T3 || নারী দিবস || সংখ্যায় পায়েল চট্টোপাধ্যায়

আয়ুর্বেদ চর্চার পথিকৃৎ: অসীমা চট্টোপাধ্যায়
সত্যেন্দ্রনাথ বসুর চিঠি-”শুষনি শাকের নির্যাস থেকে যে ভেষজ (মার্সিলিন) বের করা হয়েছিল, তা নিয়ে গবেষণার কথা মনে হচ্ছে, ডাক্তারেরা এটি নিয়ে মৃগীরোগের সমাধানে ব্যবহার করেছিলেন, ফল ভালোই হয়েছিল বলে শুনেছিলাম, রুশ যাত্রায় বেশ বিপদে পড়ে ছিলে শুনেছি। কৌতূহল রইল সব শোনবার।” ইতি- সত্যেন বোস (২২শে জুলাই, ১৯৭০)। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে গবেষণারত এক অধ্যাপিকার উদ্দেশে লেখা চিঠি। চিঠিটি পড়ে আবার নিজের টেবিলে এসে বসলেন অধ্যাপিকা। শান্ত, সমাহিত মুখ। চিঠিতে উল্লেখ করা মানুষটার স্নেহ স্পর্শ করে সেই অধ্যাপিকাকে। তাঁর গবেষণায় আন্তরিকতা অনুপ্রেরণা দেয় সেই অধ্যাপিকাকেও। পরিবেশের অবহেলিত গাছপালার ঔষধি গুণ, এমনটাই সেই অধ্যাপিকার গবেষণার বিষয়। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর চিঠিটা অনেকটা আশ্বস্ত করেছিল অধ্যাপিকাকে। অবশেষে, মৃগী রোগের ওষুধের বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো গেছে। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর চিঠিতে সেই কাজের প্রতি সদর্থক ইঙ্গিত ওই অধ্যাপিকাকে তাঁর সাধনার প্রতি আরো নিমগ্ন করেছিল। আজীবন গভীর সাধনায় এভাবেই ডুবে থেকেছেন অসীমা চট্টোপাধ্যায়। আয়ুর্বেদ চর্চার ক্ষেত্রে অনন্য এক প্রতিভা অসীমা চট্টোপাধ্যায়।
১৯১৭ সালের ২৩শেসেপ্টেম্বর জন্ম অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের। বাবা ডাক্তার ইন্দ্রনারায়ন মুখোপাধ্যায়। মা কমলা দেবী। চট্টোপাধ্যায় পদবী পাওয়া বিবাহসূত্রে। তবে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ, উৎসাহ সবটাই পেয়েছিলেন অধ্যাপক বাবার সাহচর্যে। বাবা ইন্দ্রনারায়ন মুখোপাধ্যায় বঙ্গবাসী কলেজে অধ্যাপনা করতেন। তাঁদের বাড়ি ছিল হুগলীর হরিপালে। কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকলেও নিয়মিত যাতায়াত ছিল হুগলীতে। সেই যাতায়াতের পথেই মেয়েকে প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে ছিলেন বাবা ইন্দ্রনারায়ন মুখোপাধ্যায়। আমাদের আশেপাশে অযত্নে, অবহেলায় বেড়ে উঠতে থাকা গাছ, গাছড়ার ভেষজগুণ অসীম। এই ঔষধি গুণের সাহায্যে মানুষ পেতে পারে সুস্থ জীবন, আজীবন এই বিশ্বাসেই দীক্ষিত ছিলেন অসীমা চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বাবা তাদের পৈতৃক বাড়ি হুগলীতে যাওয়ার সময় অজস্র গাছ চিনিয়েছিলেন অসীমাকে। প্রকৃতির সৃষ্টির সঙ্গে শুরু হয়েছিল বন্ধুত্ব যা পরবর্তীকালে গবেষণার বিষয় হয়ে ওঠে অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের।
