T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় পিনাকী বসু
by
·
Published
· Updated
আমার শেষ পারানির কড়ি
দিনটা ছিল পঁচিশে বৈশাখ | কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন | কাকতালীয় হলেও অসম্ভব তো কিছু নয়| আমার মতো আজন্মের রবীন্দ্রভক্তের পক্ষে তো নয়ই | বিশেষ করে দোতলার যে ঘরটায় আমি থাকতাম সেটা দেখলে যে কেউই আমার সাথে একমত হবেন | রবীন্দ্রনাথের লেখা সবকটা প্রকাশিত বই কিংবা রবীন্দ্রনাথের ওপর লেখা যত বই, প্রায় প্রায় সবই আমার সংগ্রহে ,এখনো রাখা আছে | কাঠের বাস্কে সযত্নে রাখা আছে আমার সাধের হারমোনিয়ামটাও |তাই আজকের দিনে আমার বাড়িতে যে রবীন্দ্রসংগীত বাজাবে এতে আর আশ্চর্য হবার কি আছে | এই মুহূর্তে যে গানটা শুনতে পাচ্ছি সেটা হলো ,” আছে দুঃখ ,আছে মৃত্যু বিরহ দহন লাগে ,তবুও শান্তি তবু আনন্দ তবু অনন্ত জাগে …” |মিশ্র যোগীয়া ললিত -একতালের গান | অপূর্ব , মনটা যেন জুড়িয়ে গেলো |
সামনে ঝুল বারান্দা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে মনে হলো একতলায় এতক্ষনে অনেক লোক এসে গেছে | তাদের বিভিন্ন রকম শ্রদ্ধা আর সহমর্মিতার কথাবার্তাও কানে আসতে লাগলো | সিঁড়ি বেয়ে নিঃশব্দে একতলায় নেমে এলাম | আমার ছোট ছেলে আর দুই বৌমা সবাইকে আপ্যায়ন করছে | বাড়ির সামনের অংশটা সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা হয়েছে |যার ওপর গোল গোল সাদা পদ্মের রিং লাগানো হয়েছে | বসার ঘরের লাগোয়া গ্যারাজটায় অথিতিদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা হয়েছে |বেশ একটা জমকালো ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছে বটে |
নাহ এখানে দাঁড়িয়ে লাভ নেই | আমি ঘুরে ঘুরে চারদিকটা সরেজমিনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম| শ্রাদ্ধের কাজ কর্ম হচ্ছে ষ্টোর রুমে | ঠাকুরমশায়কে মূল্য ধরে দেয়া হয়েছিল | তিনি নিজেই তার বাড়ির থেকে প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র নিয়ে এসেছেন | এমনকি বিছানা ,বালিশ, শতরঞ্চি , মশারি ,মায় বাসনকোসন পর্যন্ত | ঘরময় নানারকম নৈবেদ্য সাজানো | উত্তরমুখ করে শতরঞ্চির ওপর আমার একটা ফটো রাখা | গলায় রজনীগন্ধার মালা | সামনে কয়েকটা ধুপ জ্বলছে | একপাশে বসে পুরোহিত ব্যস্ত মন্ত্রোচ্চারণে | আর তার এক সহকারী ব্যস্ত গীতা পাঠে |তাদের সামনে আমার বড়ছেলে একটা কম্বলের আসনে বসে ,পুরোহিতের কথামতো কাজ করে চলেছে |
যেখানে আমার ছবিটা রাখা, সেই রাত্রেও আমি ঠিক ওই জায়গাটাতেই শুয়ে ছিলাম | হঠাৎ বুকটা কেমন ব্যাথা ব্যাথা করতে লাগলো | ক্রমশ ব্যাথাটা বাড়তে বাড়তে অসহনীয় হয়ে উঠলো | আমি দর দর করে ঘামতে লাগলাম | কাউকে যে ডাকবো সে উপায় তো নেই | আমার আওয়াজ এখান থেকে কেউ শুনতেও পাবে না | একটু জল পেলে ভালো হতো | গলা আর জিভটা কেমন শুকিয়ে আসছিলো | নিজে উঠে যে একটু জল খাবো সে ক্ষমতাও তো আর নেই | আস্তে আস্তে সমস্ত শক্তি যেন ক্ষীণ হয়ে এলো | সব কিছু ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো |এইভাবে অনেক্ষন কষ্ট পেতে পেতে এক সময়ে হাল ছেড়ে দিলাম |একটু একটু করে সব আলোগুলো যেন নিজের থেকেই নিভে যেতে লাগলো | সব কিরকম অন্ধকার হয়ে এলো | এ অন্ধকার আমার বড় অচেনা |
আসলে আমি তো সেদিনই মরে গেছিলাম যেদিন আমার দুই ছেলে মিলে আমায় পরম অশ্রদ্ধায় কোনো এক অপাংক্তেয়র মতো ,আমারই সাধের বাড়ির একতলার এক কোণায় এই ছোট্ট স্টোররুমটায় আমায় শুইয়ে দিয়ে গিয়েছিলো | আমার আনুষ্ঠানিক মৃত্যু তো মাত্র বারো দিন আগে হলো |
আমি ধীর পায়ে আমার ছবিটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম | তারপর বিড় বিড় করে, কেউ শুনবে না জেনেও , নিজের মনেই আবৃত্তি করতে লাগলাম ,” যাবার সময় হলো বিহঙ্গের / এখনই কুলায় রিক্ত হবে / স্তব্ধগীতি ভ্রষ্টনীড় পড়িবে ধুলায় /প্রশাখার আন্দোলনে /শুষ্কপত্র জীর্ণ পুষ্পসাথে পথচিহ্নহীন শূন্যে উড়ে যাবো রজনী প্রভাতে ,অস্তসিন্ধু পরপারে /কতকাল এই বসুন্ধরা আতিথ্য দিয়েছে /কভু আম্রমুকুলের গন্ধে ভরা পেয়েছি আহ্বানবাণী /ফাল্গুনের দাখ্যিন্যে মধুর /অশোকের মঞ্জরী সে ইঙ্গিতে চেয়েছে মোর সুর /দিয়েছি তা প্রীতিরসে ভরি /কখনো বা ঝঞ্ঝাঘাতে বৈশাখের /কণ্ঠ মোর রুধিয়াছে উত্তপ্ত ধূলাতে / পক্ষ মোর করেছে অক্ষম /সব নিয়ে ধন্য আমি প্রাণের সম্মানে /এ পারের ক্লান্ত যাত্রা গেলে থামি /ক্ষণতরে পশ্চাতে ফিরিয়া /মোর নম্র নমস্কারে /বন্দনা করিয়া যাব এ জন্মের অধিদেবতারে |”