মেহেফিল -এ- কিসসা নুসরাত রীপা (গদ্য)

মম আলীর সাহিত্য চর্চা
১)
ম্যাম, আপনি দশ হাজার টাকা দিলেই হবে- মৃদু স্বরে হাসি মুখে বলল কালো মতন ছেলেটা। সম্ভবত বুনু নাম ওর।
সাত সকালে এক কাপ চা নিয়ে লিখতে বসেন মম আলী। কিন্তু কি বোর্ডে তার স্পীড খুবই কম। দুইঘন্টায় একপাতার মত লিখতে পারেন। তাও সব সময় সেটা সম্ভব হয় না। তিনি বয়স্ক মানুষ। তার আমলে এইসব কম্পিউটার ল্যাপটপ ছিল না। কাগজ কলমে লিখতেন। কাগজ কলমে লিখতে এখনো তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কিন্তু তিতলি, তার বড় ছেলের বউ ল্যাপটপটা উপহার দিয়ে বলেছে, মা, আপনি আধূনিক মানুষের মত চলবেন। বয়স বয়স করবেন না। এখন কেউ কাগজে লেখে না। আপনিও লিখবেন না।
আসলে ব্যাপারটা একটু খুলেই বলা যাক। মম আলীর আসল নাম মমতাজ বানু ।
ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি সাহিত্য সংস্কৃতির জগতেও সফলতা ছিল তার। স্কুল কলেজ জীবনে লেখালেখি গান কবিতা সব কিছুতেই অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু কপাল মন্দ হলে যা হয়। বাবা মায়ের কনিষ্ঠ সন্তান। বাবা নিজে বেঁচে থাকতেই মেয়েকে নিরাপদ দেখে যেতে চান আমাদের সমাজে বিয়ে হয়ে গেলে একটা মেয়ের জীবন নিরাপদ মনে করা হয়। কাজেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও মমতাজ বানু চৌধুরী রকিব আলীর সংসারে বউ হয়ে ঢুকলেন। চৌধুরী রকিব আলী সজ্জন মানুষ। মন ও মননে পরিশীলিত। ব্যবসা করেন। অর্থ বিত্ত আছে। কিন্তু তিনি উশৃঙ্খল নন। কর্ম জীবন আর পারিবারিক জীবন দুটোর প্রতিই তার প্রভূত ভালোবাসা। এমন এক জন স্বামীর কারণেই সংসার সামলেও স্বামীর সহযোগিতায় মমতাজ বানু লেখাপড়াও কমপ্লিট করছিলেন নিয়মিত ছাত্রী হিসেবেই।
যদিও ততদিনে দুটো সন্তান হয়ে গেছে মমতাজের সাহিত্য করার ব্যাপারেও স্বামীর পূর্ণ সমর্থন ছিল, তা সত্ত্বেও বাচ্চাদের মানুষের মত মানুষ করতে হলে মায়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য জেনে মমতাজ বানু সাহিত্য ও শিল্প চর্চা ছেড়ে দেন।
আল্লাহর রহমতে দুই ছেলে এক মেয়ে সবাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সবাইকে সংসারে স্থিতু করেছেন। অতঃপর এক সন্ধ্যায় চা খেতে খেতে স্বামীকে তিনি নিজের মনের কথাটা বলেই ফেললেন, এই শোন না, সারাদিন একদম অবসর আমার, কিচ্ছু করার থাকেনা। ভাবছি লেখালেখিটা আবার শুরু করবো।
