T3 || আমার উমা || বিশেষ সংখ্যায় পাপিয়া ভট্টাচার্য্য

চক্ষুদান

রাত্রি নটা থেকে সাড়ে ন’টার মধ্যে প্রায় নিয়ম করে আলো চলে যায় এখানে। পঞ্চমী থেকে জেনারেটার, অসুবিধে নেই। এখন বাড়ির সাতপুরনো হ্যাজাকটা ঝেড়েঝুড়ে নাটমন্দিরে নিয়ে গেছে সুখেন। আর ভিতরের বিশাল দালানে বড় একটি ল্যাম্পের আলোয়, যাতে দালানের একটা দিক পুরো ছায়া, সেখানে চৌকিতে বসে উমা কাল সকালে কী রান্না হবে আলোচনা করেছিল। আলু, পটল শুনেই শিউরে বলে উঠল, ‘নাম করোনি বউদি, পূজনকাকা খাবে, কাল মোটেও চলবে নি।’
বলে কেন চলবে নি তার ব্যাখাও দিয়েছে। ফিরতি রথের বাসি, শয়ন একাদশী। ঠাকুর গোবিন্দ নাকি শয়ন একাদশী থেকে উত্থান একাদশী অবধি পটল মাথায় দিয়ে কলমি শাকের বিছানায় শয়নে থাকেন, তাই দুর্গাপুজো অবধি পুরোহিতরা সাধারণত ওই দুটি বস্তু খান না। অন্যসময় গোবিন্দ তাহলে কিসে শয়ন করেন জিগ্যেস করতে গিয়েও চেপে গেল শ্রীময়ী।
রান্নার হাত দারুণ উমারানির, অনেক বছর ধরে বারোমাস ভোগ রাঁধে নারায়ণের । দেখে মনে হয় হাতাখুন্তির বাইরে ওর কোন জগত নেই। কিন্তু একবার মুখ খুললে আর রক্ষে থাকবে না ।
দুর্গাদালানে চারজন মানুষ, নিস্তব্ধ চারদিক। মাঝে মাঝে নিভু হয়ে আসা হ্যাজাকে জোরে দু’-চারবার দম দিয়ে দিচ্ছে সুখেন, শোঁ শোঁ শব্দ উঠছে। টুলে বসে বিষ্ণুপদ অসুরের মাথায় চুল পরাচ্ছে, তাকে দেখে হাসল।
‘দালানে এবার একটা পারমেন্ট আলোর ব্যবস্থা রাখতে বলুন বউদি। বয়স হচ্ছে, এই আলোয় রং করা ঝামেলি।’
বিষ্ণুপদরা চারপুরুষ ধরে প্রতিমা গড়ছে। এ বাড়ির সাড়ে তিনশো বছরের পুজো। গতবছর থেকে ওর ছেলে ও আসছে সঙ্গে। ভারী সুদর্শন আর লাজুক ছেলেটির মায়ের একেবারেই মত নেই এসব কাজে। লোকের বাড়ি ঘুরে দুর্গা লক্ষ্মী না বানিয়ে লেখাপড়া করে ছেলে আপিসে কাজ করবে, বলেই দিয়েছে মা। এদিকে কিশোর নামের ছেলেটির এখনই চমৎকার হাত প্রতিমা গড়ায়।
“আর বললে হবে বউদি? এ যে আমাদের পরম্পরা।’
একমেটে করে রাখা খড়ের কাঠামোয় চটকুচি মেশানো মাটি যত্ন করে মাখাতে মাখাতে এসব গল্প আগেরবারই তাকে করেছিল বিষ্ণু। দোমেটের কাজ চলছে তখন। বিসর্জন দেওয়া প্রতিমার কাঠামো নদী থেকে তোলা থাকে দালানে। রথের সময় বাড়ির

