শনিবার অফিস করে রাতের ট্রেনে বাড়ি ফিরি। সাপ্তাহিক ছুটির দিনটা বাড়িতে কাটিয়ে ফের সোমবার ভোরের ট্রেন ধরে কর্মক্ষেত্রে ফিরে যায়। চাকরি পাওয়া অবধি এভাবেই চলছে। যতদিন একটা স্থায়ী আস্থানা না পাচ্ছি এভাবেই চালাতে হবে।
যাইহোক, ইয়ার এন্ডিংয়ের ফাঁদে পড়ে মার্চ মাসে একবারও বাড়ি ফেরা হয়নি। সব কাজ সামলে সাতদিনের ছুটি নিয়ে গতরাতে বাড়ি ফিরেছি। পরদিন বিকেলবেলা মদনদাকে দেখা করতে এসে দেখি তিনি সেজেগুজে ছড়ি হাতে বাড়ি থেকে বেড়ুচ্ছেন। আমাকে দেখেই উল্লাসিত হয়ে উঠে বললেন,, চল পেঁচো সাত্তকির দোকান থেকে চা গিলে আসি।
গ্রামে ঢোকার মুখে ক্যানেলের পাড়ে তিন-চারটে চায়ের স্টল আছে, তার একটা আমাদের সাত্তকিদার। তাঁর চায়ের হাত খুব ভালো, বিশেষ করে গোলমরিচের গুঁড়া দিয়ে অসাধারণ র-চা বানান। একবার যে খাবে তাকে দ্বিতীয়বার চাইতেই হবে, এ আমি হলফ করে বলতে পারি।
বিকালবেলা গ্রামের ছেলেছোকরার দল আড্ডা দিতে এখানে আসে। চা পানের সাথে চলতে থাকে ক্যারাম, তাস, লুডো, দাবা, সাত গুটি খেলা। দোকানদারেরাই সব ব্যবস্থা রেখেছে, শর্ত হল মাঝে মাঝে চায়ের অর্ডার দিতে হবে। কেক, বিস্কিট কিনে খেতে হবে।
সাত্তকিদার চা-স্টলের সামনে একটা পুরানো বটগাছ আছে। তিনি গাছের গুঁড়িটাকে বৃত্তাকারে ঘিরে বাঁশের মাচান টাঙিয়ে রেখেছেন। একটু বয়সে বড় যারা, শুধু চা পানের নেশায় এখানে আসে, তাঁরাই মাচানে বসার সূযোগ পান। স্বাভাবিকভাবে পাঁচজন বাঙালি পাশাপাশি বসার সূযোগ পেলে যা হয়ে থাকে – ‘পর নিন্দা পর চর্চা’। আমাদের বটতলার আসরে তেমনটাই হয়ে থাকে। রাজনীতি-গ্রামনীতি, ক্রিকেট-ফুটবল থেকে শুরু করে গ্রামসূদ্ধ লোকের হাড়ির খবর, এমন কোন বিষয় নেই যা নিয়ে এইসব আসরে আলোচনা হয় না।
সব চায়ের ঠেকের মতো আমাদের এখানেও কিছু মানুষ আছেন যারা স্বঘোষিত সর্বশাস্ত্র বিশারদ। তেমনই একজন মানুষ হলেন নিবারণ চাটুজ্জ্যে। তিনি উপস্থিত থাকলে অন্য কেউ কথা বলার সূযোগ পায় না। বিষয় যা হোক না কেন উনি তা নিয়ে ঘন্টা তিনেক নিরলস বকে যেতে পারেন। তারওপর তিনি গ্রাম পঞ্চায়েত মেম্বার। সেই হিসেবে যথেষ্ট দাপুটে। আজ পর্যন্ত তিনি তর্কে হেরেছেন এমন কথ শুনিনি। সেই মানুষটাকে বেকায়দায় ফেলে আমাদের মদনদা সেদিন আচ্ছা করে রগড়ে দিলেন।
বটতলায় পৌঁছে দেখি নিবারণ চাটুজ্জ্যের আসর জমে উঠেছে। সাঙ্গপাঙ্গ পরিবেষ্ঠিত হয়ে লোকনাথ বাবার মতো পা ভাঁজ করে বসে বিড়ি ফুকতে ফুকতে লেকচার দিচ্ছেন। মদন দা তাঁর মুখোমুখি হয়ে ছড়িসহ ডানহাত কপালে ঠেকিয়ে বললেন, বজ্রনাথ কেমন আছো হে?
– এই সেরেছে! লোকটার অভিধানে দেখছি শান্তি নামক শব্দের জায়গা নেই। যেখানে যাবেন একটা না একটা গোল পাকাবেন-ই। না, আজ কপালে বজ্রাঘাত আছে দেখছি।
চা অর্ডার করার জন্য দোকানের দিকে যাচ্ছিলাম। দাদার কথা শুনে আঁতকে উঠে পিছন ঘুরে দাঁড়ালাম। নিবারণ চাটুজ্জ্যে বক্তৃতা থামিয়ে একলাফে মাচান থেকে নেমে বজ্রের মতো হুংকার ছাড়লেন, এটা কী হল মদন-দা? বজ্রনাথ কাকে বললেন?
– কাকে আবার, তোমাকেই বললাম হে। মদনদা মাচার কাছ থেকে সরে এসে বেঞ্চের কাছে এলেন। আমরা সাধারণত বেঞ্চে বসি।
– বামুনের ছেলে আমি, ঠাকুর বলতে পারতেন। বজ্রনাথ কেন?
