মেহেফিল -এ- কিসসা এম উমর ফারুক (প্রবন্ধ)

ভাওয়াইয়া গানের সেকাল – একাল

ভাওয়াইয়া মূলত বাংলাদেশের বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর জেলা, ভারতের কোচবিহার, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি এবং আসামের গোয়ালপাড়া অঞ্চলের প্রাকৃতজনের মাঝে দীর্ঘদিন থেকে গীত হওয়া এক ধরণের লোকসংগীত।
ভাওয়াইয়া গান মাটির সঙ্গে সম্পৃৃক্ত জীবনের গান। এ গানে যে জীবন চরিত উঠে এসেছে তা নিতান্তই নিম্ন শ্রেণির খেটে খাওয়া মানুষ। এদের দৈনন্দিন জীবনের হাসি-কান্না, প্রেম-বিরহ, তাদের কর্মক্ষেত্র এবং পারিবারিক জীবনের ঘটনাবলী এ গানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ভাওয়াইয়া গানের মূল ভাব নর-নারীর প্রণয়। প্রণয়ের বিচ্ছেদ জ্বালা এতে প্রকটভাবে ফুটে ওঠে।
ভাওয়াইয়া গানের উৎপত্তি স্থল সম্পর্কে সংগীত বিশেষজ্ঞ গণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে অধিকাংশের মতে ভাওয়াইয়া গানের উৎপত্তি হিমালয়ের পাদদেশীয় তরাই অঞ্চল। এখান থেকে কালক্রমে ভারতের পশ্চিম বঙ্গ ও আসাম হয়ে বাংলাদেশের বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলে ভাওয়াইয়া গান বিস্তার লাভ করে। ভাওয়াইয়া গানের সৃষ্টির সঠিক ইতিহাস জানা না গেলেও ধারণা করা হয় এর উদ্ভব হয়েছে মধ্যযুগে। বৈষ্ণব পদাবলীর ‘রে, ওরে, ওকি, কি’ প্রভৃতি শব্দের সাথে ভাওয়াইয়া গানের মিল পাওয়া যায়। এজন্য মনে করা হয়, ভাওয়াইয়া গান ও বৈষ্ণব পদাবলী একই সময় সৃষ্টি হয়েছে।
অনেকে মনে করেন, ভাওয়াইয়া গান ভাব সমৃদ্ধ বিধায় ‘ভাব’ থেকে ভাওয়াইয়া কথাটির উৎপত্তি হয়েছে।‘ভাব’ শব্দের আভিধানিক অর্থ চিন্তা, প্রেম, ধরণ। ভাব’ ও ‘ভাও’ এ শব্দ দুটি অঞ্চল ভেদে সমার্থক অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অনেক গবেষক মনে করেন, এ শব্দ দুটির সঙ্গে ‘ইয়া’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে ভাওয়াইয়া শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে। একটি জনপ্রিয় প্রচলিত গানে দেখতে পাই,‘যে জন প্রেমের ভাব জানে না/ তার সাথে নাই লেনা-দেনা।’
কোন্ কোন্ গবেষক মনে করেন, ‘বাউদিয়া’ নামক উদাসী এক শ্রেণির লোকই এ গানের রূপকার। তাদের মতে, এই বাউদিয়া থেকেই ভাওয়াইয়া কথাটির উৎপত্তি।
ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দীন-এর মতে-‘ভাওয়াইয়া গান উত্তরবঙ্গ তথা কোচবিহারের নিজস্ব সম্পদ। উদাস হওয়ার মত এর সুরের গতি, তাই এর নাম ভাওয়াইয়া।’
ভারতের গবেষক সংকেত বন্দোপাধ্যায় তাঁর ‘বাথান সংস্কৃতি ও ভাওয়াইয়া’ প্রবন্ধে বলেন,‘ভাওয়া শব্দের অর্থ গোচারণ ভূমি। মৈষালেরা মহিষ চরানোর সময় ভাওয়া অঞ্চলে দোতারা সহযোগে যে গান করত তাই ভাওয়াইয়া’।
বিশিষ্ট ভাওয়াইয়া গবেষক ড. ওয়াকিল আহমদ বলেন,‘গানের মৌলিক বিষয় প্রেমভাবের প্রাধান্য থেকে ভাব বাচক ভাওয়াইয়া শব্দের উদ্ভব ঘটেছে।’
ভাওয়াইয়া গবেষক ও গীতিকার নীল কমল মিশ্র তাঁর একটি গানে বলেন,‘রংপুরে জন্মিলে যেমন হয় রে রংপুরিয়া/ আরে ঐ মতন ভাওয়ার গান মোর প্রাণের ভাওয়াইয়া’।