চৌধুরী রকিব আলী স্ত্রীকে প্রচন্ড ভালোবাসেন। তিনি চা খাচ্ছিলেন। স্ত্রীর কথায় সাথে সাথে মত দিয়ে দিলেন। নিজে তো ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। একাকীত্ব কাটানোর জন্য স্ত্রী যদি পুরাতন প্রতিভা আবার জাগিয়ে তুলতে চান, তুলুক না। বললেন, তোমার ইচ্ছেতে কখনো বাধা দেই নাই। তোমার সাহিত্যচর্চায় আমার কোনো প্রয়োজন হলে বলবা। আমি সাধ্যমত সহযোগিতা করবো।
মায়ের নতুন করে লেখালেখি শুরু করার বিষয়টা নিয়ে বাসায় সবাই খুশি। মায়ের ঘরের পাশেই একটা মস্তো বারান্দা। বড় ছেলে মাহি সেই বারান্দার খানিকটা কাঁচে ঘিরে ইনটেরিয়র ডিজাইনার কে দিয়ে এমন ভাবে সাজিয়ে দিল যে ওঘরে ঢুকলে মনেই হয় না এটা শহুরে বাড়ির অংশ।ববং মনে হয় একটা অসম্ভব সুন্দর প্রকৃতির মাঝে বসে আছে। বড় ছেলের বউ কিনে দিল ল্যাপটপ। মেজো ছেলে কয়েক হাজার বই কিনে লাইব্রেরী করে দিল।
মোটকথা বাড়ির সবার সহযোগিতায় মমতাজ বানু আবার লিখতে শুরু করলেন। লিখেও ফেললেন বেশ কিছু গল্প কবিতা। পত্রিকায় পাঠাবেন। এসময় বাধ সাধলো মেয়ে নীহা। বলল, মমতাজ বানু একটা ক্ষ্যাত নাম। এমন নামে এখন কেউ লেখে না।
মমতাজ বানু বললেন, আমি তো পুরাতন দিনের মানুষ। আমাদের সময় এমন নামই চলতো কিন্তু নীহার এক কথা, একটা মর্ডান নাম দরকার। শেষ পর্যন্ত চিন্তা ভাবনা করে মমতাজ বানুর লেখক নাম হল মম আলী!
লেখা পাঠাচ্ছেন। ছাপা ও হচ্ছে। তবে খুব কম। সাম্প্রতিক সময়ের দুএকজনের সাথে পরিচয় হলে তারা বলল, পরিচিতি বাড়াতে।
মম আলী পর পর কয়েকটা সাহিত্যসভা করলেন বাসায়।
২)
মম আলী পত্র পত্রিকায় লিখছে এটা পাড়ার সাহিত্য ক্লাবের ছেলেপেলেরাও জেনে গেল। তারা সকাল বিকাল
দলবেঁধে আসতে লাগলো চৌধুরী রকিব আলীর মাটিরঘরে!
মম আলী মেলাদিন লিখেন নি। লেখালেখির নিয়ম নীতিতে মেলা পরিবর্তন এসেছে। আধুনিক সাহিত্য সম্পর্কে তার জানাশোনা কম। বাসায় সাহিত্য ক্লাবের ছেলেপেলেরা এলে বর্তমান ধারা সম্পর্কে জানতে পারবেন, মম আলী তাই বাসায় তাদের আসা যাওয়া অবাধ করে দিলেন। বাবুর্চিকে বলে দিলেন এই সব কিশোর তরুণদের আপ্যায়নে যেন কোন ত্রুটি না হয়।
ক্লাবে ষোলই ডিসেম্বর আর একুশে ফেব্রুআরিতে দুটো প্রোগ্রাম হল। ছেলের দল মোটা অংকের চাঁদা নিল মম আলীর কাছ থেকে। একটায় তাকে বিশেষ অতিথি করা হল।
৩)
মম আলী আজ সকালে লিখতে বসেছেন, ঠিক তখুনি খবর গেল সাহিত্য ক্লাবের ছেলেরা এসেছে। সম্প্রতি মম আলী ছেলেগুলো এলে আর আগ্রহ ভরে এগিয়ে যান না। কারণ তারা এসে সাহিত্য বিষয়ে মম আলীর সাথে কোন কথা বলে না। তারা নিজেরা নানা গল্প করে, নাস্তাপানি খায়।, মম আলীর লাইব্রেরীর বই ঘাঁটাঘাটি করে, পড়ে তারপর চলে যায়। মম আলীর সাথে তারা কথা টথা বলে না সাহিত্য আলোচনা তো দূরে থাক।
