বছরের শেষ তিন দিনের জমকালো গাজন উৎসব শেষ হলেও আমাদের মন খারাপের কোন অবকাশই ছিল না। বরং ওইদিন সারাদিনের ক্লান্তি নিয়েও ঘুমের মধ্যে কেমন ফুরফুরে হয়ে থাকত মন, পরদিন সকালের অপেক্ষায়। নতুন বছরের নতুন সকাল। ভোরবেলা শাঁখের শব্দে ঘুম ভাঙত । ওদিন আর ডাকাডাকির বালাই নেই, নিজেরাই লাফ দিয়ে বিছানা ছাড়তাম। ততক্ষণে বাড়ির সদর দরজায় আতপচালের আল্পনার ওপর আমশাখা আর হরিতকী দিয়ে ঝকঝকে কাঁসার ঘটটি বসানো সারা। মায়ের আল্পনার হাত ছিল চমৎকার, যেটি পরে আমার আয়ত্তে এসেছিল। তুলসীগাছের ওপর বসুধারার নতুন মাটির ঘট, তার নিচের ফুটোয় একটা ধানের শিসের মত কিছু গোঁজা থাকত, তা দিয়ে সারাদিন টুপটুপ করে জল পড়ে এই প্রবল গ্রীষ্মে ভিজিয়ে রাখত মাটি।
স্নান করে একপিঠ খোলা চুলে অল্প একটু ঘোমটা, মা ঠাকুরের বঁটিতে ফল কেটে আলাদা আলাদা কাঁসার রেকাবিতে সাজাচ্ছে। নারায়ণ পুজোর, বুড়িমার পুজোর থালা। ফুলও সব আলাদা, নারায়ণ পুজোর সাদা ফুল আর অন্য রেকাবিতে সবরকম ফুল। মাটির সরায় ভাঙা চাল আর জল পাখিদের জন্যে। বাড়ি ঘেঁষা মন্দিরে ভোর থেকে ঘন্টা বাজছে ঢং ঢং। লোকজন আসছে, যাচ্ছে। প্রণাম, মিষ্টি।
দামী কিছু না হলেও একটা নতুন সুতির জামা প্রায় প্রতিবছরই হত। বেশিরভাগই আমার সিমলা স্ট্রিটের মাসিমণি পাঠাত নিজে হাতে সেলাই করে, প্রতিবার তার ভিন্ন ভিন্ন কাট। যে বছর হত না কোন কারণে, সেবছরও কোনো হেলদোল ছিল না, পুজোর জামাটাই পরে নিতাম দুপুর ফুরোতে না ফুরোতে। সকাল থেকে সেদিন একবারও পড়ার জন্যে তাড়া দিত না কেউ। এমনিতেও আমাদের সারাবছরের পড়াশুনা নিয়ে বাবা বা মা কারোর কোনরকম উদ্বেগ দেখিনি। সেটা সম্ভবত আমার মেধাবী এবং আদ্যন্ত ভালো ছেলে দাদার কল্যাণে। ‘দাদাকে দ্যাখ তো , পড়ার কথা বলতে হয় কখনও ‘ বলে চোখের সামনে একজন জলজ্যান্ত ভালো ছেলের উদাহরণ দেখিয়ে সকাল আর সন্ধ্যে ঠিকঠাক পড়তে বসেছি কিনা দেখেই নিশ্চিন্ত হয়ে যে যার কাজে। দিনরাত এত বুদ্ধিমান একজনের সংগে থেকেও যে আমি চরম ফাঁকিবাজ হব, তা ছিল ওদের ধারণার বাইরে। বাবার গাছপালা, স্কুল, পার্টি, পঞ্চায়েত অফিস, ক্লাব, পুজোর আগে নাটকের মহড়া, গান …. আর মা তো বাড়ির একগাদা লোকজন, আমরা ভাইবোন ছাড়াও মামাতো পিসতুতো বোন সহ অনেকগুলি পাতের সংসার, রান্না এসবের বাইরে ফাঁক পেলেই গল্পের বই নিয়ে বসে যেত। বাবা মা দুজনেরই সাহিত্য প্রীতি ছিল ,তবে মায়ের নেশা ছিল সাংঘাতিক । সারাদিন পরিশ্রম করেও মাঝরাত্রি অবধি শোবার ঘরের মেঝেয় মাদুর পেতে আলো নিভিয়ে ল্যাম্প জ্বেলে গল্প উপন্যাস পড়তে মাকেই দেখেছি ঘুম ভেঙ্গে । বিকেলে প্রায়ই হারমোনিয়াম নিয়ে বসত পাড়ার কিছু মেয়েকে গান শেখাতে। বিয়ের সম্বন্ধ এলে দু একটা গাইবার মত তুলে নিত টুসুদি ,লুসিদিরা ।