লোক এসে ঠাকুরের গায়ে মাটি ছোঁয়াবার পর পরই বিষ্ণু একমেটের কাজ সেরে রেখে
যায়। খড়কুচি দিয়ে মাখা মাটিতে নতুন করে কাঠামো বাঁধা।
বছরে চারদিনের বাপের বাড়ি সফর দুর্গামায়ের, কিন্তু দালান জুড়ে দাড়িয়ে থাকা কাঠামোয় বছরভর নিয়ম করে সন্ধ্যে দেখানো হয়। আর রথের সময় থেকে তো শুরু হয়ে
যায় উৎসব।
সেসময়ই বাথরুমে পড়ে পা ভেঙে শয্যাশায়ী শাশুড়িমা । নাহলে তিনিই এসময় মাস খানেকের জন্যে গ্রামের বাড়িতে এসে পুজোর কাজ এগিয়ে রাখেন। ঠাকুর গড়তে আসবে, তাদের থাকা খাওয়া, ঢাকি ঢুলি সানাই মাইক জেনারেটারের বায়নার টাকা, কাঠকয়লা ঘুঁটে, মুড়ি খই, আনন্দনাডুর চাল। তারপর ঠাকুরের বাসনকোসন বের করে মাজা ঘষা করিয়ে রাখা, ঘরে ঘরের বিছানাপত্র রোদ খাওয়ানো … কত যে খুঁটিনাটি প্রস্তুত পুজোবাড়ির। বদলি হিসেবে নিজেই উদ্যোগী হয়ে দেশে এসেছে শ্রীময়ী। তুমি জানো না কিছু, পারবে না করে যথেষ্ট বাধা দিয়েছিলেন অনুভা। সেও খুব পারব, কি আর এমন, সবাই আছে তো এখানে বলে জেদ করে এল।
কিন্তু চাপ আছে বেশ, এসে বুঝছে।
‘আগে আরও কড়া নিয়মকানুন ছিল সব, আমি কি আজকের লোক গো বউদি।’ মাটির সঙ্গে মিহি তুলো মিশিয়ে প্রতিমার আঙুলগুলি গড়তে গড়তে গল্প করছিল বিষ্ণু। এই তুলোমাটির আঙুল ইচ্ছেমত ঘুরিয়ে বাঁকিয়ে নানা মুদ্রা করা যায়। পায়ের আঙুল অবশ্য ছাঁচের। মায়ের মুখের এক ছাঁচ, আবার গণেশ ছাড়া ভাইবোনের মুখ একই ছাঁচে। এত কথার মধ্যে কিশোর একমনে হাতে এঁকে যাচ্ছে সিংহ আর গণেশের মুখ।
সেই দোমেটে প্রতিমায় রং পড়ছে এই জিতাষ্টমীর পর। জিতাষ্টমী থেকে মহাষ্টমী, মাঝে চোদ্দো দিন। ব্যস্ততা তুঙ্গে এখন।
খাবার জন্য আর একবার তাড়া দিল শ্রীময়ী। উমা আর কত জেগে থাকবে! রং তুলি রেখে আড়মোড়া ভাঙল বিষ্ণু। ‘তবে থাক রে বাপ, রেখে দে সব। কাল হলেই সারা আমাদের। তা বউদিদি কি চলে যাবে, না একেবারে পুজোর পর?’
‘না গো, আমিও যাব। মহালয়ার পর আবার…। কাল চোখ আঁকার সময় কিন্তু ডেকো আমাকে, আমি দেখব বিষ্ণুদা।’
সকাল সকাল উঠোনে কুশগাছের বোঝা নিয়ে বসেছে সুখেন। আসন হবে কুশের। কুশের মাথায় থোপা থোপা সাদা ফুল, লম্বা একটা শিস, সাদা ধপধপে।
‘এ কুশ কেন হবে সুখেন, কাশফুল তো।’
‘না গো মামি, ই কুশগাছই, বেঁটে বেঁটে। কাশগাছ তো লম্বা ৷’ ‘কক্ষনও এ কুশ না। কই চল তো দেখি কেমন কুশবন তোর।”
‘তুমি হাঁটতে পারবে নি, অনেক দূর।’ বলে কাটাচ্ছিল সুখেন, শ্রীময়ী শুনবে না।

‘ভুল হয়ে গেছে মালতীদি।’ কাঁচুমাঁচু মুখ করল শ্রীময়ী। ‘কাল গিয়ে আবার আসব মহালয়ার দিন, দেখা হবে। তুমি তোমার সুখ আর আলোকে নিয়ে ভালো থেকো সানোবট। মালতী হাঁ করে থাকে। এই শরীরে তার কিসের সুখ, আলোই বা কোথায়, মাথায় ঢুকছে না ।