বেথুন কলেজিয়েট স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন অসীমা চট্টোপাধ্যায়। বিশেষ বৃত্তি সহযোগে সম্মানিত করা হয় তাঁকে। এরপর রসায়ন নিয়ে স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন স্নাতক বিভাগে। মেধাবী কিশোরীর মনে তখন গাছেদের থেকে পাওয়া রাসায়নিক নিয়ে প্রবল আগ্রহ। তবে অধ্যাবসায়ের পথটা এতটাও মসৃণ ছিল না। ছাত্র-ছাত্রীদের একই সঙ্গে রসায়ন বিষয়ের অনার্স পড়ানো হতো স্কটিশ চার্চ কলেজে। সমাজ তখন রক্ষণশীল। ছেলে, মেয়ে অবাধে একসঙ্গে পড়াশোনায় পারিবারিক সম্মান হানির সমূহ সম্ভাবনা, এই ধারণা থেকেই প্রথমবার বাধার সম্মুখীন হয় অসীমার পড়াশোনা। তবে মেধা, অধ্যাবসায় আর বাবা-মার সমর্থনে পরিবারের অন্য সদস্যদের তরফ থেকে আসা বাধা তেমনভাবে টেকেনি পড়াশোনার পথে। আর সঙ্গী ছিল পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ।পছন্দের বিষয় এবং ভবিষ্যতে রসায়ন নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন নিয়েই অসীমা চট্টোপাধ্যায় ভর্তি হয়েছিলেন স্কটিশ চার্চ কলেজে। ১৯৩৬ সালে স্বর্ণপদকসহ পাশ করেন। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর-এর পড়াশোনা শুরু। গবেষণা শুরু হয় অধ্যাপক প্রফুল্ল কুমার বসুর হাতে। প্রথম মহিলা হিসেবে ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডক্টর অফ সায়েন্স ডিগ্রী অর্জন করেন অসীমা চট্টোপাধ্যায়। বর্তমান যুগের নারী প্রগতি বা ক্ষমতায়ন তখন দূর অস্ত। তবুও অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের মত এমন দৃঢ়চেতা বিজ্ঞানীরাই ছিলেন দৃষ্টান্ত। গবেষণা জীবনের শুরু থেকেই তাঁর মেধা সম্মানিত হয়েছে। প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ উপাধি, নাগার্জুন পুরস্কার, যোগমায়া দেবী স্বর্ণপদকের মত পুরস্কার ধরা দিয়েছে খুব অল্প সময়েই।
স্নাতকোত্তর স্তরের পড়াশোনা শেষ করে সাধনায় নিমজ্জিত করেছিলেন নিজেকে। তিনি ছিলেন গবেষণা-অন্ত প্রাণ। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রকৃতির আনুকূল্যে বেড়ে ওঠে অজস্র গাছ-গাছড়া। নিত্য যত্ন পায়না তারা। সেই অহেতুক বেড়ে ওঠা সবুজের ভেতরেই থাকে জীবনের হেতু, এই সত্যিকে উপলব্ধি করে শুরু করেছিলেন গবেষণা। বিভিন্ন গাছ থেকে প্রাপ্ত অ্যালকালয়েড বা উপক্ষার, কুমারিন, টারপিনয়েড এইসব রাসায়নিক পদার্থের ভেষজ গুণ ছিল অসীমা চট্টোপাধ্যায়-এর গবেষণার বিষয়। শুষনি শাক, চিরতা, কুটকি গাছ থেকে মৃগী রোগের ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। তাঁর আবিষ্কৃত ‘আয়ুষ-৫৬’ মৃগী রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ‘আয়ুষ-৬৪’ ব্যবহৃত হয় ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক হিসেবে। নয়নতারা ও সর্পগন্ধা গাছ থেকে পাওয়া অ্যালকালয়েডস নিয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল প্রগাঢ়। নয়নতারা গাছ থেকে পাওয়া অ্যালকালয়েডস ব্যবহার করে ক্যান্সার রোগের ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন তিনি, যা আজও কেমোথেরাপিতে ব্যবহৃত হয়। এমনকি এক রকম অ্যালকালয়েডসের বিভিন্ন রাসায়নিক গঠন সম্পর্কে গবেষণা করে তিনি দেখিয়েছিলেন এক ধরনের উপক্ষার থেকে পাওয়া যেতে পারে অনেক রোগের ওষুধ। বিশেষ করে ইন্ডোল গ্রুপের উপক্ষার নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে অনেক গাছের নতুন প্রজাতির সম্বন্ধেও জানতে পেরেছিলেন তিনি। ছাতিম গাছ থেকে পাওয়া উপক্ষারের ব্যবহার করে ম্যালেরিয়ার ওষুধ তৈরি করেছিলেন অসীমা চট্টোপাধ্যায়। ভারতীয় বনৌষধি নিয়ে মোট ছ’টি গ্রন্থের সম্পাদনা করেন তিনি।
১৯৪০ সালে অসীমা চট্টোপাধ্যায় লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ-এর প্রধান হিসেবে যোগদান করেছিলেন। ওই বছরই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে পড়াতে শুরু করেন। তবে গবেষণায় অন্তপ্রাণ এই বিজ্ঞানীর অন্তরে তখন দোলাচল শুরু হয়েছে। গবেষণা ও শিক্ষকতা দুইয়ে ভারসাম্য বজায় রাখার চিন্তা। তবে সেই তাল দক্ষতার সঙ্গে মিলিয়েছিলেন অসীমা চট্টোপাধ্যায়। পড়াশোনা আর গবেষণার ভেতরেও সন্ধান করেছেন প্রকৃতির সৃষ্টির মাধুর্য।
নম্র, মৃদুভাষী, বিনয়ী এই বিজ্ঞানী বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন রসায়ন বিজ্ঞানের অধ্যাপক বরদানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ১৯৪৭ সালে অসীমা চট্টোপাধ্যায়-এর সুযোগ আসে বিদেশে গবেষণা করার। কিন্তু তখন তিনি বিবাহিত এবং ১১মাসের সন্তানের মা। গবেষণা আর মাতৃত্ব এই দুইয়ের মাঝে পড়েও একটুও বিচলিত হননি। সন্তানের সঠিক পরিচর্যা এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়ে তাকে সঙ্গে করে পাড়ি দিয়েছিলেন আমেরিকায়। ওখানে সন্তান সামলে গবেষণায় সময় দিতেন। সন্তান ও গবেষনা কাউকে কখনো অবহেলা করেননি। সর্পগন্ধা থেকে পাওয়া উপক্ষার নিয়ে ওখানে গবেষণা করেছিলেন বিখ্যাত রসায়নবিদ লিনাস পাওলিং-এর সঙ্গে। ভারতের গাছ-গাছড়া সম্বন্ধে অসীমা চট্টোপাধ্যায়-এর প্রগাঢ় জ্ঞান মুগ্ধ করেছিল স্বয়ং পাওলিংকে। আজীবন পাওলিং যোগাযোগ রেখেছিলেন তাঁর প্রিয় বিজ্ঞানী ও আয়ুর্বেদ-সাধিকা অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ১৯৪৭-৫০ এই তিন বছরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যালটেক এবং সুইজারল্যান্ডের জুরিখে গবেষণা করেছেন। ক্যালটেকেই তাঁর প্রথম আলাপ হয়েছিল লাইনাস পাওলিং-এর সঙ্গে। জুরিখে তিনি নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী পল কারের সঙ্গেও কাজ করেছিলেন। আয়ুর্বেদ চর্চাকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের অবদান অনস্বীকার্য।
