গ এ গদ্যে নন্দিনী চট্টোপাধ্যায়

লেখক পেশায় সরকারি অনুবাদক কিন্তু মৌলিক লেখালেখিই বেশি পছন্দ করেন। মূলত লেখার আনন্দেই লেখা। এ যাবৎ একটি উপন্যাস ও একটি ছোটগল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।।

দোসর

সুগত আর রিমা ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরছিল। শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। কম রাস্তা তো নয়। অনেকটা সময় লাগে।
রিমা নার্সিং হোম থেকে এবরশান করিয়ে বাড়ি ফিরে আসছে। ওদের আরও একটি ছোট শিশু আছে বাড়ি তে। তাই সুগত ও রিমা এই শিশুটিকে চাইল না। হঠাৎই এসে গেছিল ও। প্রথম সন্তানের জন্মের পর খুব বেশি দিন তো হয় নি, তাই হয়তো চলে যেতে হলো ওকে।
রিমা ওকে চেয়েছিল কি চায় নি এটা সে ঠিক ঠিক বুঝতে পারার আগেই সুগত এই এবরশানের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল।
স্বামীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করা যায় না কিছু করা যায় নি এ কথা রিমা র জীবনে ভীষণ রকম সত্য। নইলে বার বার সুগতর ইচ্ছার সাথে সংগত করতে গিয়ে সে কেন নিজের মৃত্যু কামনা করে!! প্রতি দিনের বাঁচা মরার মতো তার অস্তিত্বের সাথে প্রতি দিন মিশে যায় একতরফা মিলনের অসম আনন্দ। তার ক্লান্ত অনিচ্ছুক শরীরে প্রবেশ করে প্রতিদিন সুগত খুঁজে নেয় অরগাজমের বিপুল আনন্দ আর সে প্রায় প্রতিটি দিন অসহনীয় বিরক্তিতে শয়ন পরবর্তী সংগম পর্ব সমাধা করে অবসন্ন বিষাদে নিদ্রার কোলে ঢলে পড়ে।
অসুস্থ হয়ে পড়লে সংসারের কাজ থেকে ছুটি মেলে কিন্তু একত্রবাসের দৈনন্দিন যন্ত্রনা থেকে ছুটি মেলে না। কখনো রিমা র প্রবল জ্বর আসে , তার পড়ে গিয়ে পা ভেঙে যায় , আচমকা দুর্ঘটনায় তার বিশ্রি ভাবে হাত ভেঙে যায়——–
সে ওষুধ খায়, পায় বা হাতে প্লাষ্টার করে বিছানায় শুয়ে থাকে, অশেষ যন্ত্রনা ভোগ করে। সেই কষ্টের দিনগুলিতেও তার স্বামী তাকে কখনো আদর করে না ডাক্তার দেখানোর কর্তব্য পালন করে আর সুযোগ পাওয়া মাত্র প্রতিষ্ঠা করে প্রবল পৌরুষ।
এইবার সামান্য একটু ভুলে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল ওই অবাঞ্ছিত অস্তিত্ব। তাই এই হিসাব বহির্ভূত বস্তুটিকে পৃথিবীর আলো দেখানো হলো না।
এই কদিন নানা রকম আশা , নিরাশা , দুরাশা , ছোটো খাটো জটিলতা , হাসি চাপতে কান্না বা কান্না চাপতে হাসি সব কিছু পেরিয়ে আজ ঝাড়া হাত পা হয়ে বাড়ি ফিরে আসছে রিমা।
আজ ট্যাক্সির মধ্যে চুপ করে বসে ছিল সুগত কিন্তু চুপ করে থাকে নি রিমা। আজ কেমন করে যেন তার মুখ থেকে অনেক দিনের অনেক জমা কান্না , অজস্র স্মৃতি, অজস্র কথা হয়ে ঝরঝর করে ঝরে পড়ছিল। যে কথাগুলি সে কখনো বলতে পারেনি, যে কথা গুলি ও বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে কখনো বলা হয়ে উঠবে না, সেই সব কথাগুলি রিমা র সর্বহারা আত্মার অপরিসীম কান্না হয়ে এই চলমান ট্যাক্সি র গতিশীল প্রবাহের কাছে অনায়াসে আত্মসমর্পণ করল।
সুগত চুপ করেছিল। রিমার প্রায় কোন কথাই শুনছিল না সে।
ক্রমশ কাছে এল বাড়ি। অনেকটা সময়ও কেটে গেছে এর মধ্যে।
সুগত ঝটিতি বলল
—–এখানেই দাঁড়ান। বাড়ি এসে গেছে।
ট্যাক্সিটা থামে। রিমা নামে। পিছনে সুগত।
ওদের নামার জন্য অনেক টা সময় দেয় ট্যাক্সি ড্রাইভার। রিমা চোখ মুছে আরও একবার ভবিষ্যতের চোখে চোখ রাখার জন্য প্রস্তুত হয়। সুগত পকেট থেকে একটা পাঁচশোর নোট বের করে। এতটা পথ। পাঁচশোর বেশিই হবে হয়তো ভাড়া। কিন্তু সুগত কে অবাক করে দিয়ে ট্যাক্সি টা স্টার্ট দেয়। যেতে যেতে বলে
——লাগবে না ভাড়া।
হুশ করে ট্যাক্সি টা বেরিয়ে যায়। সুগত অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। রিমা স্তব্ধ হয়ে যায়। সদ্য সন্তান হারানো ব্যথার নির্ঝরিনী এখন নীরব। কোথাও কি একটুখানি শান্তি পেল রিমা?
তার ব্যর্থ প্রতিবাদের এক অচেনা নীরব দোসর ধুলো উড়িয়ে এই মাত্র ছুটে গেল শহরের নামহীন ভিড়ে। রেখে গেলো মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতার একটু আশা একটু ভরসা। মনুষ্যত্বের অজানা সৌরভ।।।।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।