দাদা শুরু থেকে একা একাই পড়ে ক্লাসে প্রথম বরাবর। আমিও প্রাইমারিটা ওই প্রথমে থেকে হাইস্কুলে গিয়ে সেকেন্ড হয়ে ফেলে আর এক নম্বরে ফিরতে পারিনি। বোন আর একটু ছোট, সেও আপনমনে বড় হচ্ছে। আমাদের সময়ে যে ছেলেমেয়েকে মনোযোগ দেওয়া হত না এমন নয়, যথেষ্টই আদর যত্নে মানুষ হয়েছি, তবে এখনকার অতি মনোযোগ, নিজেরা সামনে বসিয়ে প্রায় গিলিয়ে খাওয়ানোর মত পড়ানো ছিল না। আর আমাদের পুরো পাড়াটাই প্রায় এমন ছিল, পুরুষরা সবাই বাবার মত ওই ওই ওই…. মায়েরাও ওই একই ব্যাপার। বকাবকি শাসন ছিল, আবার সাঁতার থেকে সাইকেল চালানো সেসবও হাতে ধরে শিখিয়েছিল বাবাই । বউ বসন্ত থেকে ব্যাডমিন্টন, ক্যারাম থেকে কাবাডি, দাদারা ক্রিকেট খেললে ফিল্ডিং করা, সব কিছুতেই বাবার উৎসাহ। আমাদের জন্যে শুকতারা আসতো। সোভিয়েত পত্রিকা নিয়মিত পাঠাত বড়মামা। ভালো ফল করলে বই , জন্মদিনে বই উপহার সবই ছিল। নতুন বই মলাট করে দিত যত্ন করে ,সাদা বা রুলটানা কাগজ কিনে খাতা তৈরি করে দিত। আর হঠাৎ করে পড়ার মাঝে ‘উঁকি দিয়ে ‘কী ব্যাপার, সাড়াশব্দ নেই কেন ‘…. মোটামুটি এই । রেজাল্ট বেরোনোর পর অংকে কাঁচা আমাকে নিয়ে এক আধদিন যখন বসত, সেদিন কপালে দুঃখ ছিল। চেঁচামেচি এত হত যে বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে সবাই বলাবলি করত, ‘ এই রে, আজ সুনীলদা বসেছে পড়াতে। ‘
তবে সে উৎসাহ ফুরিয়ে যেত দু একদিন পরেই ।তবে রাত্রে নিয়ম করে ডায়েরি লিখত, সুন্দর সব ছোটগল্প কবিতা লিখত বাবা । কলেজের ম্যাগাজিনে ছাড়া আর কোথাও সেসব বেরোয় নি । বাবাকে দেখে আমিও উৎসাহিত হয়ে বাবার ডাইরিতে, দুচারটি ছড়াই বলা যায় ,লিখে ফেলার পর বাবা আমাকে আস্ত একটি পুরোনো নীল ডায়েরি দিয়েছিল ,সেটা কিছুদিনের মধ্যেই হিজিবিজি সব কবিতা আর নিজের কথা লিখে ভরিয়ে ফেরেছিলাম ।
তো কেউ দেখার ছিল না বলে আমিও নিশ্চিন্তে অংক কী কঠিন’ বলে পেন কামড়ে বসে থাকতাম। দাদা দু একবার বুঝিয়ে ফিরে যেত নিজের পড়ায় । আর অংকে প্রায় প্রতিবার একশো পাওয়া দাদা যখন বুঝিয়ে পারছে না, তখন অংক আমার দ্বারা হবে না সবাই জেনে গেছল, আমিও। তবে ওই দাদাই একবার এমন দায়িত্ব নিয়ে টানা কিছুদিন আমাকে অংক করিয়েছিল , যে সেবার সবাইকে অবাক করে আমি ঊন আশি পেয়ে গেলাম। আমার জীবনে অংকে ওই রেকর্ড নম্বর। অবশ্য তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
