সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে নিলাম সামন্ত (পর্ব – ৩২)

মহাভারতের মহানির্মাণ (শিশুপাল)

একশ’ গুনতি যে খুব একটা লম্বা না তা বোধহয় শিশুপাল বোঝেননি। নইলে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের মহাসমারোহতে ওই আচরণ তিনি করতে পারতেন না৷ অথচ যখন আমন্ত্রণ পাঠানো হয় তখন কিন্তু বিনা বাক্য ব্যয়ে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন এবং যুধিষ্ঠিরের আধিপত্য স্বীকার করতে তাঁর কোন সমস্যাই হয়নি। সেই জায়গা থেকে একটা কথা তো স্পষ্ট যে পান্ডব বা কৌরব কারও সাথেই তাঁর দ্বন্দ্ব নেই। দ্বন্দ্ব যত তা কেবল শ্রী কৃষ্ণের সাথে। রাজসভার দৃশ্য খেয়াল করলে দেখা যায় যজ্ঞের পর যখন বিশেষ সম্মানে সম্মানিত করতে চেয়ে পান্ডবরা মহামহিম ভীষ্মর নাম প্রস্তাব করেন তখন ভীষ্মই কৃষ্ণের নাম প্রস্তাব করেন। আর সেই মুহুর্ত থেকে শিশুপালের বাক্যবাণ শুরু হয়। প্রথমে আজন্ম ব্রহ্মচারী থাকার কারণে ভীষ্মকে অপমান করেন। তারপর শুরু হয় কৃষ্ণের চরিত্র বিশ্লেষণ। কোথাও গিয়ে আমার এই জায়গায় বার বার মনে হয়েছে শিশুপাল আসলে রুক্মিণীর পালিয়ে যাওয়া হজম করতে পারেনি৷ সেই রাগ ছাই চাপা আগুনের মতো থেকে গেছে। এই যজ্ঞ সভায় কৃষ্ণকে সামনে দেখে ও সম্মানিত হতে দেখে সমস্ত রাগ জ্বালামুখীর মুখ ফেটে লাভা নির্গমনের মতো বেরিয়ে এসেছে৷ কোন ভাবেই সেই জ্বালা মিটছে না৷ যত রকম ভাবে অপমান করা যায় তার থেকেও বেশি ক্রোধ আর আক্রোশ নিয়ে অপমানিত করছেন। এমনকি শ্রীকৃষ্ণ যখন মাঝে মনে করিয়ে দিলেন একশ’ সংখ্যার সীমারেখা তখনও থামতে পারছেন না৷ ঠিক যেমন লাভা নির্গমনে আগ্নেয়গিরির কোন হাত থাকে না বা আগ্নেয়গিরির কোন শাসন থাকে না৷ এমনকি আগ্নেয়গিরি নিজেও জানে না কতটা লাভা নির্গমন হলে ক্ষান্ত হবে ভূগর্ভ। ঠিক তেমনিই শিশুপাল।

এই জায়গায় একটা কথা না বললেই নয়, শিশুপাল রক্ত মাংসের মানুষ। তাই নিজের রাশ নিজের সুবিধার্থেই কখনও কখনও টেনে রাখতে হয়। একটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যদি নিজেকেই না থামাতে পারে বা বিশ্লেষণ করতে পারে তবে বাকিরা নীরব দর্শক বা সুযোগ সন্ধানী হবে এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই৷

সেই যজ্ঞ সভায় সুযোগ-সন্ধানী তো ছিলই। কৌরবরা বসে বসে হৃদয়ের জ্বালা মেটাচ্ছিলেন৷ যতই হোক কৃষ্ণ পান্ডবদের শুভাকাঙ্ক্ষী৷ তাই শত্রুর মিত্র তো অলিখিত শত্রুই হবে তাই না?

হাজার ক্রোধ রাগ ঘৃণায় ঠাসা হলেও শিশুপাল কিন্তু পান্ডবদের এমন অদ্ভুত রাজমহল দেখে কোথাও কোন রাগ, আস্ফালন বা হীনমন্যতার পোষণ করেননি মনে৷ বরং পান্ডবদের এমন উন্নত রাজসভা দেখে খুশিই হয়েছিলেন। কিন্তু ওই যে মানুষের এমন কিছু দোষ থেকে থাকে যার ফলে কোন ভালো বা মহৎ গুণই চোখে দেখা যায় না৷ মাঝে মাঝে মনে হয়, আহা রে বেচারা, যদি রুক্মিণীকে আলগাই করতে দিতে পারত তবে এমনটা হয়তো হতো না৷

আচ্ছা রুক্মিণীর প্রতি ভালোবাসা থেকেই কি এই ব্যবহার? নাকি মানহানী? এমন শক্তিশালী মহান রাজার হবু স্ত্রী অন্য কারও হাত ধরে তৎকালীন সমাজে পালিয়ে যাচ্ছে এ প্রেমের ব্যথা কতখানি জানি না তবে আর্যাবর্তের চরম অপমানের খবর এ কথা বলাই যায়৷ শিশুপাল তো আর কোন অংশে কম বা দূর্বল রাজা ছিলেন না! তাকে শুরুতেই উপেক্ষা করা বা প্রত্যাখ্যান করা হলে হয়তো এতোখানি রাগ বা অপমানবোধ জমা হত না৷ কিন্তু বিবাহের সমস্ত আয়োজনের পর, হঠাৎ চলে যাওয়াটা শিশুপাল কেন যে কোন ছেলেরই মানে লাগবে৷ আর যে পুরুষে নিয়ে পালালো সে কি আর ক্ষমার যোগ্য? এতোখানি উদারতা মানুষের মধ্যে থাকলে হয়তো পৃথিবীটাই অন্যরকম হত। দেবতার স্পর্শ পাওয়ার জন্য মানুষকে পাথরে মাথা ঠুকতে হত না৷

এই সব লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে, মহাকবি বেদব্যাস ঠিক কতখানি দূরদর্শী! শিশুপালের চরিত্র আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে রচনা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সমাজে এই রকম শিশুপালের অভাব নেই৷ শুধু অভাব কেন বরং হিতাহিতজ্ঞানশূন্য মানুষেই ভরে গেছে সভ্যতা৷ শুধু কৃষ্ণের আগমন হয় না যে সরাসরি মৃত্যুদন্ডে শাস্তি দিতে পারবে৷

আমি জানি মৃত্যু দন্ড সব থেকে বড় দন্ড। কিন্তু কিছু অপরাধের কঠিন শাস্তি হওয়াও দরকার, যা দেখে সমাজ হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হওয়ার আগে ভাববে৷ ভাববে বাক স্বাধীনতার অপব্যবহার করা যায় না৷ সেদিনের রাজসূয় যজ্ঞের মহাসমারোহে শ্রী কৃষ্ণ যখন সুদর্শন চক্র দিয়ে শিশুপালের মাথা আর ধড় আলাদা করে দিলেন তখনও বোধহয় শিশুপাল বোঝেননি তার একশ’টা ভুল ক্ষমা অনেক ক্ষণ আগেই ঘটে গেছে। কোন একটা জায়গায় থেমে যাওয়া দরকার ছিল।

অনেকেই বলতে পারেন, লঘু দন্ডের গুরু শাস্তি। মৃত্যু দন্ড মানেই তো প্রাণ কেড়ে নেওয়া। তাই তার শোধরানোর আর কোন সুযোগ রইল না৷ আবার এও ভুলে যাই কি করে অতি বাড় বেড়ো না ঝড়ে পড়ে যাবে৷ শিশুপালের মহাভারতে কতখানি প্রয়োজন ছিল জানি না তবে তৎকালীন সমাজে এই চরম শাস্তির বিশেষ প্রয়োজন ছিল। যাতে করে কাউকে যা খুশি অপমান করার আগে অন্তত দু’এক বার ভাবে৷ সাহিত্য যে সমাজের সুশিক্ষার ধারক ও বাহক তা এই ঘটনাগুলোই বলে দেয় বার বার।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।