80
আশ্বিনের ভরাট সবুজ ঢেউ খেলানো ধানজমির ধার দুধসাদা আলো হয়ে আছে। রঙের খেলায় প্রকৃতির কি পরিমিতিরোধ। ও হরি, কুশ কোথায় তোর! এ তো কাশফুলই রে!”
সুখেন মানবে না। ওর এক কথা, এ কুশই।
কাশগাছ অনেক লম্বা হয়। তা হবে, কত কি-ই তো জানে না শ্রীময়ী।
ফেরার পথে দুলেপাড়া, সুখেনের বাড়ি এখানে। ওকে একবছরেরটি নিয়ে ওর মা, দুলেপাড়ার সানো বউ, তাদের বাড়িতে কাজে ঢুকেছিল, একটানা পঁচিশ বছর। বাতের অসুখে এখন প্রায় পঙ্গু সে। শ্রীময়ী বলল, ‘তোর মাকে দেখে যাই চল সুখেন।’
সুখেনের মুখে অনিচ্ছা, প্রবল চিৎকার আসছে ওদের ঘর থেকে। ঘরের মুখে ওকে ছেড়ে দিয়ে পালাল সুখেন। মা বউতে লেগেছে, এখন সামনে পড়লে গাল পাড়বে মা, বউও ছেড়ে কথা বলবে নি। পাড়ার মেয়ের সঙ্গে প্রেমের বিয়ে, সে ই বা কাকে কী বলে ! ভিতরে ধুন্ধুমার চলছে। সানো বউ চেঁচাচ্ছে, ‘মুয়ে পোক্কা পড়ুক তোর কালিন্দী, সব্বোনাশ হোক, ওলাউঠা হয়ে মর।’
ঝ্যাঁটা হাতে বউও সমানতালে, ‘যা যা বললি সব তোর হোক বুড়ি। গুয়ে মুতে পড়ে থাকবি, কে জল দেয় মুয়ে দেকব আমিও। শ্যাল কুকুরে তোর….।’ ঘরে ঢোকার সাহস পায়নি সুখেন। তাকে দেখে ঝ্যাঁটা মাটিতে ফেলে ঘোমটা টেনে একগাল হাসে সিমি বউ, ‘হাই গো মামি যে। ও মা, দেকো কে এসছে!”
লম্বা দোহারা চেহারা, সরু কোমর, মাজা গায়ের রং আর তীক্ষ্ম কাটা কাটা মুখ, মাথায় উঁচু করে বাঁধা থাকত বিশাল খোঁপা। চোখে পড়ার মতো রূপ ছিল সানো বউ মালতীর ৷ বিয়ের পর এখানে এসে শ্রীময়ী মুগ্ধ হয়ে দেখত ওকে। মুখে আর কাজে দুয়েই তেমনি খরখরি ছিল মালতী। এই বউকে ফেলে অন্য গ্রামে দ্বিতীয় সংসার পেতেছিল ওর বর, তার আগে সুখেনকে দিয়ে গেছে পেটে। তাদের বাড়ির কাজ করে ছেলেকে বড় করেছে মালতী, সারা বছর ও বাড়ির সব দায়িত্ব ছিল সানো বউয়ের হাতে। নানা উৎপাত থেকে বাঁচতে শিয়কে কাঠারি আর মুড়ো ঝ্যাঁটা রাখত। আর একটা অস্ত্র ছিল গলার স্বর।
এখনও আছে গলাখানা, কিন্তু কী রোগে ধরল, হাত পা ফুলে ঢোল। সুখেন বলে টোক হয়েছিল। মাসিক একটা টাকা সানো বউকে দেওয়া হয় এখনও। তাই নিয়ে তেজেই আছে মালতী।
‘শরীর ভালো নয়, অত চিৎকার কোরো না মালতী দি।’
‘তো কী করি বউদি, অই হারামজাদি একটা কথাও শুনে নি। বলছি একবার আমাকে নিয়ে চল দালানে, চক্ষুদান হলে মাকে ঢাকা দিয়ে দেবে। আর দেখতে পাব নি। পুজো পর্যন্ত বাঁচি কি না বাঁচি… লাই দিয়ে বউকে সুখো মাথায় তুলছে গো।’ হাঁফাতে হাঁফাতে বলল মালতী।
হ্যাঁ তোমার ছেলে কত্তো দেখে আমাকে।’ মুখ বেঁকিয়ে বলল সিমি। সুখেনের নামে তার কালো মুখে ঝিলিক খেলে যায়, ভারী ভালো লাগে শ্রীময়ীর। ‘দেখো না মামি, রুগির

