কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) নীলম সামন্ত – স্বাদকাহন

স্বাদকাহন – লিট্টি চোখা
এক জীবনে আমরা ঠিক কতবার জন্মাই সেই হিসেব বোধহয় আমাদের নিজেদের কাছেও নেই৷ এমন কেন বলছি? জন্মের পর যখন শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে যাই, এক নতুন জন্মে পা দিই৷ তারপর যৌবন, মধ্যবয়স… এর মাঝেই আমরা কখন সন্তান, কখনও ছাত্রছাত্রী, কখনও প্রেমিকা, স্ত্রী, কাকিমা, জেঠিমা ইত্যাদির সাথে মা। আসলে এক একটা সম্পর্ক আমাদের নতুন জন্ম দেয়। ঠিক তেমন ভাবেই খাবারেরও নতুন নতুন জন্ম হয়৷ এই যেমন পোলাও, প্রথমে ভাতের জন্ম তারপর নতুন সাজ সজ্জা দিয়ে পোলাওয়ের জন্ম৷ ঠিক তো?
প্রতিটা জন্মের কোন না কোন বিশেষ কারণ বা অনুপ্রেরণা থাকে৷ খাবারও সেই একই পথের যাত্রী। জীবনে প্রথমবার কবে লিট্টি চোখা খেয়েছিলাম তা আজ আর মনে নেই৷ তবে যখন ডাল বাটি খেলাম কেন জানি না বার বারই মনে হয়েছে বাটির পরবর্তী সজ্জিত জন্মই হল লিট্টি। যেমন লুচির পরবর্তী জন্ম কচুরি৷ তবে বাটি বানানোর পদ্ধতি বা ভৌগোলিক কারণ লিট্টির থেকে একেবারেই আলাদা।
লিট্টির শেকড় খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে গিয়েছিলাম প্রাচীন ভারতের শক্তিশালী রাজ্য মগধে। বর্তমান ভারতের বিহারের দক্ষিণাঞ্চল এবং ঝাড়খণ্ডের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত এই মগধ ছিল চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, অশোক, এবং বিক্রমশীলার মত ঐতিহাসিক চরিত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্র। এই অঞ্চলের মানুষের জীবন ছিল কৃষিকেন্দ্রিক, এবং কৃষকেরা খেতের কাজের ফাঁকে শক্তি ও পুষ্টি জোগাতে যেসব খাবার খেতেন, সেগুলোই আজ লিট্টির মতো রূপ নিয়েছে।
গবেষকদের মতে মৌর্যবংশের রাজ-সেনারা যখন যুদ্ধে যেতেন তখন তাদের সুবিধার্থে এই খাবার তৈরি হত। কেন জানেন? লিট্টি এমন একটি খাবার যা বানাতে অনেক বাসন দরকার হয় না আবার উপকরণও লাগে না। এদিকে বিশেষ পদ্ধতি ছাড়াই সংরক্ষণ করা যায়৷ ছোলার ছাতু ও গমের আটা প্রধান উপকরণ৷ অর্থাৎ সহজ পাচ্য, কার্বোহাইড্রেট থেকে প্রোটিন দুইই এক সাথে। আর ছোলার ছাতু যে কেবল মাত্র প্রোটিন সরবরাহ করে তা নয়, শরীর ঠান্ডাও রাখে আর আটা দিয়ে করা হয় ফলে গমের ভুসি অর্থাৎ ফাইবার হজম ও পেট পরিষ্কারের দিকও খেয়াল রাখে৷ কোন বিশেষ সরঞ্জাম ছাড়াই আটার বলের মধ্যে ছাতুর পুর ভরে কয়লার আগুনে পুড়ে তৈরি করা খাবার যুদ্ধের সৈনিকদের জন্য সব দিক থেকে সহজ রান্না। তাই না?
পরের দিকে লিট্টির সঙ্গে চোখা যোগ হয়৷ আসলে শুধু লিট্টি মানুষ দায়ে পড়ে খেলেও দিন বদলের সাথে স্বাদ বদলের পালায় আর কারোও ভালো লাগত না। তাই স্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতেই একটু সবজি খাওয়া হবে এমনটা ভেবেই হয়তো চোখার উৎপত্তি। বেগুন আলু টম্যাটো পুড়ে এক সাথে সরষের তেল পেয়াজ আদা রসুনের মশলায় মাখিয়ে তৈরি করা হয় এই চোখা। আর লিট্টির স্বাদ আরও বাড়ানোর জন্য পরিবেশনের সময় লিট্টি ভেঙে তাতে বাড়ির তৈরি ঘি ঢেলে দেওয়ার প্রচলনও শুরু হয়েছিল পরবর্তী কালে ৷ নতুন নতুন সংযোজনগুলি যে কেবলমাত্র স্বাদ বাড়ায় তা নয় জনপ্রিয়তা বাড়াতেও সাহায্য করে ৷ এক কথায় বলা যায় “অভাব” থেকেই ধীরে ধীরে জন্ম নিয়েছে “অসাধারণ”।
অনেক ইতিহাসবিদের মতে, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় লিট্টি ছিল বিদ্রোহীদের অন্যতম ভরসাযোগ্য এবং সহজপাচ্য জনপ্রিয় খাবার। এর কারণও মৌর্য আমলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ । সহজে বানানো যায়, দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করা যায় এবং বহন করাও সুবিধাজনক। বিশেষ কোনো থালাবাটি ছাড়া চলতি ফিরতি সময়ে খাওয়া যায় এবং অল্পেই পেট ভরে যায় বলেও লিট্টি নানান সময়ের সৈন্যদের প্রিয় খাবার হয়ে ওঠে।
যদি একটু অন্যরকম ভাবে দেখি— সেই যুগে মগধ ছিল বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনের জন্মভূমি। এই দুই দর্শনই প্রচার করে সংযম ও সরলতার আদর্শ। আর সেটাই খাদ্যাভ্যাসে প্রতিফলিত হয়েছিল। বৌদ্ধ ধর্মে আহারের পরিমাণ, উপাদান ও প্রস্তুতির সরলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নালন্দা বা বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলিতে শত শত ভিক্ষু বসবাস করতেন। তাঁদের জীবনে এমন খাদ্যের প্রয়োজন ছিল যা— শরীর ঠিক রাখবে, সহজপাচ্য হবে, অল্প উপাদানে প্রস্তুত হবে। অনেকেই মনে করেন, পুষ্টিকর খাবার হিসেবে সত্তু বা ছোলার ছাতু ও গম বা যবের মিশ্রণে বানানো লিট্টির আদিরূপ ব্যবহৃত হতো। যা বৌদ্ধ জীবনের “মধ্যমার্গ” দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মিলে যায়—অতিরিক্ততাহীন, কিন্তু পরিপূর্ণ।
দিন কয়েক আগে বাড়িতে লিট্টি বানাচ্ছিলাম। দাদা তার ওটিজিতে পুড়ে দিচ্ছিল, সাথে আমাদের বিস্তর গল্প । দাদা বলছিল, ২০১৩ সালের মহাকুম্ভ মেলায় যখন একটা তামার ঘটি আর ইন্সট্যান্ট ম্যাগির প্যাকেট নিয়ে তাঁবু খাটিয়ে ছিল তখন তাদের পাশেই বিহারিরা রোজ লিট্টি পুড়ে খেত। শুনে বললাম, আসলে কম জিনিস বা বাসন ব্যবহার করে এমন তেল বিহীন অথচ সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর রান্না থাকতে ওরা কেনই বা ইন্সট্যান্ট ম্যাগি খেয়ে পেট খারাপ বা কোষ্টকাঠিন্যে নিজেকে কষ্ট দেবে! খুব প্রয়োজন আছে কি?
বহুবার ট্রেনে যাতায়াতের সময় দেখেছি বিহারি বা উত্তরপ্রদেশের লোকজনেরা কৌটো ভরে লিট্টি নিয়ে যায়৷
আজকাল আমরা তেল ছাড়া খাবার খাওয়ার জন্য এয়ার ফ্রায়ারের সাহায্য নিই আর শক্ত শক্ত তন্দুরি নাক উঁচু করে গিলে নিই। জিভ ও পাকস্থলীকে স্বান্তনা দিতে বলি “আহা কী দারুণ”, মনকে যুক্তি দিয়ে বলি, স্বাস্থ্যকর খাবার শরীর ভালো থাকবে। এদিকে শত শত বছর আগে কত সহজ পদ্ধতিতেই এমন রান্না তৈরি হয়েছিল, যা কোন দিক থেকেই কোন অঙ্গকে সমঝোতার জালে জড়াতে দেয়নি। যা দেখে একেবারেই মনে হয় না আমাদের পূর্বপুরুষরা অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে বাঁচতেন। তবে একদিন লিট্টি ছিল গ্রামের সাধারণ মানুষ বা নিম্নবর্গের মানুষের খাবার। আর আজকাল দেশের নানান জায়গায় রাস্তার মোড়ে বানানো লিট্টি চোখা বেশ জনপ্রিয় খাবার। এই রূপান্তর একদিকে সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের ভাঙনকে প্রতিফলিত করে, অন্যদিকে খাদ্য-সংস্কৃতির সমতা ও অন্তর্ভুক্তিকেও সামনে আনে।
আসলে একটি খাবারের শেকড় যে কোথায় কোথায় ছড়িয়ে যায় তা বোধহয় আমাদের ধরা ছোঁয়ারই বাইরে৷ আজ মগধ কথাটিকে আমরা ইতিহাসের পাতায় পড়ি, কিন্তু লিট্টি হয়ে উঠেছে সেই ইতিহাসের জীবন্ত ধারক। এটি মগধী সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের প্রতীক, যেখানে রন্ধন শুধু স্বাদ নয়, সময়কে ধারণ করার মাধ্যম। বর্তমান ভোজপুরীদের দৈনন্দিন জীবন হোক বা উৎসবের দিন লিট্টির সংস্কৃতি নিজের জায়গায় জ্বলজ্বল করে। কত মানুষই শুধু খেতে ভালোবাসেন বলে খেয়ে নেন। কিন্তু এই খাবারের পেছনের গল্প তাদের গোচরেই আসে না৷