দোল পূর্ণিমার তখনও দেরি বেশ কিছুদিন , সন্ধ্যের মুখে এই সরু এক চিলতে চাঁদ সবে উঠতে শুরু করেছে, দেখতে না দেখতেই মিলিয়ে যাবে, সেই সময় থেকেই শুরু হয়ে যেত খুব সামান্য আয়োজনে আমাদের অসামান্য উৎসবের প্রস্তুতি । আর পূর্ণিমার চাঁদটা যখন পূর্ণ গোল হয়ে উঠতে আর একটিমাত্র রাত বাকি , ভোর হতে না হতে আমাদের বসন্তোৎসব দোরগোড়ায় হাজির । আমরা ভোর ভোর ঘুম চোখে বাড়ির সামনের মাঠে হাজির সবাই । সেখানে শুকনো তালপাতার স্তূপ আর লম্বা বাঁশ । বিভিন্ন জেলায় এই অনুষ্ঠানের বিভিন্ন নাম । কোথাও ন্যাড়াপোড়া …কোথাও বুড়ীর ঘর । আমাদের মেদিনীপুরের এই অঞ্চলে এই রাতটা চাঁচর উৎসবের । গ্রামের প্রত্যেক বাড়ির কাছাকছি জায়গায় দীর্ঘকায় যে বাঁশটি মাটিতে পোঁতার আগে সাজানো হত অজস্র তালপাতা আর ফুলঝুরি দিয়ে , সেই পাতা সংগ্রহ করাই ছিল আমাদের উৎসবের উৎসমুখ ।
এ ব্যাপারে সক্রিয় উদ্যোগ ছিল আমার বোনের । আমাদের কোথায় কটি তালবাগান আর বাঁশঝাড় আছে , সব খবর রাখত সে । বাড়ির কাজে সাহায্যকারী ছেলেদুটিকে নিয়ে সব ব্যবস্থাপনা মূলতঃ তার । সকাল থেকে শুকনো পাতাগুলিকে সাজিয়ে গুছিয়ে তোলা হত । করত সব ওরাই , আমাদের কাজ ছিল স্নান খাওয়া ভুলে মহা ব্যস্ত হয়ে মূলত চেঁচামেচি আর লাফালাফি করা । সৌন্দর্য বাড়াতে মাঝে মাঝে লাগিয়ে দেওয়া হত ফুলঝুরি। অনেকে অনেকরকম বাজিও লাগাত, আগুন ধূ ধূ করে যত ওপরে উঠত, কালিপটকা গুলো ফটাফট শব্দে ফাটত। কিন্তু আমাদের বাড়িতে কোন শব্দবাজি চলত না। বাবা একেবারেই পছন্দ করত না, শুধু তুবড়ি আর রংমশাল। বাবা নিজে মশলা মেখে তুবড়ি বানাত। আমাদের স্কুলে এই উপলক্ষে ছুটি পড়ে যেত দুদিন।
সকাল থেকে আমার প্রধান কাজ ছিল সর্বক্ষণের সঙ্গী সাইকেলটিকে নিয়ে বোঁ বোঁ চক্কর মেরে এপাড়া ওপাড়া ঘুরে কাদের চাঁচর কত বড় হল দেখে আসা, আর সেই অনুযায়ী বাড়ানো হত আমাদের বাঁশের উচ্চতা ।
এইভাবে পনেরো কুড়ি দিনের প্রস্তুতি শেষে আজ দুপুর থেকেই সাজো সাজো রব । গোটা গ্রাম প্রস্তুত , প্রস্তুত নাটমন্দিরে ফুলে সাজানো বুড়িমার দোলাটিও । মন্দিরে বিদ্যুৎ ছিল না তখন ,পাম্প দেওয়া হ্যাজাকের আলো মন্দির ছাড়িয়ে যতদূর যায় , তা ছাড়িয়েও অনেকদূর অবধি ছোটদের হুটোপাটি চলত যতক্ষণ না বুড়িমার সাজানো দোলা বাইরে বেরোত।
সন্ধ্যের মুখে বিশাল একটা লাল চাঁদ উঠত, কালকের জন্যে একটুখানি, খুব সামান্য একটুখানি বাকি রেখে প্রায় গোল হয়ে এসেছে সে। আমি প্রতিবার ভাবতাম দোল পূর্নিমার আর কোজাগরীর চাঁদ সারাবছরের পূর্ণিমাগুলো থেকে এত আলাদা, এত ঘোরলাগানো মায়াময় কেন!
সন্ধ্যারতির পর সেই ফুলে ছাওয়া দোলায় চড়ে বছরে এই একদিনই বুড়িমা মন্দির ছেড়ে বেরোয় গ্রাম প্রদক্ষিণ করতে , পেছনে নাম সংকীর্তনের দল । তাঁর যাত্রাপথের শুরু হত আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে ,এখনও হয় । দোলা মন্দির ছেড়ে বেরোলেই সে কি উত্তেজনা !
আমার শান্ত আর রামভীতু দাদা , যে কিনা পরে প্রশাসনের দাপুটে হোমরাচোমরা প্রশাসক হবে , সে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে চেঁচাত , আরে তাড়াতাড়ি জ্বেলে দে না রে ,এসে গেল যে !
দোলা এসে দাঁড়াত , লালপাড় গরদ পরা মা জল ঢেলে দিত দোলার নিচে আর তখন তালপাতার স্তুপে লাগানো আগুনের শিখা দীর্ঘ দন্ড বেয়ে লকলকিয়ে উঠে যেত আকাশের দিকে । এরপর একের পর এক চাঁচর জ্বলে উঠে পুরো গ্রামের আকাশটাই ভরে যেত আলোয় , চাঁদটকে আর দেখাই যেত না । অসংখ্য শাঁখ বাজত চর্তুদিকে । অদ্ভূত অনুভূতি হত একটা । আগুনের পরশমণি ছুঁয়ে যেত কিনা কে জানে !
ততক্ষণে সেই কোন এক গ্রাম থেকে গোঁসাইজ্যেঠু এসে গেছেন আমাদের বাড়ি । কাল চব্বিশ প্রহর শুরু , এই কদিন থাকা খাওয়া আমাদের বাড়িতেই , এরকম অনেক মানুষ নানা উপলক্ষে থেকে যেত আমাদের বাড়িতে । আগুন নিভে এলে হঠাৎ সব কেমন বিষণ্ণ হয়ে যেত, আবার একবছরের অপেক্ষা! শুধু ছাইয়ের স্তূপ আকাশ ধুয়ে দিত দুধে আলতা রঙের জ্যোৎস্না দিয়ে । বারান্দায় বসে গোঁসাইজ্যেঠুর সংগে লুচি তরকারি খেতে খেতে গল্প শুনতাম । মা একটা একটা করে গরম লুচি জোর করে পাতে দিয়ে বলত , ‘আর দুটো নিন দাদা ,কাল খেতে কত বেলা হবে ।’ জ্যেঠু সজল চোখে বলতেন , ‘ কতদিন পরে ভালো মন্দ খেলাম মা ।’
অবস্থা ভালো ছিল না জ্যেঠুর , পুজো আচ্চা ছাড়া সকালে বাচ্চাদের পড়াতেন শুনেছি ,তা থেকে কতটুকুই বা আয় ,কিন্তু সদাপ্রসন্ন মুখ আর মজার মজার গল্প ছিল তাঁর ঝুলিতে। এমন বসন্তদিনে নিজেও একটু রঙ মেখে আসে বলেই যে দোল পূর্ণিমার চাঁদ অত লাল হয় , জ্যেঠুই বুঝিয়েছিলেন আমাদের ।
রাত বাড়তো , শুয়ে শুয়ে ঢাকের শব্দ থেকে অনুমান করতাম দোলা এখন বিশাল গ্রামের কোন পথে ! প্রতিবার জেগে থাকার চেষ্টা করেছি দোলা ফিরে আসা দেখব বলে , সে আর হয়নি কোনদিন । ভোর ভোর ঘুম ভেঙ্গে যেত সেদিন গোঁসাই হ্যেঠুর গীতাপাঠের সুরে । উঠোনের তুলসীমঞ্চের সামনে কম্বল আসনে বসে গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় পাঠ করে শোনাতেন আমার ঠাকুমাকে , একটু পরেই চলে যাবেন চব্বিশ প্রহরের মণ্ডপে । আমরাও আজ বেশি গোলমাল না করে চুপচাপ তৈরি হয়ে নিতাম ।
সাঁতার শেখার জন্য ছাড়া বছরে এই একটামাত্র দিনই অনুমতি ছিল পুকুরে স্নানে নামার । দোলের দিন । প্রতিটা মুহূর্তে দিনটাকে প্রায় শুষে নিতাম । ছুটিতে পাড়ার সব ছেলেমেয়ে তখন বাড়িতে । বেশ বড়সড় একটি দল ছিল আমাদের।ছেলে মেয়ে বলে আলাদা কিছু ছিল না ,স্নান করতে নামতামও একসংগে, এখন ভাবলে অবাক লাগে । তাদেরই মধ্যে যে ছেলেটি জলের তলায় ডুব সাঁতার দিয়ে নির্ভুলভাবে আমার পা ধরে টেনে নিত জলের ভেতর , আমি ছটফট করে হাঁফিয়ে উঠলে ছেড়ে দিত , সে ছিল পাড়ার সবচেয়ে ভালো ছেলের তকমায়। আর কে জানে কেন , এ নিয়ে আমিও কোন অভিযোগ করিনি কখনও , যেন দোলের দিন আমরা একসংগে জলে নামব আর সে খুঁজে নেবে আমার পা , এটাই বহুদিন ধরে স্বাভাবিক ছিল । এসব নিরুচ্চার প্রেম সেসময়ে খুব ঘটত ,যার কোন পরিণতি হয় না ।
প্রায় ঘন্টা দুই ধরে বিশাল রামসাগর দীঘির জল তোলপাড় করে সাঁতার কেটে , বাজি রেখে এপার ওপার করে যখন দেখতাম ঘাটের মাথায় থমথমে রাগী মুখে বাবা এসে দাঁড়িয়েছে , তখন অনিচ্ছুক ভঙ্গিতে উঠতেই হত জলে ভেজা লাল টকটকে চোখ নিয়ে ! আর বাবা প্রতিবার শাসাত ,এই শেষবার ….আর কোনদিন যদি এর ধারে পাশে দেখি…. ! কিন্তু আমরা জানতাম , বাবাও জানত..এসব ফাঁকা আওয়াজ ! পরেরবার যথারীতি ….।
আমাদের দোলের বিশেষ একটা সাজ ছিল । সিনেমায় যেমন ধবধবে সাদা জামাকাপড় পরে রঙ মাখামাখি করতে দেখি , আমাদের জন্যে ছিল ঠিক উলটো । সাতপুরোনো প্রায় রঙচটা জামাটি মা গুছিয়ে রাখত এদিনের জন্যে , তাতে অবশ্য আমাদের আনন্দের কোন কমতি হত না । মহানন্দে বেরিয়ে পড়ে প্রথমে বালতিতে রঙ গুলে পিচকারি নিয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়াতাম । এই রঙ গোলার ব্যাপারটা ছিল আমার সবেতেই উতসাহী বাবার ডিপার্টমেন্টে । ‘ ঠান্ডার ধাত, টনসিলে ব্যথা হবে’ মায়ের সাবধানবাণী অগ্রাহ্য করে গুলে দিত বৃহৎ বালতি ভর্তি রঙ , তারপর যত বেলা বাড়ত , লাল নীল হনুমান কালি তেলকালি কোন বিচার থাকত না । মাখাতে এলে ভয়ে যে দৌড়টা দিতাম , সেও কিন্তু ধরা দেবার আনন্দের জন্যেই । তারপর একসময় যথেষ্ট ভূত হয়ে দীঘিতে নামা ! একসঙ্গে এতজন রঙমাখা ভূত , দীঘির জলও পুরো রঙিন ! ফেরার পথে দেখতাম সারি সারি হোগলার ছাউনি