যাই হোক, ক্লাস সেভেন এইট অবধি পরীক্ষার আগে ভূগোল ইতিহাস মুখস্থ করে রান্নাঘরে মায়ের কাছে গিয়ে বসতাম। মা একহাতে বই খাতা দেখে মুখস্ত মেলাত আর অন্যহাতে খুন্তি নাড়ত। মাঝে বছর খানেক বাবা একবার বিনা পয়সার টিউশনি করেছিল। সুনীল কড়া মাস্টার ,শাসনে থাকবে ছেলেরা , এই অনুরোধে রাজি হল বাবা । ওদিকে সন্ধেবেলা পার্টি অফিস থেকে লোক , পঞ্চায়েতের সমস্যা নিয়ে ডাকাডাকি.. …বাবা কিছু কাজ দিয়ে ‘ এই তোরা পড়। খবরদার কোন গোলমাল নয় ,আমি এক্ষুনি আসছি ‘ বলে বেরিয়ে যেতে না যেতে আমরা হুটোপাটি করে বসার ঘর তোলপাড় করে ফেলতাম । মা বকতেও জানত না আর কেউ মানতও না আমাদের শান্ত মাকে । আমাদের রোজকার পড়াশোনার জীবনে বাবা মায়ের ভূমিকা ওই অবধিই।
সে অন্য কথা, নতুন বছরের প্রথম দিনে তো নয় সেসব! সেদিন সকালে পাড়া ঘুরে গুরুজনদের প্রণাম করে মিষ্টি খেয়ে ফিরে চিঠি লিখতে বসা । একবারে লিস্ট ধরে সমস্ত আত্মীয়স্বজনকে । ইনল্যান্ড খাম ছাড়া চিঠি লেখা মায়ের পছন্দ ছিল না । দীর্ঘ দীর্ঘ সব চিঠি লিখত, এদিক ওদিকের মার্জিনও বাদ যেত না ,যে অভ্যেস পরে আমারও হয়েছিল । নতুন বছরের চিঠির সঙ্গে আমারাও গুঁজে যেতাম । ভাগের এইটুকু জায়গায় প্রণাম ভালবাসা জানিয়ে শেষ করে দিতে আমার একদম পোষাত না মনে আছে ।
এরপর দুপুর শেষ না হতেই, আগেই লিখেছি নতুন জামাটি পরে নেওয়া। সারা বিকেল বাবার সংগে দুপাশে কলাগাছ বসানো, আমপাতা আর ফুলের মালায় সাজানো দোকানে দোকানে ঘুরে মিষ্টির বাক্স, ক্যালেন্ডার সংগ্রহ। অনেক দোকানেই আখেরী চৈত্রের টাকা ( আখেরী চৈতই বলতে শুনতাম, মানে জানা ছিল না ) বাকি থাকত, আর যেখানে থাকত না সেখানেও অল্প কিছু টাকা দিতে হত হলুদ আর সিঁদুর লাগানো নতুন লাল খেরোর খাতার সামনে ক্যাশবাক্স কোলে বসে থাকা মালিককে। এ টাকা মিষ্টি ক্যালেন্ডারের দাম নয় । জমা রইল, পরে কিছু কেনা হবে । কেউ কেউ সরবত মিষ্টি আর নিমকি খাওয়াত। ড্রাম থেকে মগ ডুবিয়ে গোলাপ জল দেওয়া সরবতের জল পরিশুদ্ধ কিনা, এ নিয়ে তখনের বাবা মায়েদের মাথাব্যথা ছিল না।
আমাদের আসল আনন্দ ছিল সেজদাদুর রাইস মিলের নতুন খাতার নিমন্ত্রণে। আমাদের ছোটবেলার সেই একদিকের সিংহ ভেঙে পড়া আর অন্যদিকে এক চোখে একটা গর্ত ওয়ালা সিংহ দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল দেউড়ির ভেতরের পাঁচমহলা জমিদার বাড়ির এক মহলের মালিক ছিল এই দাদু, বিজনবিহারী বন্দ্যো । মোটে বছর পাঁচ ছয়ের বড় বাবার থেকে, কিন্তু আত্মীয়তা সূত্রে দাদু । সেই তরুণ দাদুর মিল ছিল আমাদের নববর্ষের অফুরান আনন্দের উৎস। সেদিন দরাজ হাতে বিরাট আয়োজন করত সেজদাদু। এমনিই খুব দিলদরিয়া ছিল মানুষটি। এই একটি কারণে বাবার সংগে সখ্যতা ছিল খুব। দুজনে মিলে কত গরীব মেয়ের বিয়ে উদ্ধার করেছে সমস্ত জিনিসপত্র দিয়ে, এমনকি অনেক গরীব বাড়িতে নিজেরা রান্না করেও খাইয়ে আসত বরযাত্রীদের। জমির ধান, পুকুরের মাছ ছাড়াও বাবার সোনার বোতাম আংটি সব এইভাবে গেছল। সেসব আবার আলাদা গল্প।