মম আলী প্রথমে ভেবেছিলেন সংকোচ কিন্তু পরে বুঝেছেন সংকোচ নয়, এটা অন্য কিছু! তিনি তাই এখন আর ছুটে যান না। ছেলের দল আসে যায়, তাদের মত।
মম আলী নিজের মত লেখেন, পড়েন। তার মেজ ছেলের বউ তার লেখার প্রথম পাঠক ও শ্রোতা।
মম আলীকে সে লেখা বিষয়ে টুকটাক পরামর্শ দেয়। আজও মেজ বৌমা পাশে বসে গত রাতে লেখা একটা কবিতা পড়ছিল। সাহিত্য ক্লাবের ছেলেরা এসেছে শুনে শাশুড়ির সাথে সেও বসার ঘরে এসেছে।
ছেলেদের মধ্যে একজন, লম্বা ফর্সা করে, যার এরই মধ্যে তিন চারটে বই বের হয়ে গেছে সে বলল, আগামী সপ্তাহে তারা একটা সাহিত্য সভার আয়োজন করতে চায়। মম আলীকে সেই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তারা এই সুখবরটাই জানাতে এসেছে। আর মম আলীকে অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য সহযোগিতা হিসাবে দশ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হবে কারণ আয়োজকরা প্রায় সবাই বেকার বা ছাত্র!
মম আলী একটু চুপ করে রইলেন। ষোলই ডিসেম্বরের প্রোগ্রামে তিনি বিশেষ অতিথি ছিলেন। তার কাজ ছিল অনুষ্ঠান শেষে ধন্যবাদ দিয়ে বক্তব্য দেওয়া কিন্তু অনুষ্ঠান শেষে দেখা গেলো মম আলী আর আয়োজকদের কয়জন ছাড়া আর কেউ নেই। খালি অডিয়্যান্সে নিয়ম রক্ষার বক্তব্য দিয়ে চলে এসেছিলেন মম আলী।
একটু চুপ থেকে মম আলী বললেন, একটা ম্যাগাজিন বের করার কথা ছিল।
হ্যা বের হয়েছে তো।ছেলেদের একজন বলল।
আর একজন কাঁধের ঝোলা থেকে একটা একশ পৃষ্ঠর ডিমাই সাইজ বই বের করে মম আলীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই যে–
মম আলী পত্রিকাটা উল্টেপাল্টে দেখলেন। এ পত্রিকার জন্য ডোনেশন নিতে এসে ছেলেরা তার দুটো কবিতাও প্রকাশের জন্য নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কবিতা দুটো ছাপে নি।
মম আলী বললেন, আমার কবিতা দুটো ছাপোনি?
আপনি লেখা দিয়েছিলেন?
হুমম। ডোনেশনের সাথে দুটো লেখা তোমরাই চেয়ে নিয়েছিলে–
আন্টি, সরি। মিসটেক হয়ে গেছে।
মম আলী ধনী ব্যবসায়ীর স্ত্রী আর একজন সুখি গৃহবধূ হিসাবে গা ভাসিয়ে জীবন কাটাননি, নিজের শিক্ষা আর মেধাও কাজে লাগিয়েছেন প্রয়োজনে। তিনি বুদ্ধিমতি।
মৃদু হেসে বললেন, বিশেষ অতিথি হওয়ার সময় হবে না আমার। সরি। তারপর সোফা ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন, দশ হাজার ডোনেশন দিতে পারব না, বসো দু হাজার পাঠিয়ে দিচ্ছি!
মেজো বৌমা বলল, মা গেলে ভালো হত। অনেক সাহিত্যকর্মী আসবেন।
মম আলী হেসে বললেন, মা গো সাহিত্য করতে এসেছি মনের আনন্দে। তোমার শ্বশুরের টাকা দিয়ে বিলাসিতা করতে নয়।