কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) – নীলম সামন্ত
স্বাদকাহন (প্রাক-কথন)
কথায় বলে ‘যেই দেশ যাই সেই ফল খাই’—
কিন্তু শুধু ফল নয়, প্রত্যেকটি অঞ্চলের আবহাওয়া ও মাটির চরিত্র অনুযায়ী গড়ে ওঠে তাদের খাদ্যাভ্যাসও। তাই খাদ্য হল প্রতিটি অঞ্চলের প্রকৃতি, জীবনযাত্রা, বিশ্বাস আর চাহিদার প্রতিফলন।
যেমন ভারতের কথাই ধরা যাক—এই বিশাল দেশের ভৌগলিক বৈচিত্র্য শুধু ভাষা, পোশাক বা সংস্কৃতিতেই নয়, প্রতিটি রাজ্যের খাদ্যাভ্যাসেও গভীর ছাপ রেখে গেছে।
উত্তরের মানুষ আলু পরোটা, ছোলা ভাটুরে খায়, দক্ষিণে ঘুরছে ধোসা-ইডলি-সাম্বার, পশ্চিমে পাও ভাজি, ধোকলা, থেপলার ভাঁজে প্রতিদিনের সকাল। আর আমাদের বাংলার পাত জুড়ে রয়েছে ভাত, ডাল, পোস্ত, শুক্তো কিংবা চচ্চড়ি।
এ তো গেল কোন রকম গল্প। রাজ্য অনুযায়ী দেখলে দৃশ্যপটে সব জায়গাতেই কিছু না কিছু তফাৎ পাওয়া যায়। অন্তত রান্নার পদ্ধতিটুকু আলাদা হবেই। যেমন, পাঞ্জাবের দুপুর মানেই মাখনের গন্ধে ভেসে যাওয়া, কেরালার ঘরে ঘরে নারকেল-মাছের প্রেমকথা, রাজস্থানের মরুতে দাল-বাটির চিরন্তন বন্ধন, আর পশ্চিমবঙ্গের দুপুরের শুক্তো, কেবল শরীর নয়, সংস্কৃতিরও দর্পণ। আরও কত কিই রয়েছে। এমনি এমনি কি আর ভারতীয় বৈচিত্র্য?
পরিচিতরা সকলেই মোটামুটি জানেন আমি দীর্ঘদিন প্রবাসী। একসময় দেশের বাইরেও থেকেছি। তাছাড়া সোসাল মিডিয়া বাদ দিলে বাকি কাছের মানুষরা তো এটা জানেনই, আমার পায়ের তলার সরষে দেওয়া৷ হ্যাঁ, আমি ভীষণ পরিমানে ভ্রমণ-পিপাসু৷ ফলে, যাযাবর জীবন আর ভ্রমণ অভিজ্ঞিতাকে কেন্দ্র করে ভ্রমনের বই লেখা আমার পক্ষে বেশ সহজ কাজ। কিন্তু খাদ্য অতি প্রিয় অধ্যায়৷ বেড়ানোই হোক বা বাসস্থানের ভিন্নতা, আমি নানান ধরণের খাবার খেতে অভ্যস্ত। সেটা যে এমনি এমনি ঘটেছে তা নয়। প্রবল ভোজনরসিক স্বভাবের কারণে যেখানেই গিয়েছি সেখান কার খাবার মুখে দিয়ে দেখেছি কেমন স্বাদ৷ এমনও হয়েছে নানান জায়গায় বড় বড় হোটেল ছেড়ে হোমস্টে তে থেকেছি, আর গ্রামীণ বা সেই জায়গার মানুষের বাড়ির রান্না খাওয়ার জন্য। বড় হোটেলগুলোতে তো জানেনই সবই কাস্টমারের পছন্দ অনুযায়ী কাস্টমাইজ করে দেওয়া হয়। তাতে উৎসের স্বাদ থাকে না।
আমি যে খেয়েই খান্ত হই এমন নয়, মোটামুটি মানুষের সাথে মিশতে পারার সুবাদে কোন খাবার খেলে সরাসরি হেঁশেলে ঢুকে কিংবা লোকজনের সাথে গল্প করে রান্নার রেসিপি থেকে শুরু করে কেন এমন রান্না সে সব কিছুর শেকড় খুলে দেখে নিই। আসলে আমার শখগুলি এমনই অদ্ভুত। এই অদ্ভুত শখকে আঁকড়ে ধরেই ভাবলাম কলম ধরি। খাবার যে কেবলমাত্র ক্ষুধা নিবারণ কিংবা জিভের রসনা তৃপ্তি তা নয়—খাদ্য হল অঞ্চলভেদে চিন্তা, চেতনা ও চর্চার বাহক। ফলত আমি আশা করছি আমার এই কলমে নিশ্চই ভালো কিছু লেখা হবে, যা পাঠক হিসেবে আপনাদের সকলেরই মন জয় করবে ৷
তাছাড়া, বর্তমানে আমাদের সমাজ বা পরিবেশ সব কিছুই ভয়ঙ্কর ভাবে উত্তাল। এদিকে মানুষ হিসেবে টিকে থাকার প্রাথমিক চাহিদা কিন্তু একই— তা হল খাদ্য। সেই খাদ্য কখনো কখনো আমাদের ভাষার বাইরেও এক অনন্য সংযোগ গড়ে তোলে। তাই ভাবলাম খাবারের গল্প করি তাতে যদি সামান্য মন ভালো থাকে, কিংবা মনের ভেতর সামান্য জানালা তৈরি করে যেখানে ফুরফুর করে দখিণা বাতাস ঢুকতে পারবে।
আমি বিশ্বাস করি, ঘোরতর কোন্দলের সময়ও খাদ্য মানুষকে কাছে এনে দেয়। বর্তমান পরিস্থিতি তে আমাদের হিংসা বিদ্বেষ সরিয়ে কাছে এসে মানুষের সাথে মানুষের বসবাসটাই অধিক কাম্য। ভাতের গন্ধ কিংবা রুটি সেঁকার ধোঁয়, ক্ষুধার্ত মানুষকে অমানবিকতা ভুলিয়ে কাছে আনতে শেখায়।
আর এই বিশ্বাস থেকেই কলম তুলে নিচ্ছি—একটি ধারাবাহিক খাদ্য ও সংস্কৃতির গল্প যা শুধু স্বাদের সন্ধান নয়, বরং এক নিরন্তর সংলাপ। যেখানে প্রতিটি পদ ছুঁয়ে যায় মানুষকে, মাটি-জল-আবহাওয়ার ঘ্রাণে ভেসে আসে যাপনচিত্র। এই লেখা আশ্রয় নয়, বরং এক প্রচেষ্টা—খাদ্যের ভেতর দিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছানোর, মনুষ্যত্বের গভীরে নামার।