ক্যাফে এক মাসের গল্পে নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত

অহিংসা পরম ধম্ম

(লেখাটি সম্পূর্ণ কল্পনা প্রসুত। ঐতিহাসিক নয়। )

চন্দ্রহীন সন্ধ্যা।বাতাসে তখনো সূর্যের প্রবল উত্তাপের গন্ধ। অশ্বারোহীরা এতটা উত্তাপের কথা চিন্তা করেনি।দীর্ঘপথে জলের দেখা নাই।অবশেষে এই শীর্ণ নদী খাত।মাধব চারখানি অশ্বকে জলপান করাবার জন্যে, মজে আসা নদীর ধারার ঢালুতে নেমে গেছে । পেছনে অন্য তিন জন।সারাদিনের দীর্ঘ যাত্রা শেষে এই অজানা গ্রামের পাশে বিশ্রাম নেবার সিধান্ত নিল মাধবের প্রভু জয়সেন।জয়সেন কে রাজা ডেকেছেন দক্ষিনের দ্বীপরাজ্যে গমনের সময়, রাজপুত্রের সাথে যাবার জন্যে। জয়সেন রাজার অন্যতম সহায়ক তার প্রতিপত্তি যথেষ্ট তবু সে সন্তুষ্ট নয়।রাজা ভগবান বুদ্ধের শরণে এসেছেন। জয়সেন দেবী পুজক। তার পক্ষে এই ‘অহিংসা’ মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই মাধবের প্রভুকে নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকে, রাজাদেশ কে অশ্রদ্ধা করা অশুভকর হতে পারে। অন্য যে দুজন আছে তার মধ্যে একজন সহায়ক উদ্ভব, অন্যজন দেহরক্ষী দীর্ঘবাহু।তারা জয়সেনের সাথে সে ভাবে লিপ্ত নয়। কিন্তু মাধব জানে জয়সেনের জীবনের বহু দুঃখ, বহু ভ্রান্তি। রাজার সাথে মতের মিল না হলেও, সে রাজাকে ত্যাগ করে না। একসময় রাজা তাঁকে বড় স্নেহ করতেন।জয়সেন তার দক্ষতা আর বীরত্ব দিয়ে সকলের সমীহ আদায় করে থাকে। মাধবকে অকারণে প্রচুর তিরস্কার করে, তবু মাধব ভিন্ন আর কারো ওপরে জয়সেন নির্ভর করতে পারে না। জলপান করে নদীর জলে গা ডুবিয়ে বসে রইল সকলেই।আকাশে ছোট ছোট আলোর বিন্দুর মতো তারা উঠছে।সূর্যাস্ত হয়ে যাবার ফলে উত্তাপ ধীরে ধীরে কমে আসছে। সম্পূর্ণ নগ্নদেহে জল থেকে উঠে দাঁড়াল জয়সেন।আজ তার এই বিরাট আকাশের নীচে বড় আনন্দ হচ্ছে। মাধব আর উদ্ধব গ্রামে খাদ্যের জন্যে যাবে স্থির করল।গ্রাম্য মদিরার খোঁজ করতে বলল জয়সেন। চমকে উঠল মাধব। সে জানে মদিরা আসল কথা নয়। আসলে আজ প্রভুর নারীর খুব প্রয়োজন। এই গ্রামে নারী খুঁজলে গ্রামবাসীর হাতের প্রহার নিশ্চিত। কোন বণিক প্রধান অঞ্চল,কিংবা যোদ্ধাদের থাকার জায়গা হলে আসেপাশে খুব স্বাভাবিক ভাবেই পেশাদার বিনোদিনী পাওয়া যায়। সামান্য গুটি কয়েক ঘরের জনপদ। এখানে খোঁজ করবে কি করে! উদ্ধব ব্যাপারটা আন্দাজ করে।“স্যাঙ্গাত হে, তুমি খোঁজ কর, আমি খাবার আর মদিরা সব জোগাড় করে ,কাঁধে করে একাই নিয়ে চলে যাচ্ছি।” খ্যা খ্যা করে দাঁত বার করে হাসতে থাকে সে।খুব অদ্ভুত ভাবে খাদ্য আর মদিরা দুই অনায়াসে পাওয়া যায়। ছোট একটি উঠান ওয়ালা ঘরের সামনে বসে থাকা একজন ধূমপায়ী কে বলে ফেলল মাধব, তাদের “নারীর প্রয়োজন” । লোকটি উদাসীন ভাবে এক বৃদ্ধা কে নির্দেশ করল। বৃদ্ধা ঘরে ঢুকে গেল । একটি রোগা কন্যা কে নিয়ে এল। সে ঘুম ভেঙ্গে উঠে চোখ মুছতে মুছতে পরনের কাপড় ঠিক করতে করতে মাধবদের সাথে যাত্রা শুরু করল। মাথায় চুড়ো করে চুল বাঁধা। মাথায় বেশ ছোট। চেহারা দেখে মনে হল এখনো ঠিক বড় হয়নি।