– বামুনের ঘরে জন্মালেই ঠাকুর হওয়া যায় না ভায়া। ঠাকুর হতে গেলে বিশেষ গুণসম্পন্ন হতে হয়। যেমন রামকৃষ্ণ, বামদেব, লোকনাথ। ইনারা নিজ গুণে ঠাকুরের মর্যদা লাভ করেছেন। আর তুমি হলে গিয়ে….
বেঞ্চে বসতে বসতে মদন-দা কথাগুলো এমনভাবে বললেন যেন কিছুই হয়নি। প্রমাদ গুনী আমি। নিবারণ চাটুজ্জ্যে যেমন বাচাল, তেমনি প্যাঁচাল। তিলকে তাল বানিয়ে গণ্ডগোল পাকাতে ওস্তাদ। দৌড়ে এসে উভয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে বললাম, জেঠু ওনার কথায় গুরুত্ব দেবেন না। জানেন তো দাদা ফাজিল টাইপের মানুষ। হয়তো….
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নিবারণ জেঠু বললেন, ফাজলামি করার একটা সীমা আছে পেঁচো। বজ্রনাথ হলেন ইন্দ্রদেব, তাঁর সাথে কী কোন মানুষের তুলনা চলে? আমি নিশ্চিত আমাকে অপমান করার জন্য উনি এই শব্দটা ব্যবহার করেছেন। সেই সাথে তিনি ইন্দ্রদেবকেও ছোট করেছেন।
সাথে সাথে তাঁর সাকরেদরাও গলা মিলিয়ে বলতে লাগল, ঠাকুর দেবতার অপমান আমরা সহ্য করব না। নিবারণ ঠাকুর এর একটা বিহিত ব্যবস্থা আপনাকে করতেই হবে।
লোকগুলো জোরে জোরে কথা বলছিল। গণ্ডগোলের আভাস পেয়ে এদিক-ওদিক থেকে লোকজন ‘খেলা হবে খেলা হবে’ গাইতে গাইতে ছুটে এসে আমাদের ঘিরে ধরে হৈ চৈ শুরু করে দিল।
ঘটনাপ্রবাহ ক্রমে জটিলতার দিকে গড়াচ্ছে। কীভাবে সামাল দেব বুঝতে পারছি না। এমনসময় সাত্তকিদা চা নিয়ে এলেন। পরিস্থিতির ফেরে আমার চা পানের নেশা তখন ছুটে গেছে, পরে নিচ্ছি বলে তাঁকে ভাগিয়ে দিলাম। কিন্তু মদনদার কোন হেলদোল নেই। কাপ নিয়ে যত্ন করে চুমুক দিলেন। তারপর জেঠুকে লক্ষ্য করে বললেন, ইন্দ্র হলেন দেবরাজ,দেবতার দেবতা। মানুষের কী সাধ্য তাঁকে অবমাননা করে। তবে তুমি যে বজ্রনাথ সে কথায় কোন খাদ নেই।
– বেশ! তাহলে বলুন আমি কি করে বজ্রনাথ হলাম। সঠিক ব্যাখ্যা দিতে না পারলে কিন্তু আপনাকে সবার সামনে ক্ষমা চাইতে হবে। বেঞ্চে মদনদার পাশে বসে পড়লেন নিবারণ জেঠু।
সঙ্গে সঙ্গে কিছু বললেন না মদনদা। তৃপ্তি সহকারে সবটুকু চা গলাধকরণ করে কাপটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে বললেন, নিবারণ তোমার গিন্নির নাম কী যেন?
– ও আবার এখানে কেন? বিরক্তি প্রকাশ করেন নিবারণ জেঠু।
– ভয় নেই ভায়া, এই বুড়ো বয়সে ওকে নিয়ে পালাব না। শুধু নামটা জানতে চাচ্ছি।
– দামিনী। ছোট করে বললেন জেঠু।
– খুব সুন্দর একটা নাম। তোমার জানা আছে দামিনী শব্দের অর্থ কী?
– না মানে! আমি, এই আর কী….। আমতা আমতা করতে থাকেন জেঠু। এই অবসরে আমার মাথায় খেলে গেল রহস্যের জট কোথায়? চট করে বলে ফেললাম, দামিনী মানে হচ্ছে বিদ্যুৎ।
– ঠিক বলেছিস পেঁচো, দামিনী শব্দের অর্থ হল বিদ্যুৎ। বিদ্যুতের আর এক রূপ হল গিয়ে বজ্র বা বাজ। তেমনি নাথ মানে হল প্রভু বা স্বামী। দুইয়ে মিলে কী দাঁড়াল তাহলে? প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে মদনদা নিবারণ জেঠুর মুখের দিকে তাকিয়ে মিচকি মাচকি হাসতে লাগলেন।
নিবারণ জেঠুর মুখে তখন ধান দিয়ে খই হয়ে যায়। যারা তার হয়ে লড়তে এসেছিল তারাও কুপোকাত। ‘খেলা হবে’-র দল খেলা হল না দেখে নিরাশ হয়ে পলায়ন করল।
একটু পরে মদনদা গলা উচঁ করে বললেন, সাত্তকি সবাইকে চা দাও। বিল মেটাবে নিবারণ। তারপর নিবারণ জেঠুর পেটে খোঁচা মেরে বললেন, কী হে পকেটে মালকড়ি আছে না বজ্রকে ডাকতে হবে?
মদনদার বলার ধরণে জেঠুর রাগ-অভিমান গলে জল হয়ে গেল। মদনদাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হো হো করে হেসে উঠে বললেন, আপনি না একটা….।
জেঠুকে হাসতে দেখে তাঁর সাকরেদরা এমন হৈ চৈ শুরু করে দিল যে শেষের শব্দটা আর কানে ঢুকল না।