কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) নীলম সামন্ত – স্বাদকাহন

স্বাদকাহন – ঘেওর নাকি বাবরসা

সারা ভারতবর্ষের সাথে সাথে পশ্চিমবঙ্গের আনাচেকানাচে নানান ধরনের খাবার দাবার ছড়িয়ে রয়েছে৷ কত কিই যে সময়ের সাথে হারিয়ে যাচ্ছে তার হিসেব নেই। পশ্চিমবঙ্গে খাওয়ারের রকমারি যেমন তেমনিই মিষ্টির বাহারও রয়েছে৷ আর সারা পৃথিবীর মানুষই বোধহয় জানে কলকাতাবাসী মানেই মিষ্টি প্রিয়৷ বিশ্বের কাছে বাঙালি মানে কলকাতা হলেও পশ্চিমবঙ্গ অনেকখানি তাদের আহারেবাহারের পরিধিও বিশাল।

ডাল বাটি চুরমার গল্প লেখার সময়ই ভাবছিলাম ঘেওরের গল্পও লিখব। হরিয়ানাতেই প্রথম দেখেছিলাম। আমার পিসতুতো দিদিকে জিজ্ঞেস করতে দিদিই জানিয়েছিল, ঘেওর মূলত রাজস্থানের মিষ্টি৷ কিন্তু পাশাপাশি রাজ্য হওয়ায় সীমান্ত রেখা পেরিয়ে আসতে কোন অসুবিধে হয়নি৷ তাই বর্তমানে রাজস্থানের সাথে হরিয়ানা বা দিল্লীতেও ঘেওরের জায়গা বেশ জমকালো। দিদিই গল্প করেছিল, বহু বছর আগে রাজপুতরা রাজস্থানে যখন জাঁকিয়ে রাজত্ব করছে, নানান রীতিনীতি সমেত সংস্কৃতির ঐতিহ্যে সাজিয়ে তুলেছে নিজেদের জীবনযাত্রা, তখনই বিশেষ বিশেষ উৎসব পালনে মিষ্টি তৈরি হত৷ এই ঘেওরও ওই সময়কারই মিষ্টি৷ গ্রীষ্ম পার করে প্রকৃতি যখন বর্ষা আগমনে ব্যস্ত তখনই ঘরে ঘরে গরম ঘিয়ের ওপর কায়দা করে ময়দার গোলা দিয়ে তৈরি হত চ্যাপটা গোল জালিকাকার মৌচাক৷ তাকেই চিনির রসে ডুবিয়ে ওপর থেকে রাবড়ি দিয়ে পরিবেশন করা হত৷ এই সময় প্রকৃতির পরিবর্তনে শরীরকে ঠান্ডা রাখতে এই খাবারের অধিক প্রচলন ছিল। তবে খাঁটি ঘিতে তৈরির কারণে সাধারণ দিন আনে দিন খায় মানুষের কাছে বেশ কঠিন ছিল এই খাবারের স্বাদ পাওয়া৷ সে কারণেই হয়তো রাজদরবারে অধিক রমরমা ছিল। দিদি বলেছিল, আজও নাকি শ্রাবণে বা তিজ বা গাঙ্গুরের (অবাঙালিদের উৎসব) সময় মেয়েরা মাইকা তথা বাপের বাড়ি এলে ষোল শৃঙ্গারের সাথে সাথে এই ঘেওর দেওয়ার প্রচলন আছে৷ হবে নাই বা কেন, সব মেয়েই যে তার বাবার কাছে রাজকন্যা৷

যাইহোক বাবরসা পশ্চিমবঙ্গের কথা লিখতে এসে হঠাৎ করে রাজস্থানে চলে গেলাম। না না একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক নয়। আমি এভাবেই ঘেওরের কথা বলছিলাম আর মা আমায় বলল, “তুই এতো কিছু রান্না পারিস বারবসা বানাতে জানিস?” আমি ভাবছি বাবরসাটা কি বস্তু! খায় না মাথায় দেয়? চোখ মুখের দুরবস্থা দেখে মা নিজেই বলল, ক্ষিরপাই-তে (পশ্চিম মেদিনীপুরে ঘাটালের দিকের একটি জায়গা) পাওয়া যায়৷ খেতে কিন্তু দারুণ! বাঙালির দারুণ মানেই মিষ্টি স্বাদের কিছু একটা। এরকমটাই ভেবে মাকে জিজ্ঞেস করলাম “কোন মিষ্টির কথা বলছ?” মা জবাব দিল, ” হ্যাঁ রে৷ কোন দিনও খাসনি? আগে খুব ভালো পাওয়া যেত। এবছর দেখছি একেবারেই নেই।” এভাবেই নানান গল্প চলতে থাকল। মাকে জিজ্ঞেস করে করে যা জানলাম তা হল বাবরসা আসলে বাঙালির ঘেওর। একটা বিষয়ে অবাক হই, ইন্টারনেট নেই, সংবাদ মাধ্যম নেই অথচ রাজস্থানের মিষ্টি বাংলায় এলো নাকি বাংলার মিষ্টি রাজস্থানে গেল! মা এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি৷ দু’টো গ্রামীণ প্রচলিত গল্প শোনালো। প্রথমটি কমজরি মনে হলেও দ্বিতীয়টির সাথে বেশ যোগাযোগ পাওয়া যায়৷