দেশে ফেরার পর ১৯৫৪ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় রসায়ন বিভাগের ‘রিডার’ হিসেবে যোগদান করেন। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবলমাত্র একজনকেই এই সম্মানজনক সুযোগ দেওয়া হতো। এই স্থান বেশিরভাগ সময়ই অলংকৃত করতেন পুরুষেরা। এই ভাবনা বদলানোর পথিকৃৎ ছিলেন অসীমা চট্টোপাধ্যায়। প্রথমবার তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজে অসীমা চট্টোপাধ্যায় পেয়েছিলেন এই বিশেষ সাম্মানিক স্থান। তারপর কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন। বাষট্টিতম বিজ্ঞান কংগ্রেসে প্রথম কোন মহিলা হিসেবে তিনি বক্তৃতা দেন। তবে সেই বক্তৃতায় তাঁর প্রগাঢ় জ্ঞানের সঙ্গে পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল অনুভূতিশীল মনের। সেই সময় ছাত্র-ছাত্রীদের অবস্থা, গবেষণায় নানা প্রতিকূলতা, গবেষণার ক্ষেত্রে আর্থিক অসুবিধার কথা বারবার বলতেন তিনি। বিজ্ঞান কংগ্রেসের বক্তৃতাতেও ছিল তেমনই ভাবনা। ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তিনি অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষিকা ছিলেন। সন্তানের মতোই ভালোবাসতেন তাঁদের। কর্মক্ষেত্রে সকলেই তাকে ‘দিদি’ বা ‘মা’ বলে ডাকতেন। গবেষণার ক্ষেত্রে তিনি UNESCO এবং UNDPর কাছ থেকে আর্থিক সাহায্যের বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
গবেষণা ক্ষেত্রে সেই সময় তাঁর চলার পথ খুব একটা সহজ ছিল না। গবেষণাগারে আর্থিক অভাবের মধ্যেও তিনি সাধনা করেছেন বিভিন্ন গাছের ঔষধি গুণ নিয়ে। গবেষণার ফলাফলের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করেছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানকে। তাঁর ছাত্র ও ডক্টর পাকরাশীর কথায় মাত্র তিনশো টাকায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের গবেষণাগার চালাতে হতো তাঁকে। তিনি নিজে বৃত্তি পেতেন মাত্র দেড়শো টাকা। অনেক ক্ষেত্রেই নিজের উদ্যোগে গবেষণা করতেন তিনি। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাকে গবেষণাগারের বৃত্তি পেতে সাহায্য করেছিলেন। অল্প সময়েই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বিজ্ঞান-এর সমস্ত কল্যাণকর কাজ, সাধনা মানুষ পর্যন্ত না পৌঁছলে তাঁর অধ্যাবসায় সম্পূর্ণ হবে না। বিভিন্ন গাছ থেকে পাওয়া ওষুধ তাই তিনি পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন সেইসব মানুষের কাছে, যাঁদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রতিকূলতা রয়েছে। তাই নিজের উদ্যোগে গড়ে তুলেছিলেন সল্টলেকের আয়ুর্বেদ হাসপাতাল। স্নেহশীলা অসীমা চট্টোপাধ্যায় কর্মক্ষেত্রের সকলকেই আপন করে নিয়েছিলেন নিজের পরিবারের মতো করে। আয়ুর্বেদ সংক্রান্ত চর্চা এবং গবেষণার পথ প্রশস্ত হয়েছিল অসীমা চট্টোপাধ্যায়-এর হাত ধরে। ভারতবর্ষে আয়ুর্বেদ চর্চার পথিকৃৎ হিসেবে আজও তাঁর নাম স্বর্নাক্ষরে লিখিত। ২০০৬ সালের ২২শে নভেম্বর মৃত্যু হয় তাঁর। সময়ের স্রোতে অনেক ক্ষেত্রেই বিস্মৃত হয়েছে তাঁর নাম। তবুও তাঁর কাজ আজও সমৃদ্ধ করে চলেছে চিকিৎসাবিজ্ঞানকে। সেবা করে চলেছে মানুষের।