|| রক্ত মাংসের ঈশ্বর || লিখেছেন মৃদুল শ্রীমানী

রক্ত মাংসের ঈশ্বর

বাবা চেয়েছিলেন ছেলে গ্রামের বাড়িতে একটি টোল করবেন। সংস্কৃতের পণ্ডিত। ঊনিশ বছর বয়সে বিদ‍্যাসাগর। ঠাকুরদাস কত কষ্ট করে সংসার চালাতেন। ছেলে তখন ছোট। কচি ছেলে কতই বা হাঁটবে। তাকে ঘাড়ে করে পথ হেঁটেছেন ঠাকুরদাস। মনে আশা, কলকাতায় গেলে একটা কিছু থই পাবেন। বড়বাজারে বড়সড় মুদির দোকান কর্মচারী তিনি। দশটি টাকা মাইনে পান। এদিকে পেটে খেতে অনেকগুলি লোক। রাইমণির বাড়িতে গোলপাতার ঘরে ভাড়া থাকেন। কি করে যে নিজেরা কলকাতার বাজারে দুটো খেয়ে বীরসিংহে টাকা পাঠান, তিনিই জানেন। নামেই বামুন। কোঁচড়ে পয়সা না থাকলে ব্রিটিশ রাজত্বে সব ঢুঁ ঢুঁ। চাষবাসের অবস্থাও ভাল না। আকাশ জলের উপর নির্ভর। কবে বৃষ্টি দিল। কবে দিল না। সব খেয়ালখুশির ব‍্যাপার! যখন দিল, তো এত বৃষ্টি দিল, যে মাঠ ভেসে যায়। চাষা জোলা জেলে হাড়ি বাগদি ডোম যত ছোটলোকের দল গাঁয়ে থাকে। তারা ছেলে পুলেদের পড়তে পাঠায় না। বলে, পড়ে কি হবে? আগের দিনের মতো যজমানি পুরুতগিরি করেও গ্রামে সংসার চালানো শক্ত। কে দক্ষিণা দেবে! কটা লোকের কাছে নগদ পয়সা আছে? তাই কলকাতায় মুদি দোকানের কাজই মাথা পেতে নিলেন। বন্দ্যোপাধ্যায় বংশ। বড় বংশ। কিন্তু পেটে খেতে না পেলে বংশ নিয়ে কি করবেন? ইংরেজের কলকাতা শহরে খালি পেটে ঠা ঠা দুপুরে কলের জল খেয়েই পেট ভরাবেন ভেবেছেন। দেখতে পেয়ে গেল ছুঁড়িটা। ও ঠাকুর, শুধু জল খেও নি। একমুঠো মুড়ি মুড়কি আর বাতাসা দিলে। কড়মড় করে চিবিয়ে খেয়ে জল খেলেন । আহা খেয়ে কী আরাম! সাধে শাস্ত্র বলেন, অন্নই ব্রহ্ম! বড় ভাল লেগেছিল মেয়েটিকে। আহা, সাক্ষাৎ দেবী। এদের যেন কোনোদিন কষ্ট না পেতে হয়। সেই যে ভেবেছিলেন, ঈশ্বর সেই মনটা পেয়েছে। বাপের কাছে মার খেলেই রাইমণির আঁচলের তলায় গিয়ে নুকোয়। জানে, কে ভালবাসে। রাইমণিও তেমনি মেয়েছেলে। জানে, এত অল্প ভাড়ায় ঠাকুরদাস আর ঘর পাবে নি। তাই বলে, অমন ছোটো ছেলেকে যদি এমন চোরের ঠ‍্যাঙান ঠ‍্যাঙাবে, তো উটে যাও বাছা। চোখের সামনে এই অত‍্যাচার দেখতে পারি নে। মুখ চূণ হয়ে যায় ঠাকুরদাসের। ছেলেটা বেশ একটু জেদি। গোঁয়ার। যেটা বলবে সেটাই করবে। একা একা রান্না বাড়া করে ছেলেদের খাইয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দোকানে যান ঠাকুরদাস। পুরুষ মানুষের এত ঝক্কি সয়? তাই সব দুঃখ কষ্টের ঝাল ঈশ্বরের পিঠের উপর ঝাড়েন তিনি। পরে নিজের হাত কামড়ান, হে ভগবান, মানুষকে এত অসহায় করে রেখেছ কেন?
