T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় প্রকল্প ভট্টাচার্য
by
·
Published
· Updated
ঠাকুর
যখন আমার কিছু ভাল্লাগেনা, তখন কিচ্ছুই ভাল্লাগেনা।
এই যেমন এখন। টেবিলে গড়াগড়ি যাচ্ছে ছবির বই, ভিডিও গেম, আধখাওয়া ডেয়ারি মিল্ক চকোলেট, আরো কীসব কীসব। সমস্তই আমার পছন্দের হওয়া উচিৎ ছিল। শুধু তাইই নয়, আজ মা রান্নাঘরে আমার ফেভারিট ফ্রায়েড রাইস রাঁধছে গন্ধ পাচ্ছি। বাইরে ঝকঝকে রোদ্দুর। বোগেন, ঢেঁকি, রংতা সবাই চুটিয়ে ক্রিকেট খেলছে ঠিক আমার জানলার নিচেই। আমায় দু’বার ডেকেও গেছে, যাইনি। কারণটা ঐ বললাম যে, আমার এখন কিচ্ছু ভাল্লাগছেনা।
বাবা বলে, মন খারাপ হলে ভেবেচিন্তে তার কারণটা বার করতে হয়, তাহলে মন ভালো হয়ে যায়। আমি কিন্তু তবুও কারণটা নিয়ে ভাবছিনা, কেননা কারণটা আমি জানি। সকালে অনলাইন ক্লাশে মিস বলেছে অ্যাসাইনমেন্টে রাউনকের লেখা বাংলা রচনাটা সবথেকে ভালো হয়েছে। আমারটা নাকি নেক্সট। রাউনক!! ও তো বাংলাই জানেনা ঠিকমতো, নিজের নাম রৌনক কে বলে রাউনক, আর বাংলাকে বেঙ্গলি বলে! রচনাকে বলে এসে। সে কী করে লিখবে এত ভালো!! নির্ঘাত অন্য কারোকে দিয়ে লিখিয়েছে।
ক্লাসের পর মা-কে বললতেই মা হেসে বলল, “তুমি নিশ্চয়ই ওর মতো ভালো লিখতে পারোনি, তাই মিস ওরটা বেশী ভালো বলেছেন। না জেনে কেন বলছ যে রৌনক নিজে ওটা লেখেনি? যদি পারো তুমি আরো ভালো লিখে দেখাও!”
এটা শোনার পর থেকেই আমার মেজাজটা বিগড়ে গেছে, আর সব খেলাধুলো ছেড়ে আমি খাতা খুলে বসেছি সবথেকে ভালো একটা রচনা লিখব বলে।
কিন্তু, কী নিয়ে লেখা যায়!!
———————————
এই কথাটাও বাবা ঠিকই বলে, যে মনখারাপ থাকলে ভাবনাচিন্তা গোছানো যায় না। এই যে লিখব বলে সকাল থেকে খাতা খুলে বসে আছি, একটা জম্পেস বিষয়ও কি মাথায় এল? না। কেননা, এখন আমার মনখারাপ। কী নিয়ে রচনা লিখব ছাই সেটাই এখনো ঠিক করতে পারলাম না, তাহলে আর লেখা হবে কী করে! আর লেখা না হলে মনের মুষড়নোটাই বা সারে কেমন করে!
এই করেই বেলা গড়ালো, স্নান হলো, খাওয়া হলো, ফ্রায়েড রাইস অতি বিস্বাদ ঠেকলো মুখে।
মা বলল, “সকাল থেকে সেই রচনা নিয়ে বসে আছিস, খেলিও না ঠিক করে!”
-“আমার কিচ্ছু ভাল লাগছেনা মা!”
-“চিন্তা করিস্না। ঠাকুরকে ডাক, দেখবি ঠিক মাথায় একটা ভাবনা এসে যাবে।”
– “কোন ঠাকুরকে ডাকব মা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর?”
মা হেসে বলল, “হ্যাঁ, সেই ভালো। উনিই হলেন আসল ঠাকুর। লেখালেখির সব সমস্যা উনিই সামলে দেবেন!”
খাওয়ার পর মা গেল ঘুমোতে, আমি আবার বসলাম খাতা খুলে। দুপুরে শব্দসাড়া কমে যায়, যদি তখন একটু কিছু লেখার আইডিয়া আসে!
ভাবতে ভাবতে খুট খুট আওয়াজ। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি একজন লোক আমার দিকে পিছন করে দাঁড়িয়ে সামনের মাঠের দিকে কী যেন দেখছে। চোর টোর নয়তো? নাঃ, চোর হলে কি এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতো নাকি! কিন্তু কে লোকটা? ডাকলাম, “এই যে শুনছেন? আপনি কি কারোকে খুঁজছেন?” আমার গলা শুনে লোকটা আস্তে আস্তে ঘুরে তাকালো। খুব মায়াবী ওর চোখদুটো, কেমন যেন স্বপ্ন দেখছে! মিহিগলায় বলল, “খুঁজছি! হ্যাঁ তা বলতে পারো। কী যে খোঁজা যায়, সেটাই খুঁজছি!”
-“সে আবার কী! যেটা খোঁজা যায় সেটা পেয়ে গেলে তো আর সেটা খোঁজার দরকারই হবে না!”
