কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) নীলম সামন্ত – স্বাদকাহন

কবিরাজি কাটলেট

কবিরাজি— কথাটা মুখে আনলেই কেমন যেন মনে হয় কবিরাজের ওষুধ। আসলে একটা সময় ছিল যখন বাংলায় প্রচুর কবিরাজ বৈদ্য দেখা যেত। মানুষের রোজ জ্বালা হলে সাহেব ডাক্তার ডাকার আগেই কবিরাজ মশাইকেই ডাক দেওয়া হত। আর সেই কবিরাজের পাচনে কখনও রোগী সুস্থ হতো কখনও সময় নিত। সাহেব ডাক্তারদের ডাকা হত না কারণ সাহেব ছুঁলে যে জাত যাবে, তাছাড়া ইঞ্জেকশন দিত, এসব হিন্দু বা ব্রাহ্মণ ধরে একেবারেই জাত কেড়ে নেওয়া কান্ড ! সেই কবিরাজের পাচন কিছুদিন আগে পর্যন্তও চলত।

ডাক্তারবদ্যি বাদ দিলে কবিরাজি কে খাবারের নাম ধরলে প্রথমে অনেকেই ভেবে ফেলেন, কবির পছন্দের খাবার। আর বাংলার কবি মানে মাথায় প্রথম ভিড় করেন রবিঠাকুর। তাই সেই দিক থেকে অনেকেই ভেবে ফেলেন কবিরাজি হল রবিঠাকুরের পছন্দের এবং ঠাকুরবাড়ির হেঁশেলের বিখ্যাত বা অতি সুস্বাদু রন্ধন শিল্প।

কিন্তু এগুলোর কোনটাই সঠিক নয়। কবিরাজি যে এক প্রকার কাটলেট তা আমায় আলাদা করে বলে দিতে হবে না। আজকের কলকাতা তথা বাংলার নানান জায়গা চপ কাটলেটের জন্য সারা ভারতে নাম কামালেও এই চপ, কাটলেটের কোনটাই খাঁটি বাঙালির খাবার নয়। এই কথা জেনে বেশিরভাগ বাঙালির মন খারাপ হলেও সত্য এটাই যে শুধু কবিরাজি নয় বাংলার বেশিরভাগ খাবারের পেছনেই কোন না কোন গল্প আছে। শুধু বাংলার নয়, সব জায়গারই এরকমই গল্প।

১৭৫৭ সাল মনে আছে? থাকবে না আবার! পলাশীর আমবাগানে নবাব সিরাজ যুদ্ধ করছেন রবার্ট ক্লাইভের বিরূদ্ধে৷ ক্লাইভের ছিল পাঁচ হাজার সৈন্য আর সিরাজের পঞ্চাশ হাজার। কিন্তু হেরে গেল সেই সিরাজই। এই হার যে কেবল মাত্র সিরাজের হার এমন নয়, এই হার আসলেই ব্রিটিশদের বাংলায় পাকাপাকি রাজত্ব চালানোর আমন্ত্রণ। কারণ এর পর থেকেই ব্রিটিশরাজ চলল টানা দু’শ বছর। বাঙালি সহ সারা ভারতবর্ষ অনেক কঠিন দিন থেকে শুরু করে দারিদ্রতা মোকাবিলা করেছে এ যেমন সত্য তেমনি ব্রিটিশরাই প্রথম যারা ভারতকে একটি সম্পূর্ণ দেশ হিসেবে গঠন করেছিল, সংবিধান আইন ইত্যাদি সমেত। যেহেতু ব্রিটিশদের রাজধানী ছিল কলকাতা তার সাহেবদের নানান পছন্দের জিনিসের আনাগোনা ছিলই। তার মধ্যে অন্যতম হল খাদ্য, বস্ত্র, আর নিত্য ব্যবহৃত দ্রব্যাদি। আজকাল যেমন দেখি বিদেশে বা ভারতের অন্যান্য রাজ্যে কোন বাঙালি খাবারের দোকান পেলে বাঙালিরা হামলে পড়ে, তেমনি ব্রিটিশরাও বিদেশে চাকরি করতে এসে নিজেদের পছন্দের খাবারের খোঁজ করত। তাদের লোকেরা যেমন সেই খাবার বানিয়ে বিক্রি করত তেমনি বাঙালিরাও শিখে নতুন সংযোজন বিয়োজন করত। এরকমই এক মুখরোচক খাবার হল কবিরাজি কাটলেট।

কবিরাজি কাটলেটে যাবার আগে আমাদের জানা দরকার কাটলেট সম্পর্কে। কাটলেট কথাটা এসেছে ফরাসি শব্দ “côtelette”(কোটলেট) থেকে, যার অর্থ “ছোটো মাংসের কাটা টুকরো”। ফ্রান্স এবং পরে ইংল্যান্ডে, ১৭শ শতকের দিকে প্রচলিত কাটলেট ছিল একটি ক্লাসিক মাংস-ভিত্তিক খাবার, যা সাধারণত মেষ বা গরুর মাংস দিয়ে তৈরি হতো। এটি ভিয়েনা স্কনিটজেল এবং ফরাসি escalopes বা côtelette–এর একরকম রূপ। মূলত মাংসের টুকরোকে পাউডার বা ব্রেডক্রাম্বে মাখিয়ে ভেজে তৈরি হত এই কাটলেট।