তো এই সেজদাদুর একটি চমৎকার লাইব্রেরি ছিল তাদের তৃতীয় মহলে। লম্বা দেওয়াল জুড়ে কত বই, অবাক হয়ে দেখতাম আমি। প্রায়ই সেখান থেকে বই আনতাম মায়ের জন্যে। আর এইভাবে বেশ ছোট বয়সেই বুঝি না বুঝি একদম সৌরীন্দ্রমোহন থেকে প্রভাবতী দেবী সরস্বতী হয়ে শরৎ চন্দ্র ,আশাপূর্না, শরদিন্দু আর রবীন্দ্রনাথও কিছু পড়া হয়ে গেছল । আমাদের বাড়িতেও নিয়মিত পত্র পত্রিকা আসতো । নবকল্লোল , প্রসাদ আরো কী কী যেন । সেসব পড়ার অনুমতি ছিল না তখন। দেশ পত্রিকা পড়া শুরু হয়েছিল কলেজে উঠে। তবে বেতারজগত বলে একটা পত্রিকা আসতো,তাতে সেবছর পুজোসংখ্যার গানের কথা দেওয়া থাকত , মুখস্থ করে খুব গাইতাম মনে আছে । আর ছিল অনেক বাঁধানো বসুমতী অনেক, লাল ঝুরঝুরে
হয়ে গেছিল তার পাতাগুলো ।
যা বলছিলাম , সেজদাদু রবীন্দ্রসংগীত শুনতে খুব ভালোবাসত বলে আমাদের দুই বোনের স্পেশাল খাতির ছিল তার কাছে। দেখলেই ‘দিদিভাই একটা গান শোনা’বলে এমন ধরে পড়ত যে দাদুকে বাড়িতে আসতে দেখলেই আমরা লুকিয়ে পড়তাম । ‘তখন ছুটি ফুরিয়ে গেছে কখন অন্যমনে’ শুনে চোখে জল আসার কী হল বুঝতাম না বলে মনে হত মাথায় একটু ইয়ে আছে।
সবই ভালো, কিন্তু যেজন্যে আড়ালে আবডালে সেজদাদুকে নিয়ে একটু আধটু আলোচনা হত, তা তার সান্ধ্যকালীন পানের অভ্যাসের কারণে । অনেকেরই অনেক রকম দোষ গুণ ছিল, কিন্তু ওই সময়ে আমাদের পাড়ায় পানের ব্যাপারটা খুব খারাপ চোখে দেখা হত। বাবা তো প্রায়ই বাড়ির লোকের অভিযোগ শুনে মাতাল ধরে চড় থাপ্পড় লাগাত । কত মদের বোতল যে আমাদের চাতালে ভাঙা হত, ঠিক নেই। আমরা জানলা দিয়ে দেখতাম মার খেয়ে যত না, তার চেয়েও বোতল ভেংগে তরল গড়িয়ে যেতে দেখে হাহাকার করত লোকগুলো।
রাগ ঠান্ডা হলে বাবা একদম মায়াময় মানুষ। নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে তার মাথায় হাত টাত বুলিয়ে ‘ তোর বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে না, কেন টাকা নষ্ট করে এসব ছাইপাঁশ গুলো খাস বল দেখি! লিভারের তো বারোটা বাজালি , যা চাল কিনে নিয়ে বাড়ি যা ‘ বলে বাড়ি পাঠাত। মায়ের সাহস ছিল না কিছু বলার। ঘরের মধ্যে আমাদের কাছে গজগজ করত, ‘ ও মদ খাক মরুক, তোমার কী রে বাবা? মেরে ধরে আবার টাকা বিলোনো ! ‘