লোকটা চোখ গোল্গোল করে বলল, “ও মা, তুমি তো খুব বুদ্ধিমান! কেমন করে জানলে? এ কথাটা তো আমার মাথায় আসেনি!”
চোরই হোক বা অচেনা কেউ, ‘বুদ্ধিমান’ বললে কার না ভালো লাগে! আমারও লাগলো। বললাম, “আমি জানি, কারণ আমিও সকাল থেকে একটা জুতসই রচনা লেখার বিষয় খুঁজছি!”
লোকটা জানলার কাছে এগিয়ে এল। বলল, “রচনা? তা চারপাশে যা দেখছ, তা নিয়ে লিখলেই তো পারো!”
= “যেমন?”
– “যেমন, এই মাঠটা! ঐ দূরের পাহাড়টা! তোমার বন্ধুরা!”
– “যাঃ, এসব নিয়ে লেখা যায় না কি!! মিস কেটে দেবে তো! রচনা লিখতে হয় নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে, যেমন তোমার প্রিয় কবি, বা ঋতুবৈচিত্র, বা বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ, বা…”
লোকটা হাসলো না, কিন্তু তার চোখদুটো চিকমিক করে উঠলো। বলল, “কিন্তু যে রচনা বইতে লেখা আছে, তুমি সেই বিষয়গুলো নিয়েই লিখলে তার থেকে ভালো লিখবে কী করে! সবাই তো ঐ বইয়ের সঙ্গেই তার তুলনা করবে!”
– “হ্যাঁ, আমিও তো এইজন্যেই…”
– “নতুন কিছু লেখ। যেমন, সময়ের গাড়ি। গড়গড় করে এগিয়েই চলেছে। থামার তো প্রশ্নই নেই, এক মুহুর্ত জিরেনও নেয় না। যে উঠবে ওঠো, যে নামবে নামো। গাড়ি চলেই যাচ্ছে।”
– “সময়ের গাড়ি! কে উদ্ভাবন করেছেন, জেমস ওয়াটেরও আগে?”
-“অনেক অনেক আগে। সময়ের আগে কিছু সৃষ্টিই হয়নি!”
– “কিন্তু এমনি এমনি কি কোনো গাড়ি তৈরি হয়!”
– “হয়েছে তো! যেমন দেখ, তুমি ঐ গাড়িতে চড়ে বসেছ, আমিও। শুধু তোমার আর আমার কামরা আলাদা। এই জানলাটা দিয়ে তোমায় দেখতে পাচ্ছি, কথা বলতে পারছি, কিন্তু তোমায় ছুঁতে পারবনা। আমরা দুজন এক জায়গায় থাকলেও, এক সময়ে নেই যে!”
আমার কেমন সব গুলিয়ে গেল। বললাম, “আপনি কে বলুন তো? আপনার কথাগুলো কেমন যেন অদ্ভুত, কিন্তু বেশ লাগছে শুনতে!”
লোকটা মুচকি হেসে বলল, “আমার নাম রবি।”
– “রবি? মানে, রবীন্দ্রনাথ?”
– “ঠিক!”
-“ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি!”
– “একদম ঠিক! তুমি আমাকে চেন?”
-“ আমি অন্য একজনকে চিনি এই নামে। তিনি কবিতা, গান লিখতেন।”
-“ হ্যাঁ, আমিও গান, কবিতা, গল্প, নাটক লিখি।”
-“কিন্তু তার ছবিতে দেখেছি মুখভর্তি দাড়ি, কই আপনার তো দাড়ি নেই!”
এ কথা শুনে লোকটা হা-হা করে হেসে উঠলো। তারপর ঠিক বাবার মতো গলায় বলে উঠলো, “ ইন্টার স্কুল এসে রাইটিং কম্পিটিশনে তুই ফার্স্ট হয়েছিস রে! এই দ্যাখ, তোর প্রাইজ!!”
————————————–
চমকে তাকিয়ে দেখি, ঘরে বাবা আর মা দাঁড়িয়ে, দুজনেরই মুখ খুব খুশী খুশী। বাবা আবার বলল, “দারুণ রচনা লিখেছিলি নাকি! অফিস থেকে ফেরার সময় তোদের প্রিন্সিপাল ফোন করে ডেকে পাঠালেন, আর তোর প্রাইজটা আমার হাতে দিলেন। এই দ্যাখ!!”
বইয়ের মলাটটা দেখে চমকে উঠলাম, “বাবা, ইনি কে!”
– “ইনিও রবীন্দ্রনাথ। দাড়ি ছাড়া ছবি দেখিসনি তো, তাই চিনতে পারছিস না। আসলে..”
আমার কানে আর কিছু ঢুকছিল না। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি লোকটা নেই। অবিকল এই ছবিটার মতোই দেখতে, সেও রবীন্দ্রনাথই তো বলল নামটা! সেই তাহলে ঠাকুর!! আমার প্রার্থনা শুনে এসেছিল!! তাকে তো দেখাতাই হবে বইগুলো, কিন্তু কোথায় যে চলে গেল!
না বোধহয় কোথাও যায়নি, এখানেই আছে, শুধু আমিই দেখতে পাচ্ছি না। সময়ের গাড়িতে অন্য কামরায় যে!!