৪৬
কান্না, ঘরের এত কাজ, বলছি এগুলান সারি । না শুধু দালান যাব, আর দালান যাব। পরে বললে শুনবে নি গো। সমানে বাখান করে যাচ্ছে। মাথার ঠিক থাকে। সে একগ্লাস জল নিয়ে ধরল শ্বাশুড়ির মুখে, মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘আর চিল্লিও নি, ঠান্ডা হয়ে বসো।
কাজ সেরে লিয়ে যাব।’
শেষ দুপুরে দালানের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে বিষ্ণু, বাচ্চাগুলো বড় হুটোপাটি করে ঢুকে পড়ে। অন্যসময় ঠিক আছে। এখন চোখ আঁকা হবে। জগতের সমস্ত কোমলতা আর একই সঙ্গে তীব্র আত্মশক্তিতে মোড়া একই দৃষ্টিতে মায়া আশ্বাস, শক্তি, বরাভয় সবা মেশামেশি হয়ে থাকবে। শ্রীময়ীকে স্তম্ভিত করে বিষ্ণু কিশোরের হাতে তুলি দিল। ভয়ে ভয়ে সে তাকাল বিষ্ণুর দিকে। পারবে?
হাতে আশ্বাস ফুটিয়ে হাসল, বিষ্ণু, ফিসফিস করে বলল, ‘পারবে। পরম্পরা বলেছি না। শ্রীময়ী নিজের চোখ বন্ধ করে ফেলল। সপ্তমীর ভোরে নদী থেকে ঘট তুলে ফেরল ফিরছে তারা। কুশাসনের ওপর দাঁড়ালেন পুজনকাকা, সরু লম্বা বেলডালের ডগা একে একে স্পর্শ করছে ত্রিনেত্র। এই তো দক্ষিণ নেত্রে, ওম চিত্রম দেবানাম উদগত অনিকাম চক্ষুর মিত্রস্য বরুণস্য….
গায়ে কাঁটা দিল শ্রীময়ীর। সে তো কোনদিনই মন্ত্রে বিশ্বাসী নয়, অথচ এই মুহুর্তে মনে
পড়ল কেন!
দালানের নিচে সিমিবউ ধরে ধরে সিঁড়িতে বসিয়ে দিল সানোবউকে। দরজা খোলা, সাদা কাপড়ে ঢাকা মায়ের মুখ। খোলা হবে সেই পঞ্চমীর বেলবরণের সময়। তা হোক, ভক্তিভরে প্রণাম করল মালতী। পরের বছর একটা খোকাখুকি দিও গো মা আমার বউমার কোলে।
সিমি বলল, ‘মামি, মা বলল, পেতলের ধুনুচিগুলো চিলেকোঠা থেকে বার করে রেখে যেও। আমি মেজে রাখবখন।’
এই রে, শ্রীময়ী তো ভুলেই গেছল, শ্বাশুড়ি মা বারবার বলে দিয়েছিলেন ধুনুচির কথা ৷ মেজে ঝকঝকে করে কাপড়ের পাড় জড়িয়ে রাখা হয়। না হলে ধুনো দেবার সময় পেতলের হাতা বড় তেতে থাকে। নড়বড়ে শরীর নিয়েও মালতী মন রেখেছে সব। সানোবউ আসলে পুজোবাড়ি ছেড়ে যায়নি কোথাও ৷
অতনু টাকা মেটাচ্ছে। বাহার আলির, বিষ্ণুর, ঢাকিদের। পুজোবাড়ির পুঁই কুমড়ো কচুর জোগানদার বাহার। কাজ সেরে সবাইকে সপরিবার নেমন্তন্ন করল করজোড়ে। ‘বুঝিয়া পাইলাম’ লেখা কাগজের নিচে সই করেছে বিষ্ণু। বিষ্ণুপদ দপণ্ডট। কিশোর দণ্ডপাট মুচকি হাসছে তাই দেখে। বানানটা আর ঠিক করা গেল না বাবার।
শ্রীময়ী বলল, ‘কালো হোক, তোমার বউয়ের মুখখানি বেশ, দিনরাত কালিন্দী ডাকা সানো বউ বলল, ‘কালো বলতে নেই বউদি। কালো জগতের আলো, তোমার শাউড়ি বলে। বড় ভালো মেয়ে, শুনলে মনে দুক্ষু পাবে।’

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।