|| বার্ট্রান্ড রাসেল || জন্মদিবসে স্মরণলেখায় মৃদুল শ্রীমানী

আজ বার্ট্রান্ড রাসেলকে তাঁর সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ১৮ মে তারিখে তিনি জন্মেছিলেন এবং ৯৭ বৎসর বয়সে ১৯৭০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তিনি প্রয়াত হন।
বার্ট্রান্ড রাসেল ছিলেন একজন ব্রিটিশ গণিতবিদ। আলফ্রেড নর্থ হোয়াইটহেড এর সঙ্গে তিনি তিনখণ্ডে প্রিন্সিপিয়া ম্যাথেমেটিকা নামে একটি বিশ্ববিখ্যাত বই লিখেছিলেন। এই তিনটি খণ্ড বেরিয়ে ছিল যথাক্রমে ১৯১০, ১৯১২ ও ১৯১৩ তে। আলফ্রেড নর্থ হোয়াইটহেড (১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৮৬১ – ৩০ ডিসেম্বর ১৯৪৭) ছিলেন একজন ইংরেজ গণিতবিদ এবং দার্শনিক। বার্ট্রান্ড রাসেল ছিলেন হোয়াইটহেডের ছাত্র। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজে গণিত নিয়ে পড়তে গিয়ে রাসেল হোয়াইটহেডকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন।
প্রিন্সিপিয়া ম্যাথেমেটিকাকে মনে করা হয় গণিতের লজিক বিষয়ে বিংশ শতাব্দীতে লেখা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বইগুলির একটি। কেউ কেউ বলেন, বিংশ শতাব্দীতে ইংরেজি ভাষায় লেখা সেরা নন-ফিকশন পঁচিশটি বইয়ের মধ্যে প্রিন্সিপিয়া ম্যাথেমেটিকা-কে স্থান দিতে হয়।
১৯০৩ সালে বার্ট্রান্ড রাসেল একাই দি প্রিন্সিপলস অফ ম্যাথেমেটিক্স নামে একটি বই লিখেছিলেন। ইংরেজি ভাষায় লেখা বইটি বেরিয়েছিল কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে। প্রথম সংস্করণে ৫৩৪ পাতার বইতে গণিতের ভিত্তি এবং সিম্বলিক লজিক নিয়ে তিনি আলোচনা করেছিলেন। বইটির সাতটি অংশ জুড়ে মোট ৫৯ খানি অধ্যায় ছিল। তার প্রথম অধ্যায়ের বিষয় ছিল, বিশুদ্ধ গণিতের সংজ্ঞা কী? ওখানে রাসেল বলেছিলেন, সমস্ত গণিত হল সিম্বলিক লজিক এবং এটাই আমাদের যুগের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। আরো বলেছিলেন, সিম্বলিক লজিককে বিশ্লেষণ করতে করতে গণিতের নীতিগুলি বিকশিত হয়। গণিতবিদ গডফ্রে হ্যারল্ড হার্ডি ( ৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৭ – ১ ডিসেম্বর ১৯৪৭) যিনি শ্রীনিবাস রামানুজনের বিশেষ ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তিনি বলেছিলেন, বইটি গণিতবিদদের চাইতে দার্শনিকদের বেশি আকৃষ্ট করবে। তার পরেও হার্ডির মনে হয়েছিল, পাঁচশ পাতার বেশি লেখা হলেও বইটি যেন বড়ই সংক্ষিপ্ত হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বহু আলোচনা অতি সংক্ষেপে সেরে ফেলা হয়েছে। এডুইন বিডওয়েল উইলসন (১৮৭৯ – ১৯৬৪) একজন আমেরিকান গণিতজ্ঞ ও পদার্থবিজ্ঞানী, বলেছিলেন, রাসেলের এই বইটি ধৈর্য, পরিশ্রম এবং গভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রজ্ঞার একটি অসাধারণ নিদর্শন।
প্রথমে ভাবা গিয়েছিল, ১৯১০ সালে হোয়াইটহেডের সঙ্গে রাসেল যে প্রিন্সিপিয়া ম্যাথেমেটিকা বইটি লিখতে চলেছেন, তা বুঝি ১৯০৩ সালের বইটির একটি পরবর্তী অংশ হিসেবে প্রকাশিত হতে চলেছে। কিন্তু লিখে ফেলার পর, দেখা গেল, বইটির প্রতিপাদ্য বিষয় পূর্বের বইটির চাইতে বহুধাবিস্তৃত। এবং পূর্বের বইতে যে সমস্ত অস্পষ্টতা ও সংশয় ছিল, তা এ বইতে কাটিয়ে ওঠা হয়েছে। বার্ট্রান্ড রাসেল খুব ছোট বয়সে বাবা মাকে হারিয়েছিলেন। ১৮ বছর বয়সে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন। ১৮৯৩ সালে তিনি গণিত নিয়ে প্রথম শ্রেণিতে বিএ পাশ করেন। ১৮৯৪তে মরাল সায়েন্সে তিনি ট্রাইপোস করেন। ১৯৯৫ তে তিনি বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে সাতাশ বছর বয়সে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ট্রিনিটি কলেজ থেকে তিনি স্নাতক হয়েছিলেন, সেখানেই লেকচারার হিসেবে নিয়োজিত হন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পড়িয়েছেন। ১৯৪৯ সালে ওই ট্রিনিটি কলেজে তিনি আজীবন ফেলোশিপ লাভ করেন। ১৯৫০ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৫৫ সালে রাসেল-আইনস্টাইন ম্যানিফেস্টো প্রকাশিত হয়। রাসেলের লেখা বইগুলির দিকে তাকালে গভীর শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়। ১৮৯৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে ফাউন্ডেশন অফ জিওমেট্রি। ১৯১২ তে দি প্রবলেমস অফ ফিলজফি, ১৯১৯ এ ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথেমেটিকাল ফিলজফি, ১৯২১এ দি অ্যানালিসিস অফ মাইণ্ড, ১৯২৩ এ দি এবিসি অফ অ্যাটমস, ১৯২৫এ দি এবিসি অফ রিলেটিভিটি, ১৯২৬ এ অন এডুকেশন, এ রকম আরো মোট সত্তরখানি বই ঝ প্রায় দুহাজার প্রবন্ধ তিনি সারাজীবন ধরে লিখে গিয়েছেন। তাঁর নিজের লেখা বইগুলির মধ্যে বোধ হয় ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে লেখা “ম্যারেজেস অ্যাণ্ড মরালস” কে তিনি খুব পছন্দ করতেন। ১৯৫০ সালে নোবেল কমিটি তাঁর সারাজীবনের জ্ঞানচর্চার জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দিলেও রাসেল বলেছিলেন, ওরা আমাকে এই ম্যারেজেস অ্যাণ্ড মরালস বইয়ের জন্যই নোবেল পুরস্কার দিয়েছেন। নোবেল কমিটি অবশ্য তা স্বীকার না করে বলেছিলেন, মানবতার মহান আদর্শ, এবং চিন্তার স্বাধীনতার যে অপূর্ব নিদর্শন রাসেল তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে গড়ে তুলেছিলেন, তাকে সম্মান জানাতে এই নোবেল পুরস্কার।
রাসেল নিজেকে নাস্তিক হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর বাবা ভাইকাউন্ট অ্যামবারলে চেয়েছিলেন, তাঁর সন্তান যেন অজ্ঞেয়বাদী হিসাবে গড়ে ওঠেন। কিন্তু বাবা মা দুজনেই তাঁর তিন বছর বয়সে তাঁকে ছেড়ে চলে যাওয়ায়, বাড়ির বড়রা তাঁকে পুরোনো পন্থায় গড়ে তুলতে চাইলেন। শেষ অবধি রাসেল নিজেকে একজন ঈশ্বরে অবিশ্বাসী, যুক্তিশীল, মানবতাবাদী মানুষ হিসাবেই প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।
অত্যন্ত অভিজাত ও বংশগরিমাসম্পন্ন পরিবারের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও রাসেল প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা করতে ভয় পাননি। যুদ্ধের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি যুদ্ধবিরোধী লেখালেখি করায় ট্রিনিটি কলেজ তাঁকে একশত পাউণ্ড আর্থিক জরিমানা করে লেকচারার পদ থেকে বিতাড়িত করেন। সেই তিনিই আবার ১৯৪৯ এ ট্রিনিটি কলেজের আজীবন ফেলোশিপ অর্জন করেন। নোবেল পুরস্কার পাবার এগারো বছর পরে পরমাণু যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করায় নব্বই বছর বয়সে তাঁকে এক সপ্তাহের জন্য জেলে পুরে রাখা হয়। এত উঁচু দরের মানুষের এতটা প্রবীণ বয়সে কারাদণ্ড প্রাপ্তি রাসেলের মেধা ও মননের অসামান্য উচ্চতাকে প্রমাণ করে। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ছয় মার্চ তারিখে ন্যাশনাল সেক্যুলার সোসাইটির আহ্বানে তিনি একটি বক্তৃতা দেন। সেখানে তিনি ধর্মের নৈতিকতাকে তীব্র তীক্ষ্ণ প্রশ্নে দাগিয়ে বলেন, ভয় থেকে ধর্মের সৃষ্টি এবং তিনি ঘোষণা করেন যে তিনি খ্রিস্টান নন। আর তিনি আরো বলেন ধর্মই হল সভ্যতার নৈতিক অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা। তিনি ধর্মের বিপরীতে বিজ্ঞানকে অবলম্বন করে এগোনোর কথা বলেন। এই বক্তৃতাটি পুস্তিকাকারে ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয়। নাম দেওয়া হয়েছিল, হোয়াই আই অ্যাম নট এ ক্রিশ্চিয়ান, বা ‘কেন আমি খ্রিস্টান নই?’ এই বইটি দেশে দেশে বিপুল প্রভাব বিস্তার করে। বহু যুক্তিবাদী ও আলোকপ্রাপ্ত মানুষ রাসেলের এই বইটি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে লেখালেখি শুরু করেন। এর মধ্যে ভারতীয় বিপ্লবী শহীদ ই আজম ভগৎ সিংহের “কেন আমি নাস্তিক” (১৯৩০) বইটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরি বার্ট্রান্ড রাসেলের এই বইটিকে বিংশ শতাব্দীর সবচাইতে উল্লেখযোগ্য বই হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।