সেসব বাবা শোনে নি কোনদিন, শুনলেও কিচ্ছু কাজ হত না অবশ্য।
নতুন খাতার দিনে সেজদাদুর রাইস মিলের চাতাল জুড়ে একগাদা হ্যাজাকের আলো, তখনও কারেন্ট ছিল না চাতালে। সন্ধ্যের একটু আগে ওদের সদর দেউড়ির বাগানের গাছ সাদা করে গন্ধরাজ ফুটত, সেজদাদু বড় বড় কাঁচের বাটিতে জল ছেটানো ফুলগুলো সাজিয়ে রাখত চারদিকে । তার গন্ধ ভাসত হাওয়ায়, আর সম্পূর্ন অন্যরকম এক মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ মুখে নিয়ে দাদু একগাদা নিমন্ত্রিতকে নিজে দাঁড়িয়ে খাওয়াত। এবং একদম পেট পুরে রাত্রির খাওয়া৷ তার আগে ওই হ্যাজাকের আলোয় তুমুল নাচ গান হইচই পাড়ার প্রত্যেকটি বাচ্চা মিলে, বড়রাও । ওইদিনটার জন্যে কতদিন ধরে যে অপেক্ষা করতাম ! এতো আনন্দময় পয়লা বৈশাখ আর আসেনি জীবনে ।
এই পর্ব শেষ করার আগে পুণ্যিপুকুরের গল্পটা মনে পড়ে গেল। পুণ্যিপুকুর নামটা কেমন মায়াময়, না? পুণ্য উচ্চারণেই কেমন শুদ্ধতা আসে ভেতরে! তো প্রাচীন যাদুঘরে চলে যাওয়া এই পুণ্যিপুকুর শব্দটা একটা ব্রতের নাম।
এক নতুন বছরের প্রথম সকালে মা ওই প্রাচীন একদা জমিদারবাড়ির দ্বিতীয় মহলে অধিষ্ঠান করা নারায়নের পুজো দিতে গিয়ে ওবাড়ির মেয়েদের পুণ্যিপুকুর ব্রত করতে দেখে বাড়ি ফেরে খুব দুশ্চিন্তা নিয়ে। তার আগে এসবের নামই শোনে নি মা , এখন শুনে ফেলে চিন্তায়। মেয়ে তো এসব কিছুই করছে না, না জানি তার কপালে কী দুঃখ লেখা আছে! কপালে ভাঁজ ফেলে আমাকে অনেকক্ষণ দেখে মা, মনে হয় কিছু মাপছিল! এরপর এরকম কথাবার্তা হয়।
‘ হ্যাঁ রে, তোরা যে একসংগে খেলিস, স্কুলে যাস একসংগে, কাজল রুণু বীথি কেয়ারা যে ওসব করে, জানিস না? ‘
আমার ‘না’ শুনে মা তার সব কাজের সংগীকে ধরে, ‘ হ্যাঁ গো দিদি, এটা করা ভালো? ‘
আমাদের গৃহসহায়িকাও তো একরকমের অভিভাবক তখন, সেই হরিপিসি, যাকে গীতার পিসি নামেই চিনত সবাই, সে তো একদম হামলে পড়ল , ‘ হ্যাঁ গো বউদিদি, খুব ভালো। আমিও বলব বলব করি, দাদার ভয়ে বলিনি, দাদা কী করতে দিবে? ‘
মা আবার চিন্তিত মুখে বলে, ‘ না সে দেবে না জানি। তাই বলে কী ওর ভালো হবে যাতে, সেটা করতে হবে না? এই তো আজ ওবাড়ির ছোটমা, বড়কাকিমা সবাই বলল, মিরুকে এটি করাও। বড় চঞ্চল মেয়ে তোমার কৃষ্ণা, শান্ত হবে একটু। তবে সুনীল কী শুনবে কারো কথা? ‘
আশ্চর্যের এই যে বাবা গ্রামের ছেলে,এসবের মধ্যে বড় হয়েও কোনো সংস্কারে বিশ্বাসী ছিল না। আর আমার শহুরে মা, যে গ্রামই দেখে নি আগে, বিয়ের পর ওই প্রাচীন জমিদারবাড়ির সমস্ত আদ্যিকালের রীতিনীতিতে আপাদমস্তক ডুবে গেছল। কে বলবে জন্মাবধি এসবের নামও শোনেনি কোনদিন!
দাদা সংক্ষেপে বলল ,যত্তো সব অষ্টাদশ শতাব্দীর ব্যাপার।
দাদা যা বলে মার সায় তাতেই, কিন্তু এবার দ্বিধায় পড়ল। আমাকেই ধরল, ‘ সবাই তো ভালই বলছে, তুইও কর বুঝলি ।’
আমাকে বেশি বলার দরকার ছিল না, ছোট থেকে সবরকম ফাঁকিবাজিতে আমার মহা উৎসাহ। আরো একটা কারণ, ব্রত করলে অনেকক্ষণ খেতে হবে না। ফুচকা আলুকাবলি ইত্যাদি ছাড়া অন্যসব খাওয়া চিরদিন একটা যন্ত্রণার ব্যাপার! উপোস টুপোস ভীষণ পছন্দ এই কারণেই। এই ভোরের পুণ্যিপুকুরে সেসব ছিল না যদিও। তবে ওবাড়ির পিসিরা কাম কাছাকাছি বয়সের বন্ধুরা মিলে হই হই করাও কী কম পুণ্যির?
বাবাকে লুকিয়ে আরম্ভ হল কাজটি। তুলসী মঞ্চ ঘিরে মাটির বেড়, তাতে সাদা কড়ি দিয়ে সাজানো। তুলসীর মাথায় সারা বৈশাখের প্রখর গরমে মাটির ভাঁড়ের ঠান্ডা বসুধারার জল, আর পাশে বেল ডাল পোঁতা থাকত, তাতে রোজ সকালে টাটকা ফুল গেঁথে সাজানো। সামনে বসে রোজ আতপচাল বাটা দিয়ে দশটি পুতুল এঁকে মাথায় দূর্বা হলুদ বাটা আর সিঁদুর দিয়ে বলতে হয়, পুণ্যিপুকুর পুষ্পমালা, কে পূজে রে সকালবেলা? এ পূজলে কী হয়……
এরপর.কী কী হয় তার লম্বা ফর্দ।
তারপরের কান্ড অবশ্য আরো ভয়ানক। একগোছা টাটকা দুর্বা ঘাস নিয়ে সদ্য মা হওয়া একটি গরুকে খাওয়ানো। আমাদের বাড়িতে তখন কাজ করত সুধা বলে ছেলেটি , সে গরুর শিং ধরে থাকে আর আমরা বিপুল ভয়ে ভয়ে দূর থেকে দিই । গরু যদিও আমাদের গ্রাহ্য করে না ,নরম কচি দুর্বাঘাসের দিকে দৃষ্টি তার ।
কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য সব জানাজানি হয়। বাবা খুব চেঁচামেচি করতে থাকে । কলকাতা থেকে আমার মাসিমণি এসে অবাক হয়, এসব কী হচ্ছে গো মেজদি?
বোধহয় চার বছরের বৈশাখী ব্রত ছিল এটা, শেষ হয়নি। সেই বৈশাখী ভোর, পুকুর থেকে অল্প ঠান্ডা হাওয়ার উঠে আসা, আর এ পূজলে কী হয়…… মাঝে মাঝে মনে পড়ে। কী জানি কী হত, আর কী হয়নি! শুধু সেই শান্ত ছায়ায় ঘেরা কৃষ্ণকলির দিনগুলি ঘুরে ঘুরে আসে … ঘুরে ফিরে আসে…