কেউ কেউ বলে, মুঘল সম্রাট বাবরকে ভেট বা বিশেষ উপহার হিসেবে গ্রামবাংলার ময়রা এই বিশেষ মিষ্টি বানায়৷ আর এই মিষ্টি খেয়ে বাবর বেজায় খুশি হয়েছিল। সেই খুশির হাসি ধরে রাখতেই মিষ্টির নাম সম্রাটের নাম অনুপাতে হয় বাবরসা। আর এর পর থেকে মুঘল দরবারেও বেশ বিখ্যাত ও প্রচলিত মিষ্টি ছিল বাবরসা৷ অথচ আকবরের আমলে মুঘল দরবারে নাম পায় ঘেওর।

আবার অনেকে বলন আঠেরো শতকের দিকে যখন ক্ষিরপাইয়ের বাসিন্দারা মারাঠা বর্গি আক্রমণে এবং তাদের অত্যাচারে রীতিমতো অতিষ্ঠ তখন এডওয়ার্ড বারবস নামে এক সাহেব এগিয়ে আসেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। তাঁর সাহায্যেই বর্গিরা ফিরে যেতে বাধ্য হয়, সাথে ক্ষিরপাই এর গৌরবও পুনঃস্থাপন হয়৷ বলে রাখি, এই সময় থেকেই প্রচলিত হয়েছিল সেই ঘুম পাড়ানি বিখ্যাত ছড়া — “খোকা ঘুমলো পাড়া জুড়লো বর্গি এলো দেশে/বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে” আজও বাংলার মায়েদের মুখে মুখে প্রচলিত৷ বুলবুলি তথা বর্গিরা ফসল খেয়ে গেছে খাজনা দেবে কিভাবে! রাত বড় দুর্বিষহ, ভয়ঙ্কর। এমন দিনে যিনি বাঁচালেন মানুষকে তিনিই তো গ্রামবাসীর কাছে ঈশ্বর স্বরূপ! এই সাহেব, এডওয়ার্ড বারবসকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ স্বরূপ ক্ষীরপাইয়ের ময়রা অত্যন্ত উদ্ভাবনী ঘি-ভাজা ময়দার মিষ্টি তৈরি করে। এই মহান বিদেশীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে, মিষ্টিটির নামকরণও করা হয় ‘বাবরসা’।

সেই সময় এই মিষ্টি সারা বাংলায় বেশ জনপ্রিয় হলেও সময়ের সাথে হারিয়ে বসেছে। আজ তো লুপ্তপ্রায় বললেই চলে! না হলে কি আর ক্ষীরপাই থেকে মাত্র ত্রিশ চল্লিশ কিলোমিটার দুরের এক গ্রামে বড় হয়েও বাবরসা না খাওয়া ও না চেনা মানুষ আমি! শুধু আমি কেন আশেপাশের গ্রামগঞ্জে আমার মতো অনেকেই বাবরসার নাম শোনেনি৷ যথেষ্ট প্রচারের অভাব, সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে হওয়ার কারণেই হয়তো এমন দুর্গতি।

ঘেওরের মতো হুবহু একই দেখতে ও তৈরির পদ্ধতি এক হয়েও এই মিষ্টি কিন্তু সামান্য তফাতেই ভিন্ন৷ আসলে ঘেওর ভাজার সাথে সাথেই চিনির রসে ডুবিয়ে দেওয়া হয় আর বাবরসা শুকনো রাখা হয়। যখন কাউকে পরিবেশন করা হয় তখনই রসে ডুবিয়ে ওপর থেকে রাবড়ি দিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে ঘেওরের থেকে বাবরসা বেশিদিন ভালো থাকে। আর বেশি মুচমুচেও হয়।

একেবারে লুপ্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বর্তমানে ময়রারা ঘি তে না ভেজে বনস্পতি তেল বা ভোজ্যতেলে ভাজেন৷ এর কারণে সাধারণ মানুষের আয়ত্তের মধ্যেই তৈরি হচ্ছে বাবরসা। এই প্রচেষ্টা আশাকরি বাবরসাকে হারিয়ে যেতে দেবে না। আমার মতো অনেকেই যারা ঘেওর প্রেয়সী অথচ বাড়ির পাশের বাবরসা জানে না, সারা ভারত তথা বিশ্ববাসীর কাছে বাংলার গাঁ-গঞ্জ নিয়ে অহংকার করার আরও একটি বিষয় জমে উঠবে৷ যা সত্যিই বড় আনন্দের৷

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *