কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) নীলম সামন্ত – স্বাদকাহন

স্বাদকাহন – এগরোল
কোন কোন সপ্তাহে ছোটমাসি এলে বায়না করতাম, ডিম পরোটা খাওয়ার। বড় পরিবার, অনেক মানুষ সামলে মায়ের চাকরি জীবন আমাদের যে খুব বেশি রকমারি খাবারের সম্মুখীন করেছিল এমনটা নয়। তবে মাসিদের বাড়ি গেলে বা ছোটমাসি এলে মনে মনে ভাবতাম কিছু একটা অন্যরকম হবে। মা মাসিদের মধ্যে বড়মাসি সাবেকি রান্নাগুলো বেশ ভালো করত,আর ছোটমাসির হাতে খেতাম নতুন কিছু, যেমন টুটিফ্রুটি কেক, পাঁউরুটির পায়েস, প্যানকেক, চাউমিন, এগরোল, মোঘলাই ইত্যাদি ইত্যাদি। বড় মাসির বাড়ি বেশি গেলেও ছোট মাসি আসার বা গরমের ছুটিতে ছোটমাসি বাড়ির যাবার ইচ্ছেটা সব থেকে বেশি হত এই সব কারণেই। তখন খাবার নিয়ে কোন গল্প থাকতে পারে এমন ধারণাই ছিল না৷ আগ্রহও যে অনেক ছিল এমন কথাও বলব না৷
এগরোল নিয়ে একবার একটা গল্প শুনেছিলাম। গল্পটা এমন ছিল, ব্রিটিশ শাসনকালে কলকাতা রাজধানী থাকার ফলে কলকাতার অনেক বাঙালিই ব্রিটিশ শাসকের দপ্তরে চাকুরিরত ছিলেন। বিদেশিদের নিয়মকানুন যে বেশ কড়াকড়ি ছিল তা মোটামুটি সকলেরই জানা। তো সেই সময়কার বাঙালিরা রাস্তার ধারে দোকানে রুটি তরকারি বা পরোটা তরকারি দাঁড়িয়ে খাবার সময় পেত না৷ ফলে কি করত মাখা মাখা তরকারি পরোটার ভেতর দিয়ে ভালো করে মুড়ে আর সেটা ধরার জন্য বাইরের দিকে কাগজ দিয়ে দেওয়া হত। যেহেতু সব কিছু মিলিয়ে রোল করে দেওয়া হয় তাই সম্ভবত রোল নাম হয়েছে।
কিন্তু এই গল্প আমার ঠিক জুতসই মনে হল না৷ কারণ তরিতরকারি বা ওই জাতীয় খাবার ছাড়া বেশিরভাগ খাবারই প্রথমে আমিষ (যদিও আমিষ আর নিরামিষের সংজ্ঞা আলাদা) তথা ননভেজ হিসেবে তৈরি হয়েছিল পরে স্থান হিসেবে মাংসের বদলে অন্য কিছু দিয়ে মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। এই যুক্তি ধরে এগোলে পরোটার ভেতর প্রথমে মাংসেরই থাকার কথা। তো এই নিয়ে খোঁজখাঁজ চালালাম, উঠে এলো আরও একটি চমৎকার গল্প। সেও ব্রিটিশ শাসনকালেরই।
খুব সম্ভবত ১৯০০ সাল, বর্তমান কলকাতার কর্পোরেশনের জায়গায় এক মুসলিম, নাম রেজা মিয়া, পুরো নাম হাসান রেজা- নিয়মিত বসতেন একটি তাওয়া সাথে কিছু বিফ মানে গরুর মাংস নিয়ে। রোজ যেমনতেমন লোকের আনাগোনা হলেও ছুটির দিনগুলোতে ব্রিটিশদের ভিড় উপচে পড়ত ওই বিফের কাবাব খেতে৷ নিজেদের দেশের মতো খেতে না হলেও বিদেশ বিভুঁইয়ে এমন দোশোয়ালি খাবার কেই বা হাতছাড়া করতে চায়? বিফ কাবাবের চমৎকার স্বাদের প্রেমে পড়ে লোকজন যে কোন কাজে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সন্তুষ্ট করার জন্য ভেট হিসেবে এই রেজা মিয়াঁর কাবাবই দিতে শুরু করল। কিন্তু এতে সামান্য সমস্যা তৈরি হল। ব্রিটিশরা খাবার দাবার হাতে করে খেতে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ নয়। হাতে তেল লেগে চিটচিটে হয়ে যায়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তো আরই নাকউঁচু। কলকাতার জলই যাদের পেটে সহ্য হল না তারা হাত দিয়ে খাবে বিফ কাবাব! কথাটা রেজা মিয়াঁর কানে এলো। বেশ বড়সড় চিন্তা তৈরি হল। তিনি বাড়ি গিয়ে তার স্ত্রী কে বললেন উপায় বের করতে৷
ভারতীয় উপমহাদেশে আজও বড় বড় শেফ ছেলেরা হলেও মেয়েরা কোন অংশে পিছিয়ে নেই। ছিলও না। তাছাড়া আর সংসারের হেঁশেলের দায়িত্ব সামলাতে হত বলে খাবার সমস্যার সমাধান বা যেকোন জুগাড় বাড়ির মহিলারাই সহজে বার করতে পারতেন৷ হাসান রেজার স্ত্রীই উপায় বাতলে দিলেন। ময়ান দিয়ে ময়দা মেখে হাল্কা তেলে গোল গোল পরোটা বানিয়ে তার মধ্যে ভরে দিলেন তুলতুলে বিফ কাবাব। আর পরোটা ধরার সময় হাতে যাতে তেল না লাগে তার জন্য উন্নত মানের ব্লটিং পেপার দিয়ে বাইরেটা মুড়ে দিলেন। তৈরি হল অভিনব কাবাব রোল। স্বাদের জন্য ভেতরে নুন লেবুও যোগ করে দিলেন৷ জানেন এই কাবাবই কাঠিতে গেঁথে তৈরি হত বলে একেই বলা হত কাঠি কাবাব।
কলকাতায় তো আর সকলে ব্রিটিশ বা মুসলিম নয়। ফলে সকলে বিফও খায় না। তাই পরবর্তীকালে সকলের জন্য চিকেন, মটন ইত্যাদির কাঠি কাবাব বানিয়েও তৈরি হল সকলের জন্য এই অভিনব খাবার। দামে সস্তা করে তুলতে ডিমের প্রচলন শুরু হয়। আর স্বাদ বাড়াতে শসা, পেঁয়াজ, সস ইত্যাদিও যোগ হয়। এখন তো আবার শুনি রোলের ভেতর মাছের পুরও দেওয়া হয়৷
এই হাসান মিয়াঁর কথা যে এতোক্ষণ বললাম ইনিই হলেন কলকাতার বিখ্যাত রেস্তোরাঁ নিজামস-এর প্রতিষ্ঠাতা৷ হ্যাঁ নানান খাদ্য ইতিহাসবিদদের মতে নিজামস থেকেই জন্ম নেয় বর্তমান কলকাতার বিখ্যাত স্ট্রিটফুড এগরোল।
বিখ্যাত ফুড ব্লগার দামু মুখোপাধ্যায় বলেন শুরুতে আলুর তরকারি দিয়েই এই এগরোল তৈরি হত৷ মানে শুরুতেই যেই গল্পটা বললাম সেরকমই। পরে মাংসের সংযোজন হয়েছে নিজামসের হাত ধরে। এবং ওই সময়ই কলকাতায় বিফ রোল সহ অন্যান্য মাংসের রোল কলকাতাকে ভোজনরসিকতার অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়৷
অনেকদিন আগে কোথায় যেন পড়েছিলাম, ঠিক মনে নেই কোন পত্রিকা বা ব্লগে সম্ভবত, এই এগরোলের সৃষ্টি আসলে চীনাদের হাত ধরে। ১৮০০ সালের দিকে চাইনিজরা রুটির ওপর ডিম দিয়ে একটি খাবার তৈরি করত। সেই সময়কার চীনে এটি বেশ বিখ্যাতও ছিল এবং ১০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রচলিত। স্প্রিং রোলে অনেকটাই এই ধরণের গঠন দেখা যেত। তাই অনেকে মনে করেন চাইনিজ স্প্রিং রোল থেকেই কলকাতায় এগরোলের আবির্ভাব হয়। ১৯১৭ সালে আমেরিকান রান্নার বইতে এগরোলের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাই অনেক খাদ্যবিদ দাবী করেন এগরোল হল চাইনিজ আমেরিকান খাবার৷ ২০১৮ সালের ১০-ই জুন প্রথম জাতীয় এগরোল দিবস পালিত হয়। জনপ্রিয় ফ্রোজেন এশিয়ান খাবার ব্র্যান্ড প্যাগোডা এই দিনটিকে জাতীয় এগরোল দিবস হিসেবে পালন করে।
বিশ্বের নানান দেশে এগরোল নানান ভাবে তৈরি হয়, ভারতের নানান প্রদেশেও পাওয়া যায় তবে কলকাতার মতো সুস্বাদু এগরোল অন্য কোথাও পাওয়া যায় বলে আমার অভিজ্ঞতায় নেই৷ আর সকলেই দেখেছি এগরোলকে কলকাতার এগরোল হিসেবেই মান্যতা দেয়।
তাই বলি, এই এগরোল কলকাতার পথঘাটে জন্মানো এমন এক খাবার, যা বাঙালির কাস্টমাইজড ফাস্ট ফুড সংস্কৃতির অন্যতম নিদর্শন। এর সরলতা, স্বাদ আর বহনযোগ্যতা একে অদ্ভুতভাবে টেকসই এবং লোকপ্রিয় করে তুলেছে। ভাবতে বেশ লাগে, যা একসময় ছিল ব্রিটিশদের “রোল” খাওয়ার অভ্যাস, আজ তা হয়ে উঠেছে বাঙালি সন্ধ্যার প্রিয় টিফিন আর প্রবাসী বাঙালিদের অন্যতম নস্টালজিয়া।