ভাওয়াইয়া গানের ভাষা ও গায়কীতে রয়েছে স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য। অনেকের মতে, ভাওয়াইয়ার ভাষা মূলত রাজবংশীদের ভাষা।
আদি থেকে এ গানে গাড়িয়াল, মৈষাল ও মাহুত প্রধান তিনটি চরিত্র প্রাধান্য লাভ করেছে । এক সময় চলাচলের একমাত্র বাহন ছিল গরু বা মহিষের গাড়ি। আর এই গাড়ি যারা চালনা করে তাদেরকে গাড়িয়াল বলে। গাড়িয়াল গাড়ি নিয়ে উঁচু-নিচু রাস্তায় চলার সময় শরীরে ঝাকুনি লাগে। ফলে তার গানের সুরও ভেঙ্গে যায়। সুরের এই ভাঙ্গন ভাওয়াইয়া গানের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
ভাওয়াইয়া গানে ঘুরে ফিরে অনেক গানেই গাড়িয়ালের কথা এসেছে। যেমন-আব্দুল করিম রচিত
‘ওকি গাড়িয়াল ভাই/কত রব আমি/পন্থের দিকে চায়া রে’……।
আর একটি প্রচলিত গানে বাপের বাড়ি থেকে গরুর গাড়ি করে স্বামীর বাড়ি যাবার মুহূর্তে নব বিবাহিতার করুণ আকুতি শুনতে পাই…..‘ওকি গাড়িয়াল ভাই…/ ওরে আস্তে বোলান গাড়ি রে গাড়িয়াল/ ধেরে বোলান গাড়ি/ আর এক নজর দেকিয়া নেং মোর দয়াল বাপের বাড়ি রে গাড়িয়াল..’ ।
মহিষ চরাতে গিয়ে বাথানে মৈষালের নিঃস্বঙ্গ জীবনের সঙ্গী হয়ে থাকে দোতারা। এই দোতারার তারে তার নিঃসঙ্গতা কেটে কণ্ঠে বেজে ওঠে ভাওয়াইয়ার সুর। যেমন-মহেশ চন্দ্র রায় রচিত “ধিক ধিক মইষাল রে/ আরে ও মইষাল ধিক তোমার হিয়া/ কোন পরাণে যাইবেন মইষাল/ হামাকে ছাড়িয়া মইষাল রে ।।”
ভাওয়াইয়ার আর এক বিরহী জনের প্রতিনিধি হাতির দেখাশুনাকারী মাহুত। মাহুতেরা অনেক দিন বাড়ি ছেড়ে দূর-দূরান্তে অবস্থান করত। মাহুতের জন্য তার প্রিয়তমার অন্তর্গত বেদনার স্বরূপ ফুটে উঠেছে এ গানটিতে-‘ আজি আউলাইলেন মোর বান্ধা ময়াল রে/ আরে হাতির পিঠিৎ থাকিয়া রে মাহুত/ কিসের বাটুল মার মাহুত রে…./ ওরে পরের কামিনিক দেখিয়া রে কেনে মার মাহুত রে….’।
এ ছাড়া আধ্যাত্নিক চেতনা সমৃদ্ধ প্রচলিত ভাওয়াইয়া গানও শুনতে পাওয়া যায়। যেমন-‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’ এবং ‘ছাড় রে মন ভবের খ্যালা’ ইত্যাদি।
কালের বিবর্তনে ভাওয়াইয়া গানেরও পরিবর্তন লক্ষ্যনীয়। সেকালে এ গানের তিন নায়ক গাড়িয়াল, মৈষাল ও মাহুত এবং তাদের পরিবেশ থেকে বেরিয়ে এসে ভাওয়াইয়া গান আজ আধুনিকতার ছোঁয়ায় নতুন নতুন পরিবেশ ও নায়ক খুঁজে নিয়েছে। ভাওয়াইয়াতে এসেছে অনেক পরিবর্তন। যেমন-বৈশাখী ভাওয়াইয়া, ঈদের দিনের ভাওয়াইয়া, স্বাধীনতা দিবসের, মুক্তিযুদ্ধের, বিজয় দিবসের ভাওয়াইয়া গান প্রভৃতি বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয়। ভাওয়াইয়া আজ গ্রামীণ জনপদ থেকে রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত তথা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃতি লাভ করেছে।।
ভাওয়াইয়ার ‘যুবরাজ’ হিসেবে পরিচিত কছিম উদ্দিন-এর মুক্তিযুদ্ধের উপর একটি বিখ্যাত গান,
‘ওরে ও বিদেশি ভাইরে শুনে যা বাংলাদেশের ঘটনা
জংলি খানের কারখানা,মানুষ মারা কারখানা
ওরে পশু শুনরে খান, টিকবে না তোর পাকিস্তান
…………………………………………………
বঙ্গবন্ধুর হইলে ক্ষতি বাঁচত না তোর খানের গুষ্টি
খানের গুষ্টি শেষ করিব দুনিয়ার বুকে রাখব না
ওরে ও বিদেশি ভাইরে কাফের খানের কারখানা’।।

