কর্ণফুলির গল্প বলা সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে নুসরাত রীপা (পর্ব – ১)

কখনো এমনও হয়
১)
জল নয়, যেন শেওলা সবুজ চাদর বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে পুকুরের ওপর।এমনই সবুজ আর শান্ত-স্থির পুকুরের জল। চারিদিকে গাছগাছালি, আগাছা,লতা-পাতা-গুল্ম বর্ষার ছোঁয়া পেয়ে আরো সতেজ আরো নিবিড় হয়ে উঠেছে। পুকুরের ধার দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ে রাফিয়া। সবুজের যে কত ধরণ হতে পারে এই পুকুরের ধারে শ্যাওলা পড়া,পিচ্ছিল, সময়ের আঘাতে ক্ষত ইট-সিমেন্টের ঘাটলার সামনে দাঁড়িয়ে সেই শৈশবের মতো আজো রাফিয়ার বিস্ময় কাটে না।
পুকুরে এদিক ওদিক থোকা থোকা শাপলা লতা। দু’য়েকটা ফুল, কয়েকটা কলি মাথা উচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে রাফিয়া। সেই সাদা হাফ হাতা গেঞ্জি, চোখে রিমলেস চশমা পড়ে শাপলা লতার ঝাড়টাকে ঠেলে দিচ্ছে পলক। বুক অব্দি জলে ডোবা। নিশ্চয়ই গোসল করতে এসেছে। ‘ হাঁদাটা চশমা পড়েই গোসল করবে না কী! ‘- মনে মনে বলে রাফিয়া।
দুলালপুর গাঁয়ের সবচে’ বিস্ময়ের বিষয় পাশাপাশি দুই চৌধুরী বাড়ি যার একটি হিন্দু বাড়ি অন্যটি মুসলিম। বর্তমানে এর একটার মালিক গৌতম চৌধুরী এবং অন্যটার মুুকুল চৌধুরীর । লোকমুখে শোনা যায় দুই চৌধুরী একই বংশের। সে সব অন্য গল্প। দুই চৌধুরী বড়িই বিশাল এলাকা পরিব্যাপ্ত। একটার পেছনে বিশাল ফল বাগান আর অন্যটার দীঘির মতো বড় এই পদ্মপুকুর।
শৈশবে রাফিয়া যখন পাড়ার সমবয়সী দের সাথে বাগানে খেলাধূলা করতো তখন সেই সমবয়সীদের ভীড়ে গৌতম চৌধুরীর ছোট ছেলে পলকও থাকত। ছেলেটা সেই সময় থেকেই একটু ভাবুক প্রকৃতির। খেলতে আসতো,খেলার দলে থাকত, কিন্তু চুপচাপ। চঞ্চল আর নেতা টাইপ চরিত্রের রাফিয়ার পলক কে বেশ ভালো লাগত।কারণ, চুপচাপ শান্ত ছেলেটা রাফিয়ার সব নির্দেশ বিনা প্রতিবাদে মেনে নিত।
খেলতে খেলতে হঠাৎ দলচ্যুত হয়ে পড়া পলককে খুঁজে পাওয়া যেত পুকুরের ঘাটলায়। চুপচাপ বসে থাকত। আনমনা হয়ে। যেন সমস্ত পৃথিবীকে নিয়ে ভাবার গুরু দায়িত্ব ওর ওপরই অর্পিত।
রাফিয়া ওর পাশে বসে জিজ্ঞেস করত- কী করিস?
যেন অনেক দূর থেকে ফিরে এল এমনি কন্ঠে পলক বলত- কিছু বললি?
সেই সময়েই কোন কোন দিন,শরতের ধূসর দুপুরে,স্কুলে পূজোর ছুটি,বাগানে ছেলে মেয়েদের একঘেয়ে রান্নাবাটি বা বউ বউ খেলা বাদ দিয়ে পলকের সাথে পুকুর পাড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকত রাফিয়া। পলকের মতো তাকিয়ে থাকত পুকুরের সবুজ জলে অথবা পুকুরের উল্টোপাড়ে গাছ গাছালির রহস্যময় ভীড়ে। রাফিয়া বুঝতো না পলক কী দেখে।
একদিন রাফিয়া জিজ্ঞেস করল, তুই কী দেখিস?
