কথা ভাবা যাবে না, এই শর্তে আরেকটা বার্বি-পেন আমার ঝুলিতে এল। আমি তখন বার্বি-পেনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। তাই যে কোন শর্তেই রাজী হলাম।
নতুন কলমকে সঙ্গী করে বিষন্নতা কাটিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
সম্প্রতি বাড়ির কিছু অংশ সারাতে গিয়ে দেখলাম আজও স্মৃতিকথার ভার বহনকারী সেইসব কলমেরা রয়েছে আমার বাড়িতে।
নানা সীমাবদ্ধতার কারণে টুকটাক আত্মীয়স্বজনের বাড়ি ছাড়া মায়ের সঙ্গে সেভাবে কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ছেলে হওয়ার পর ভেবেছিলাম পুরী যাব। কিন্তু এমন দুর্বিষহ সময়ে সেই ভাবনাও বাতিল করতে হয়েছে। তাই মায়ের হাত ধরে সেই স্কুল-পথে পেনের দোকান গুলোতে ঘোরা আজও স্মৃতিপটে অমলিন।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।