মদিরা আর খাদ্য পেটে যেতেই চনমনে হয়ে উঠেছে জয়সেন। আজ সে পুরুষ। শুকনো ঘাসের একটা শোবার জায়গা করে দিয়েছে উদ্ধব। মেয়েটিকে পাঠাল মাধব। এবার একটু দুরের ঝোপের আড়ালে সে আর উদ্ধব গড়িয়ে নেবে। কাল আবার দীর্ঘ যাত্রা। উদ্ধব কেবল ফিকফিক করে হাসে। তার পৌরুষ একটুতেই টলে যায়। সে অন্ধকারে একায় হাতের মুঠোয় সম্ভোগ করে । মাধবের আজকাল অত দ্রুত ইচ্ছা হয় না। সে চোখ বোজার চেষ্টা করে। দেহরক্ষী দীর্ঘবাহু বহুক্ষন নাক ডাকছে । প্রচুর জোনাকি। মাটি থেকে ভাপ উঠলেও, এতো ক্লান্তি যে ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসছে। আচমকা চিৎকারে মাধব আর দীর্ঘবাহু তড়িঘড়ি উঠে পড়ে।জয়সেন চিৎকার করছে, “ তুমি এ কাকে এনেছ মাধব। একটা পুচকে মেয়ে। এ কে ফেরত দিয়ে এসো। আমার শক্ত সমর্থ কাউকে চাই। এ তো কিছু জানে না।রমণী বোঝ? যার ক্ষমতা আছে আমাকে নেবার।” মেয়েটি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে মাধব আরও একটা মশাল জ্বালায় মেয়েটিকে উঠতে বলে। জয়সেন কে মৃদু সে স্বরে বলে, “প্রভু আপনার উপযুক্ত এখানে কাউকে পাচ্ছি না,ক্ষমা করবেন।” জয়সেন নিজের আচরণে একটু লজ্জিত হয়। “একে সাবধানে রেখে এসো” । মাধব জানে জয়সেন আসলে একাধারে বীর যোদ্ধা, নিষ্ঠুর, অকারণ জেদি অন্যদিকে কোথাও খুব একা একজন।হয়ত তার প্রেমের প্রয়োজন হয়!

মেয়েটিকে ফেরত দিতে গিয়ে অবাক হয়ে যায় মাধব। সেই বৃদ্ধা খুব দুঃখিত হয়ে যায়। অতিথির ঠিক মত সম্মান করা গেল না। মাধব অবাক হয় আর বুঝতে পারে, সে জনপদটিকে গৃহস্থ আবাস মনে করছিল আসলে তা নয়।মশালের আলোয় রাস্তা দেখে দেখে ফিরে যাওয়ার সময় মাধব বুঝতে পারল তার পেছনে কেউ আসছে। সে সাবধান হল। তড়িৎ গতিতে ঘুরে দাঁড়ায় মাধব। পেছনে একটি নারী মূর্তি। সে খল খল করে হেসে ওঠে। মাধবের যোদ্ধা সুলভ কাঠিন্য আহত হয়। “কে তুমি?” ঢোঁক গিলে শুকনো গলায় মাধব জিজ্ঞাসা করে। “ আমাকে নিয়ে চল ,তোমার প্রভুর কাছে।আমি পারবো” নারী কন্ঠে দাপটের সুর। কণ্ঠস্বরে কি একটা চেনা ব্যাপার আছে। কিন্তু মুখাবরনের আড়ালে মুখটি দেখতে পায়না মাধব। মন কেমন করা একটা ভাব এনে দিল। পায়ের তলায় অসমতল মাটির ওপর হাঁটতে হাঁটতে ফিরছে মাধব। গাছে কি এক অদ্ভুত ফুলের গন্ধ।যখন গ্রামে গিয়েছিল তখন এই গন্ধ পায়নি তো!বাতাস তাহলে পূর্ব থেকে বইছে। বৃষ্টি হবে কিছুদিনের মধ্যে।

অন্ধকারে জয়সেনের বিরাট দেহ নিয়ে পায়চারি করার আবছায়া অবয়ব দেখা গেল।নারী কণ্ঠ বলল, “তুমি গিয়ে বল অপেক্ষা করতে, আমি আসছি। মশাল নিভিয়ে দাও। দূরে চলে যাও।” মাধব অন্য সময় হলে এর কথা শুনত না। সে আজ যেন ভেসে যাচ্ছে। যন্ত্রের মত জয়সেন কে এই কথা নিবেদন করে আড়ালে চলে গেল। মশাল নিভিয়ে দেওয়াতে অন্ধকার গাঢ় হল।জয়সেনের শরীরের খুব কাছে একটি নিঃশ্বাস ফেলার হাল্কা শব্দ। জয়সেন অবাক হয়।দুহাত এগিয়ে নারীদেহ স্পর্শ করে। হাতের আঙুলে আঙুল লাগতেই জয়সেনের অপূর্ব এক আনন্দ হয়। নারীদেহ খুব কাছে আসে। বহু নারী সঙ্গ করেছে জয়সেন। কিন্তু এ নারী শুধু দেহ নিয়ে আসেনি। কোথাও যেন সেই কিশোর বেলার কদম্বগন্ধী প্রেম। নারী জয়সেনের বুকে মাথা রাখে। গ্রাম্য রমণীর মাথার চুলে এ কোন ফুলের গন্ধ! গভীর চুম্বনে এ কোন মানবী। এ ওষ্ঠ কি জয়সেন আগে পাণ করেছে?সারা শরীর জুড়ে প্রেম নামে। শুধু স্তন, জঘন,যোনি নয়, জয়সেন ঘোর অন্ধকারে এ অজানিত নারীদেহ থেকে হৃদয় জুড়ে কাউকে পায়। যেন কতকালের চেনা কেউ অপেক্ষায় ছিল তার জন্যে। “ তোমার মুখ দেখতে চাই আমি” চুম্বন শেষে জয়সেন বলে । জয়সেনের প্রসারিত বুকে হাত রেখে নারী বলে , “ না দেখায় ভালো, অন্ধকারে অনেক কিছু বেশী সুন্দর হয়ে ওঠে। যেমন তোমাকে আমি দেখেছি স্নান করার সময়। তখন যত ভালো লেগেছিল তার চেয়ে অনেক গুণ ভালো লাগছে।”পরিহাসে এ নারী দক্ষ, ভয় পায় না। জয়সেন দুহাত দিয়ে তার মুখ তুলে ধরে হাতে।দেখবার চেষ্টা করে তার মুখের অবয়ব। খুব দ্রুত হাত সরিয়ে দেয় সে,“ এবার আমি ফিরবো। তুমি ঘুমিয়ে পড়।” জয়সেন হাত চেপে ধরে, “এতো তাড়াতাড়ি তোমায় ছাড়ি কি করে? ভোরবেলা আমি তোমায় ঘরে দিয়ে আসব। তোমার বাড়ির লোকেদের বলব আমার তোমাকে পছন্দ হয়েছে।আমি তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যেতে চাই” । “আমি তোমার সাথে যেতে চাই না।” নারী মধুস্বরে বলে ওঠে। জয়সেন দুহাতে তাকে আবার ধারণ করে,আবার উপগত হয়। যেমন দিগন্তরেখা তে ভুমি আর আকাশ মিশে যায়।

ঘুম ভাঙে জয়সেনের। সূর্য উঠে গেছে। ঘোড়া প্রস্তুত করে মাধব দাঁড়িয়ে আছে। জয়সেন বিরক্ত হয়। এতো দেরী হওয়া ঠিক হল না। সে সকালে পূজা করে। এখন পুজার সময় নেই । খুব দ্রুত তৈরি হল সে। রাতে একজন নারী যে তার কাছে এসেছিল, সেটা এখন নিছক স্বপ্ন। শিশির যেমন সূর্যালোকে অস্তিত্বহীন হয় এই নারীর ও আর কোন ছাপ নেই। চারটি ঘোড়া পূর্ব দিকে রওনা দিল।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।