দেখেছিস কী রকম সবুজ রং গুলে দিয়েছে গাছগুলো পুকুরের জলে।
তোর এমন মনে হল কেন?
বাহ্। তুই পড়িস নি নীল জলের কথা? সবুজ জল- পড়েছিস কখনো?
পলকের কথা ভাবায় রাফিয়াকে।
রাফিয়া পুকুরের জল দেখে। পুকুরের ধার ঘেঁষা গাছ গাছালি লতা গুল্ম দেখে।
ওরা ঘুরে বেড়ায় পুকুর পাড়ে, বাগানে। অবাক বিস্ময়ে দেখে টিয়ে সবুজ, নীলচে সবুজ, কালচে সবুজ, ধান সবুজ- আর দেখতে দেখতে আবিষ্কার করে সবুজের বৈচিত্র্য। এবং খেয়াল করে সবুজের মতো আর কোন দরং এর এত ভিন্নতা নেই। রাফিয়া সবুজের প্রেমে পড়ে যায়। আর তখন থেকেই সবুজ রং রাফিয়ার প্রিয়। ঈদে,পরবে বা অন্য সময় পোষাক কেনার কথা উঠলেই রাফিয়া বলত, মা আমি কিন্তু সবুজ রং এর জামা নিব!
পলকের সাথে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে রাফিয়ার নেতা ভাব টা কখন হারিয়ে যায়। শান্ত চুপচাপ পলককে বরং ওর অবাক লাগে। পলকের কাছ থেকে ও শেখে ছোট্ট ঘাসফুলেরও সৌন্দর্য আছে।
গাঁদা ফুলের সুবাস নিতে ও শেখে পলকের কাছেই। জাম পাতার মিষ্টি গন্ধ,হিজল ফুল ঝরে পড়লে কেমন কার্পেটের মতো দেখায় আর অঝোর বৃষ্টির জলে কিংবা মাটির ও যে একটা নিজস্ব আপন মিঠে গন্ধ আছে, সেইসব গন্ধে যে মাতাল নেশা ধরে এসব কিছু রাফিয়া জানতে পারে পলকের কাছ থেকেই।
আজ এতগুলো বছর পর পলককে দেখে রাফিয়ার ভালো লাগে। ও চিৎকার করে ডাক দেয়, এ্যাই পলক, শাপলা ঠেলছিস ক্যান? বৃষ্টি এলে আবার ছড়িয়ে যাবে।
পলক কোনো উত্তর দেয় না।
রাফিয়া আবার বলে,হাঁদারাম আমাকে চিনতে পারছিস না? আমি রাফি।রাফিয়া।
পলক যেন এবার রাফিয়াকে শুনতে পায়। ও হাত তুলে এমন ভঙ্গী করে যার মানে,অপেক্ষা কর। আসছি।
তারপর আবার দু’হাত দিয়ে শাপলা লতার গুচ্ছটাকে সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
পুকুরের ঘাটলায় বসে সেদিকে তাকিয়ে থাকে রাফিয়া।
২)
ক্লাস সেভেনে স্কুলে সেকশন ভাগাভাগি হয়ে যায়। শিফটও। মেয়েদের স্কুল মর্নিং শিফটে আর ছেলেদের ডে শিফটে। পলকের সাথে রাফিয়ার আজকাল আর তেমন দেখা হয় না। এখন আর বন্ধের দিন বা বিকেলে খেলতে যাওয়া হয় না। বই পড়া এখন রাফিয়ার নেশা। সময় পেলে বই পড়ে। বই কেনে, পরিচিত জন বা লাইব্রেরী থেকে আনে। পলকের সাথে বই এর লেনদেন ও হয় ইংলিশ কোচিং এ। রাফিয়া অনেকগুলো সাবজেক্টের কোচিং করলেও পলকের বাবা ম্যাথের টিচার হওয়ায় আর ওর বড়দা সায়েন্স এর ছাত্র হওয়ায় সে কেবল ইংলিশ কোচিং ই করে। ছেলেটা বরাবরই লাজুক, চুপচাপ। রাফিয়া যেচে কথা না বললে সে কিছু বলে না। রাফিয়াও রোজ রোজ নিজ থেকে কথা বললে ভালো দেখায় না, সহপাঠীরা হাসাহাসি করে বলে কথা বলে না। ফলে অমুক বইটা আছে? নতুন কিছু কিনেছো বা ঐ বইটা কবে দেবে – এই রকম কথা ছাড়া দু’জনের আর কোনো কথা হয় না।