পড়ছে মেলার মাঠে । গোঁসাই জ্যেঠু চব্বিশ প্রহরের ঘট তুলে নাটমন্দিরে যাচ্ছেন , বৃহৎ সংসারের আর্থিক চাপে জীর্ণ ছোটখাটো চেহারার জ্যেঠুর মাথাটা সেদিন সবাইকে ছাড়িয়ে যেত । সামনে কীর্তনের দল , শাঁখ আর উলুধ্বনির মধুর গম্ভীর আওয়াজ , কাঁসরঘন্টার ঢং ঢং …. ওসব ছাড়িয়ে উৎসুক চোখে তাকে খুঁজতুম , তার ছাউনি কি পড়ল , সেই চুড়িওয়ালার ….. ! কাঁচের চুড়ি পরাতে পরাতে কত জায়গার কতরকম মেলার গল্প করত সে , ও না আসা অবধি আর উতসব কিসের ! সংগে আসত তার ছোট মেয়েটি , সেও কম আকর্ষণের ছিল না । লাল নীল সবুজ নানা রঙের চুড়ি বাবার ফরমাস মত সে এগিয়ে দিত আমাদের দিকে , অবাক হয়ে দেখতাম তার রোগা শ্যামলা হাতে একটাও চুড়ি নেই । এতো রঙিন লোভনীয় সম্ভারের ভেতর তার বিবর্ণ হাত দুটো দেখে আমার মনে হত ,ওর বাবাও নির্ঘাত আমার বাবার মতোই নিষ্ঠুর । বাবা পছন্দ করত না বলে বরাবর আমি শুধু পাশে বসে বন্ধুদের চুড়ি পরা দেখতাম । মেয়েটার সঙ্গে চোখাচুখি হত আমার , মনে মনে বলতাম দেখিস একদিন আমরাও পরব , হাত ভর্তি রঙ বেরংয়ের চুড়ি পরে ঝমঝম করে হেঁটে যাব । প্রতি মেলায় দুহাত খালি নিয়েই সে বড় হচ্ছিল আমার সঙ্গে । হঠাৎ এক বছর সে আর এলো না । তখন আমার ক্লাস এইট কি নাইন , শুনলাম তাদের দু বোনের নাকি একসংগে বিয়ে হয়ে গেছে বিনাপণে , উল্টে বয়স্ক বিহারি বর তার বাবার হাতে কিছু টাকাও দিয়ে গেছে। বছর দুই পরে তার বাবাও আর এল না ,শুনলাম বাচ্চা হতে গিয়ে মারা গেছে আমারই বয়সী তেরো চোদ্দর সেই মেয়ে । চুড়ির দোকানের দিকে আর চাই নি কোনদিন ।
শেষ বিকেলে গুরুজনদের পায়ে আবির দিয়ে নিজেরা ফের মাখামাখি ! প্রেম ট্রেম তো আকছার হত এ সময় ! কিশোর বয়সে সেই বিশেষ জনের আবিরমাখা হাত গালে ছুঁলে কেমন কেঁপে উঠত শরীর , মনে পড়ে । বাবাজী পূর্ণচন্দ্র বেশ তাড়াতাড়ি উদয় হয়ে যেতেন আর আমরা ‘এই একটু চব্বিশ প্রহরের মেলা দেখে এক্ষুণি আসছি ‘ ডাহা মিথ্যেটি বড়িতে বলে পাড়ার সব ছেলে মেয়ে মিলে দলবেঁধে চলে যেতাম বাঁধের রাস্তা ধরে ঘুরতে । দুপাশের ফাঁকা মাঠের কোলে অসম্ভব নির্জন সুন্দর সেই রাস্তায় সন্ধ্যের পর যাওয়ার অনুমতি ছিল না । মেলা সেই আড়ালটা দিত । ফুটফুটে জ্যোৎস্নার মধ্যে কলকল কথা আর সুরে বেসুরে গান ……।
কি আপাত তুচ্ছতায় ভরা গভীর আনন্দমাখা সেইসব বসন্তদিন ! সব মনে হয় এই সেদিন ,কতটুকুই বা গেছি তারপর !