তাঁর অন্য একটি গানে দেখতে পাই,
‘কান্দেরে ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে বন্দি করিয়া
পদ্মা নদীর পুটিমাছ
কানিবগার সর্বনাশ
না হয় বাহির না যায় ভিতর গলায় ঠেকিয়া।।
…………………………………………
কাইন্দো না কাইন্দো না দোস্ত বলে ভুট্টো খান
টিক্কা বলে তিনও দোস্ত যাব জাহান্নাম
…………………………………………..
…………………………………………..
টিক্কা কান্দে ভুট্টো কান্দে কান্দে ইয়াহিয়া
খানপুরির খানকি কান্দে বোরখা মাথায় দিয়া’।।
মো. আব্দুল হামিদের কথায়; রনজিৎ কুমার রায়-এর গাওয়া স্বাধীনতার উপর একটি ভাওয়াইয়া গানে পাই,
“এতো সোন্দর দ্যাশটা হামার
এমনি আইসে নাই
লাল-সবুজের পতাকা ভাই
এমনি ওড়ে নাই।।

নয়মাস ধরিয়া যুদ্ধ করি ভাই
খায়া রে না খায়া
সারা দ্যাশে গেইচে রে ভাই
রক্তের নদী বয়া
মনে হইলে অগলে কথা
কান্দিয়া ভাসাই
লাল-সবুজের পতাকা ভাই
এমনি ওড়ে নাই।।

লাখে লাখে মা ও বইনের
কাড়িয়া নিচে ধন
তিরিশ লক্ষ মাইনষের ভাই রে
গেইচে রে জীবন
পাকসেনারা হাজার গ্রাম
পুড়িয়া করচে ছাই
লাল-সবুজের পতাকা ভাই
এমনি ওড়ে নাই।।”

গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম জাহিদ রচিত একটি গানে,
‘ইট বিচিয়া বান্দিচে ঘাটা
গরুর গাড়িত মটরের চাকা
হিড় হিড় করিয়া কি সোন্দর দেঁৗঁড়ায়
বাহে  দারূণ আরাম হইচে এ্যালা আরও
গাড়িয়ালি ব্যবসা।।’

ভাওয়াইয়া গানের বিখ্যাত গীতিকার এ. কে.এম আব্দুল আজিজ লিখেছেন,
‘ও মুই পালকিতে না চড়োং
ঝালা নাগিবে
দুয়ারেতে না বইসোং
গাও বেরাইবে
রিকশা একনা পাইলে ভালো
বাও নাগিবে’।।

ভাওয়াইয়া গানের রয়েছে আঞ্চলিক উপভাষার ব্যবহার যা তার নিজস্ব ও স্বাতন্ত্র একটি বৈশিষ্ট্য। দোতারা এ গানে ব্যবহৃত অপরিহার্য একটি বাদ্যযন্ত্র। ভারতের পশ্চিম বঙ্গে ও বাংলাদেশে বর্তমানে অনেক ব্যক্তি ও সংগঠন ভাওয়াইয়া গান নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। এভাবে চর্চা অব্যাহত থাকলে ভাওয়াইয়া গানের আরো উৎকর্ষ সাধিত হবে এবং সমৃদ্ধি লাভ করবে।

তথ্যসূত্র:
১। বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা,কুড়িগ্রাম,বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
২। খন্দকার মোহাম্মদ আলী সম্রাট,‘প্রাচীন লোকসংগীত’ ।
৩। রশিদুল হাসান,‘ রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা ও ভাওয়াইয়া গান’
৪। সাঈদ সাহেদুল ইসলাম,‘
৫। ভাওয়াইয়া শিল্পী রনজিৎ কুমার রায় এবং
৬। পত্র-পত্রিকা।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।