কলকাতার খাদ্যমহলে এই কাটলেট ব্রিটিশদের হাত ধরে এসেছিল বলে মনে করা হয়, তবে বাঙালির হাতে পড়ে অদ্ভুত মিশেল পায়। শুয়োর, মেষ বা গরুর মাংসের জায়গায় ভেটকি মাছ, মুরগী, খাসির কিমা এসবের ব্যবহার শুরু হল। আর ইউরোপিয় মশলা ও ভেষজ উপাদানের পাশাপাশি যোগ হল বাঙালিয়ানা। সরষের আচার, আমের কাসুন্দির সাথে এই কাটলেটের স্বাদ নিজেকেই নিজে ছাপিয়ে যাবার মতো অবস্থা। শুধু বাঙালির না সাহবদেরও পছন্দের তালিকায় এসে গেল। এই কাটলেটকেই ডিমের কভার দিয়ে পরিবেশন করল কলকাতারই রাঁধুনিরা। অর্থাৎ তৈরি হল ডিমের কভারেজ কাটলেট। কবিরাজি শব্দটি না ব্রিটিশ, না ফরাসি, না বাংলার, এটি কভারেজ শব্দের পথ চলতি অপভ্রংশ— কবিরাজি। যেভাবে বাঙালি তিলকে তাল করে থাকে।

আবার গুগুল সহ অন্যান্য খাদ্য-ইতিহাসের তথ্য বলছে কভারেজ কাটলেট ব্রিটেনের এক সময়ের অতি জনপ্রিয় খাবার। যা মূলত কম তেলে ভাজা, প্যান ফ্রাই করা এক ধরনের কাটলেট। স্বাস্থ্যসম্মতও। আর বাঙালি তথা কলকাতার কবিরাজি কাটলেট কড়াইয়ে ডুবো তেলে ভাজা। একেবারে বিপরীত। শুধু তাই নয়, কভারেজ কাটলেটের ওপর ডিমের যে ধরনের প্রলেপ দেওয়া থাকে, তার সঙ্গে কবিরাজি কাটলেটের কোনো মিল নেই। কবিরাজি কাটলেটের ভেতরের ভেটকি মাছ বা মুরগী, খাসির মাংসের কাটলেট মোড়া থাকে এক অদ্ভুত মোড়ক দিয়ে। তেল জবজবে, জালিকাকার বেড়া। এটির সঙ্গেও ‘কভারেজ কাটলেট’- এরও কোনো মিল নেই। তবুও যেহেতু কাটলেটের চারপাশের মোড়ক তথা কভার তাই ব্রিটিশদেরই নামের অনুকরণে নামাঙ্কিত হয়েছিল কভারেজ কাটলেট আর তাই বাঙালির মুখে মুখে দীর্ঘজীবী হতে গিয়ে হল কবিরাজি কাটলেট।

বাঙালির খাদ্য ইতিহাস বলছে বাংলার নানান খাবারের ওপর পর্তুগিজদের প্রভাব অনেক বেশি কারণ ব্রিটিশরা রাজ করে চলে যাওয়ার পরেও বেশ কিছুদিন যাবৎ পর্তুগিজদের বসবাস ছিল। আর তাদের রন্ধন-প্রনালীর প্রভাবও পড়েছিল বাঙালির রান্নায়। সেই দিক থেকে বলতে পারি এই কবিরাজি কাটলেট অনেক বেশি ‘টেম্পুরা ব্যাটার’ নামক ইউরোপীয় খাবারের কাছাকাছি। যেটির ওপরের অংশটি দেখতে একেবারে কবিরাজি কাটলেটের মতো।

যেখান থেকেই হোক বা যাকে দেখেই হোক বর্তমান কলকাতায় নানান বিখ্যাত স্ট্রিট ফুড এর মধ্যে এ কবিরাজি কাটলেট আজও মানুষের মনে অনেকখানি জায়গা করে নেয়৷ কলেজস্ট্রিটের অতি পুরনো দিলখুশ কেবিন থেকে শুরু করে মিত্রক্যাফেতে কিংবা নিরঞ্জনের দোকানে গেলে অন্তত একটা ভেটকি মাছের কবিরাজি না খেয়ে আমাদের মন ভরে না। তাছাড়া আমরা যখন কবিরাজি কাটলেট খাই, তখন কেবল মাংসভরা বা মাছের পুর ভরা এক কড়কড়ে পদ মুখে নিচ্ছি এমন না — আমরা চিবিয়ে খাই একসময়ের কেবিন কালচারের ইতিহাস, ব্রিটিশ-বাঙালি মিলনের খাদ্যরসায়ন। এটি যেন এক স্বাদের কবিতা — যেমন তার নাম: “কবিরাজি”।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *