সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে নিলাম সামন্ত (পর্ব – ৩৩)

মহাভারতের মহানির্মাণ (যজ্ঞসেন তথা দ্রুপদ)
বাংলায় একটা প্রচলিত প্রবাদ আছে, ‘ফাঁকা কলসির আওয়াজ বেশি’— কাম্পিল্য নগরের রাজাকে দেখলে অনেকটা সেরমই মনে হয়।
এখনো পর্যন্ত যেক’টা চরিত্র নিয়ে আলোচনা করেছি তাদের অনেকের কথা বলার সময় কাম্পিল্য রাজা দ্রুপদের কথা এসেছে৷ তাঁকে আমি যত বারই পড়েছি প্রতিবারই অবাক হয়েছি৷ না অবাক যে শুধু মাত্র বৃহৎ কার্য দেখে হতে হয় এমনটা নয়। আমি অবাক হয়েছি তাঁর মুর্খতা দেখে। তবে আমার চোখে মুর্খতা হলেও সেই যুগে সেই সমাজে হয়তো এমনটাই হত। কেন এমন বলছি সেই বিষয়েই আলোচনা করব৷
দ্রুপদ তথা যাজ্ঞসেন হলেন পাঞ্চাল রাজা পৃষতের পুত্র। পৃষতের বিশেষ বন্ধু ভরদ্বাজ হওয়ার কারণে দ্রুপদ অনেকটাই স্বজনপোষণে ভাগীদার হয়েছিলেন শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই। তিনি কতটা যোগ্য মহর্ষি ভরদ্বাজের শিষ্য হওয়ার তার থেকেও বড় কথা তিনি ছিলেন বন্ধু পুত্র। তাই নিজ পুত্রের সমান বলা চলে৷ এবং সেই হিসেবেই সমস্ত সুযোগসুবিধা সহযোগে গুরুগৃহে বসবাস করতেন এবং শিক্ষালাভ করেন। বন্ধুত্বের অর্থ সেই যুগে এমনই ছিল। আরো অনেকগুলো ক্ষেত্রেই দেখেছি, কেউ কাউকে বন্ধু বা মিত্র মনে করলে তাঁর জন্য অনেক কিছুই করতেন। মহর্ষি ভরদ্বাজকে তেমনই মনে হয়েছে। নিজ সন্তান জ্ঞানেই দেখতেন দ্রুপদকে আর সে কারণেই হয়তো শিক্ষাকাল থেকে তাঁর পুত্র আচার্য দ্রোণের সাথে সখ্যতাও গড়ে উঠেছিল সানন্দে৷ দু’জনকে সমবিদ্যা প্রদান করলেও দ্রোণাচার্য যে দ্রুপদের থেকে অনেক খানি এগিয়ে তা আমরা বহু জায়গায় দেখেছি।
রাজার ছেলে হলেই যে অস্ত্র বিদ্যায় পারদর্শী হতে হবে এমনটা কিন্তু নয়। হতেও পারে নাও হতে পারে৷ তবে রাজার ছেলে হিসেবে দম্ভটা যেন জন্মগতভাবে প্রাপ্ত৷ সে কতটা পারদর্শী বা কতটা দূর্বল তার ওপর নির্ভর করে না তাঁর মাথায় মুকুট উঠবে কি উঠব না৷ তবে রাজার ছেলে হিসেবে ছড়ি ঘোরানোর বা নিজের সুরক্ষা নির্ধারণ করার স্বভাব বোধহয় দেখে দেখেই পাওয়া শিক্ষা৷ ঠিক যেভাবে শিক্ষাগ্রহণ কালে রাজা দ্রুপদ আচার্য দ্রোণাচার্যের সাথে বন্ধুত্ব করেছিলেন বলা ভালো বন্ধুত্বের জালে ফেলে তাকে নিজের প্রতিরক্ষা খাতে ব্যবহার করেছিলেন৷ কারণ মিত্রতা যে আসলেই বৃহৎ অনুভূতি তা দ্রুপদের কাছে আমরা কোনদিনই দেখিনি৷ স্বার্থান্বেষী মানুষের আর কিই বা অনুভূতি!
শিক্ষাজীবনে নানান বিপদ-আপদ থেকে আচার্য দ্রোণাচার্য যখন যুবরাজ দ্রুপদকে বাঁচাতেন তখন দ্রুপদ বারবারই বন্ধুত্বের চাবিকাঠিকে উল্লেখ করে বলতেন বড় হয়ে তিনি যখন রাজা হবেন তখন তার রাজত্বের সব কিছুতেই বন্ধুর অধিকার থাকবে।
মম ভোগাশ্চ বিত্তঞ্চ ত্বদধীনং সুখানি চ। আদি ১৩১|৪৭
পরিণত রাজা না হলেও ছোট থেকে তিনি এটা ঠিক ভালোই জানতেন যে কিভাবে কাটে টোপ দিতে হয় কিংবা হাতে রাখতে হয়। এই ধরনের কথাগুলো দ্রোণাচার্যের মনকে সরল এবং নরম জমির উপর রেখে উক্ত হাতে তৈল মর্দন ছাড়া আর অন্য কিছুই মনে হয় না। কারণ সত্যি সত্যি বড় যখন তিনি হলেন এবং পিতার অকাল মৃত্যুর ফলে তাঁর যখন রাজ্যভিষেক হলো তখন কিন্তু আর কোনভাবেই কোন রকম কোন বন্ধুত্বকে স্বীকার করলেন না। দ্রোণ হয়ে গেল গরীব ব্রাহ্মণ। নিজের অবস্থানের উচ্চতা সহজেই দেখিয়ে দিলেন৷ আর এতোটাই দম্ভ যে বন্ধুত্বের দাবী রেখে যখন দ্রোণাচার্য তাঁর পরিবার নিয়ে দ্রুপদের কাছে এলেন এবং জানালেন তাঁর পিতা তথা গুরু ভরদ্বাজের বিয়োগের পর তাঁদের করুণ দশা। সাথে সাহায্যের আশায় বন্ধুত্বের বন্ধনের সেই উদার কথাগুলো মনে করিয়ে দিলেন, তখন কিন্তু দ্রুপদ আর কোনভাবেই উদারতা দেখাতে পারলেন না৷ সরাসরি বলেছিলেন, ধনীর সঙ্গে দরিদ্রের কোন বন্ধুত্ব হতে পারে না। কোন প্রতিশ্রুতি তিনি দেননি। ঠিক এই জায়গায় মনে হয় রাজার ছেলে রাজা হলেও আসলেই সে কাঙালেরও অধিক। না হলে যে সহপাঠীকে বন্ধুর জায়গা দিয়েছিলেন এমনকি তাঁর বাবার বন্ধু যিনি তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন তাঁর সন্তানের এমন দুর্দিনে সামান্য উদারতা দেখাতে পারলে না৷ রাজ্য চলে যাবার ভয় কিংবা নিজের অপারগতা প্রকাশের ভয় তাকে হয়তো টেনে রেখেছিল। কারণ তিনি যতই রাজা হোন বা রাজার ছেলে, আসলে তাঁর দুর্বলতাগুলো তাঁর থেকে ভালো আর কেউ জানত না। তাই কোথাও গিয়ে বারবারই মনে হয় উদারতা দেখানোর আগে তিনি ভয় পেয়েছিলেন, ভেবেছিলেন রাজ্যপাঠ সবই বোধহয় দ্রোণাচার্য হস্তগত করবে৷ নিজে দুর্বল হলে সব কিছুই এরম আলগা মনে হয়৷
তাই হয়তো দ্রোণাচার্যকে সরাসরি না তাড়িয়ে বলেছিলেন দু’মুঠো ভিক্ষা দান করবেন৷