সময়ের নিয়ম বয়ে যাওয়া। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা করে সময় বয়ে যায়। ওরা তখন নবম শ্রেণীতে। রাফিয়া ভালো ছাত্রী। ভালো ছাত্রী নামটা ধরে রাখতে ও কঠোর পরিশ্রম করে দিন রাত। পাঠ্য বই। বাইরের বই, গান,আরবী শেখা এসবের মধ্যে একটা নিজস্ব জগতে বাঁধা পড়ে যায় রাফিয়া।
পলক পড়াশোনায় উদাসীন। সে মাঝে মধ্যেই স্কুল ফাঁকি দেয়।টিফিন পিরিয়ডের পর স্কুল পালানোর কারণে বাসায় এবং হেড স্যারের কাছে মার খাওয়ার খবরও মাঝে মাঝে রাফিয়ার কানে আসে। তারপর একদিন দুজনে স্কুলের গন্ডিও পেরোয়।
পলক আজকাল কবিতা লেখে। স্থানীয় পত্রিকা এবং জাতীয় দৈনিকে তার একটা লেখা ছাপা হয়েছে।শুনে রাফিয়ার ভারী ভালো লাগে। একদিন কলেজ ফেরতা পথে পলকদের বাসায় গিয়ে রাফিয়া শুনে পলক বাসায় নেই। ছোটবেলা থেকেই আসা যাওয়া থাকায় এ বাড়ির ঘর দোর রাফিয়ার চেনা। ও পলকের ঘরে ঢুকে পড়ার টেবিলের ওপর এক টুকরো কাগজে লিখলো, ‘কবিতা লিখছিস। ভালো কথা। পড়াশোনাটা করিস। পড়াশোনাটা না করলে ভালো কবি হতে পারবি না। আর তোর দেখা পাই না যে? লেখা কবিতা পড়তে দিস।রাফি। ‘
ডিসেম্বরের সাত তারিখ
ডিসেম্বরের সাত তারিখ রাফিয়ার জন্মদিন। বাড়িতে মোরগ পোলাও ইত্যাদি রান্না হচ্ছে। বারান্দায় বসে রাফিয়া বরই খাচ্ছিল। এমন সময় বড় ভাইয়ের মেয়ে টুকু এসে রাফিয়ার হাতে একটা টুকটুকে লাল খাম দিল। কে দিয়েছে জিজ্ঞেস করতে টুকু বলল,পলক মামা!
সেই চিঠি হাতে নিয়ে বুক ধড়ফড় করতে শুরু করল রাফিয়ার। বাসার কেউ দেখে ফেললে কী না কী ভেবে বসে!কেউ দেখার আগেই দ্রুত সেটা লুকিয়ে ফেলল
রাফিয়া। খুলে পড়ার কথা মাথাতেই এল না।
কিন্তু চিঠির খামটা দেখে রাফিয়া আন্দাজ করল ওটা একটা প্রেমপত্র। আর পলক এটা দিয়েছে ভেবে হাসিও পেল খুব।
সে সন্ধ্যাতে বাগানে একা একা বসেছিল রাফিয়া। হঠাৎ পলক এসে সামনে দাঁড়ালো। রাগ করেছিস? জিজ্ঞেস করল ফ্যাসফ্যাসে ভীতু কণ্ঠে। রাফিয়া একটু ভাব নিল। চিঠিটা পড়েনি, বুঝতে দিল না।বলল, তুই চিঠি লিখলি কোন সাহসে? আমাদের ধর্ম আলাদা, তুই জানিস না?
খপ করে রাফিয়ার একটা হাত ধরে ফেলল পলক। বিশ্বাস কর ধর্ম টর্মের কথা আমি ভাবি না। কেবল আমি তোকে অনেক অনেক–
গভীর, উষ্ণ সে স্পর্শে চমকে উঠল রাফিয়া। এক ঝটকায় সে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চলে এল ঘরে।