গল্পেরা জোনাকি তে নীল মিত্র

রয়েল বেঙ্গল টাইগার
নীল আজ ফিরেছে কাজিরাঙ্গা অরণ্য থেকে। বন দপ্তরের অফিসার নীল মিত্র। কলেজ শেষ করে এই চাকরি নিয়ে সে এখন আসামে থাকে। কলেজ জীবনের বন্ধু জোসেফ গোমস। খুব ভালো বন্ধুত্ত্ব ওদের। ওদের সখ গুলো ও খুব মেলে। দুজনেই অরণ্যে যেতে ভালোবাসে। কিছু অরণ্যে ওরা সাথেও গিয়েছে কলেজে থাকতে। আজ জোসেফ এর কথা মনে পড়তে নীল ওকে চিঠি লিখতে বসেছে।
প্রিয় জোসেফ, আশা করি তুমি ভালো আছো। অনেকদিন তোমার সাথে দেখা হয় নি। সেই কলেজ শেষ করে তুমি গোয়া চলে গেলে। তোমার খুব অরণ্য দেখার সখ ছিল। জানো আমি কিছু দিন আগে কাজিরাঙ্গার অরণ্যে গিয়ে ছিলাম। তাই তোমার কথা খুব মনে করেছি। কাজিরাঙ্গা অরণ্য দেখার জন্য অনেক মানুষ যায় প্রতি বছর। তবে যে জায়গা গুলো দেখানো হয় তা অরণ্যের একদম শুরুর জায়গা। ওখানে কিছু গন্ডার, হরিণ আর ভাগ্য খুব ভালো থাকলে হাতির দেখা মেলে। আসল অরণ্য অনেকটাই পর থেকে শুরু হয়। আমার সুযোগ হয়েছিল সেই গভীর অরণ্যে ঢোকার। চারিদিকে ঘন জঙ্গল, কতো বড় বড় গাছ আর লম্বা ঘাসের প্রজাতি। মাঝে মাঝে জলাশয়। রীতিমতো গা ঝমঝম করে অরণ্যের যতো ভিতরে ঢুকবে।
হাতির পিঠে চেপে আমি ও আরও ৩জন অফিসের সহকর্মী গিয়েছিলাম। বন দপ্তরের কর্মী বলে আমাদের কেউ বাঁধা দেয়নি। অনেকটা ভিতরে ঢোকার পর একটা হুম হুম আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। আমরা বুঝলাম নিশ্চয়ই আমাদের খুব কাছাকাছি রয়েল বেঙ্গল টাইগার আছে। তাই একটু সাবধান হয়ে গেলাম আমরা। নিজেদের অস্ত্র গুলো হাতে নিয়ে এগোতে থাকলাম। আর ও কিছুটা পথ যেতে আমরা অরণ্যের ঘন জঙ্গলের মাঝে একটি প্রায় ১২ ফুট লম্বা বাঘ দেখতে পেলাম। কি সুন্দর তার গায়ের রঙ। হলুদের ওপর কালো বড় বড় দাগ। অপূর্ব সুন্দর সৃষ্টি ঈশ্বরের। ভয়ঙ্কর এর মাঝেও এতো সৌন্দর্য্য।
সামনে যেতে দেখতে পেলাম হয়তো বাঘটা মারামারি করতে গিয়ে আহত হয়েছে, পায়ে বড় আঘাতের দাগ। এখনও রক্ত বেড়িয়ে আসছে। ও উঠতে পারছে না, আমাদের দেখেও উঠল না। যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে। আমরা জাল ফেলে ওকে আটকালাম। তারপর ওর চিকিৎসা করা হোল। এতো বড় ও ভয়ঙ্কর বাঘটা করুণ ভাবে তাকিয়ে দেখতে থাকল। ও যেন বুঝতে পারছিল আমরা ওর ভালোর জন্যই চিকিৎসা করছি। অরণ্যের ভয়ঙ্কর জানোয়ার-রা ও বোঝে কে ওর বন্ধু আর কে শত্রু। চিকিৎসার পর যখন বাঘটাকে আবার অরণ্যের মধ্যে ছেড়ে দিলাম ও একবার পিছন ফিরে আমাদের দেখে গভীর অরণ্যে ঢুকে গেল। যেন আমাদের ধন্যবাদ জানিয়ে গেল।
তুমি সাথে থাকলে তুমিও খুব সুন্দর একটি অরণ্যে কাটানো সময় উপভোগ করতে পারতে। ইতি, বন্ধু নীল।
এই ঘটনা ঘটে গেছে বেশ কিছু দিন হয়ে গেছে। নীল তার ফরেষ্ট বাংলোয় একাই থাকে। সেদিন হঠাৎ লোকজনের চিৎকার শুনে বাইরে এসে দেখে গ্রামের বাসিন্দারা ওর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বলছে – ফরেষ্ট বাবু লোকালয়ে বাঘ ঢুকেছে, আমাদের বাঁচান। তাই বন্দুকটা সাথে নিয়ে বেড়িয়ে পরলো নীল। কিছুদূর যেতেই দেখতে পেলো একটা বড় বাঘ একটা বাড়ির উঠানে বসে আছে। ওর খিদে পেয়েছে বলে মনে হলো না, ও শিকার করতে আসেনি লোকালয়ে। তবে কেনো অরণ্য ছেড়ে এসেছে বাঘটা! বাঘটা-কে ঘুম পাড়ানি গুলি মারলো নীল। একটু ছটপট করে বাঘটা ঘুমিয়ে যেতে নীল ওর কাছে গিয়ে দেখল এটা তো সেই বাঘটা যাকে ওরা চিকিৎসা করে ছেড়ে দিয়েছিল। ওর পায়ের ঘা-টা শুকিয়ে গেছে কিন্তু দাগটা স্পষ্ট রয়ে গেছে। তারপর ওকে গাড়িতে চাপিয়ে অরণ্যের দিকে নিয়ে গেল নীল। গ্রামের বাসিন্দারা ভয়মুক্ত হোল। ঘুমের ওষুধের নেশা কাটতেই বাঘটা জেগে গেল। খাঁচার ভিতর থেকে বাঘটা নীল এর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। নীল খাঁচার কাছে যেতেই বাঘটা ওর কাছে আসার জন্য উঠে দাঁড়াল। নীল একটুকরো মাংস ওকে খেতে দিল। তৃপ্তি করে খেয়ে ও তাকালো। নীল বুঝতে পারলো বাঘটা খুশি হয়েছে ওকে দেখে। নীল খাঁচার কাছে যেতে বাঘটা খাঁচার ভিতর থেকে জিভটা বার করে নীলের হাতে চাটতে লাগল। নীল বুঝতে পারলো বাঘটা শিকার করতে আসেনি আজ, ও নীলের সাথে দেখা করে ওকে ধন্যবাদ জানাতেই এসেছে। অরণ্যের হিংস্র জীব ও যে তার উপর করা উপকার ভোলে না সেটা দেখে অবাক হোল। আমরা মানুষরা কারোর করা উপকার সহজে ভুলে যাই কিন্তু জীবজন্তু তা মনে রাখে।