বিদ‍্যাসাগর। ঊনিশ বছর বয়স। কিন্তু এর মধ‍্যেই কত বিবেচনা বোধ। তবে সে কি আজ থেকে? সেই যেদিন প্রথম জলপানি পেয়েছিল, সেই দিন থেকে আশপাশের সবার জন্য ভাবনা। মা হিসেবে বড় ভাল লেগেছিল। মানুষের তো এমনই হওয়া উচিত। ঈশ্বর নাম রাখা তাঁর সার্থক। সেই যে মেয়েটা বিধবা হয়েছিল, ও যে ঈশ্বরেরই সমবয়সী। খেলার সাথী ছিল যে। হুটোপুটি করত একসাথে। ও বিধবা হল। কচি বয়স। একাদশী তে নির্জলা উপবাস। খিদে তেষ্টা তো মানুষের থাকেই। ওইটুকু মেয়ে বিধবা হয়েছে বলে তো বিধাতাপুরুষ শুনবেন না। বিধিলিপি খণ্ডানো ওই ঈশ্বরের নিজের হাতে। খিদে তেষ্টার জ্বালায় কেঁদে কেঁদে নেতিয়ে পড়ত মেয়েটা। ভগবতী দেবীর মনে হত, একবার হলেও যেন যান, চোখে মুখে জল দেবার ছলে জিভটা একটু ভিজিয়ে দেবেন। কিন্তু ও মেয়ে নিজেই চায় না। মা গো, এত কঠোর অনুশাসন যার মনে এত কড়া করে দাগা বুলিয়ে দিয়েছে, তাদের আর বাঁচার উপায় কি?
ওর কান্না কানে এলে ঈশ্বরের চোখের থেকে জল পড়ে।
বলে, মা গো, হিন্দু ধর্ম এত নিষ্ঠুর কেন? এয়োতী তিনি। একাদশীর দিনে মাছ খেতে হয়। নইলে স্বামীর অকল‍্যেণ হয়। কিন্তু বলতে ইচ্ছে করে নিকুচি করেছে এই ধর্মের। যে ধর্ম মানুষকে তেষ্টার জল দিতে বারণ করে, সে আবার ধর্ম! মনে মনে ভাবেন, ঈশ্বর বড় হোক। বড় হয়ে পণ্ডিত হবে, চারদিকে নামডাক ছড়িয়ে পড়বে তখন সে একটা কথা বললে সমাজপতিরা শুনবে। হে ঠাকুর, ঈশ্বরকে তাড়াতাড়ি বড় করে দাও।
ঠাকুরদাসকে তার বাবা বলেছিলেন, ঘরে একটি এঁড়ে বাছুর হয়েছে। তাড়াতাড়ি গোয়ালে উঁকি দিয়ে দেখতে গিয়েছিলেন তিনি। পিতা হেসে বললেন, ওখানে নয়। দ‍্যাখো গিয়ে তোমার ব্রাহ্মণীর কোলে। ওমা, সুন্দর একটা খোকা হয়েছে যে! মাথাটা যেন একটু বড়ো! তা হোক, সমাজে বড়ো মাথার লোক দরকার। জল ঝড় সইতে বড়ো বট অশ্বত্থ লাগে। ঘাস লতা পাতা কী জানে বড়োত্বের মর্ম!
সদ‍্যোজাত খোকনের জিভটা টেনে নিয়ে তার তলায় আলটপকা কি যে লিখে দিলেন বাবা কে জানে। ছেলেটা কথা বলতে গেলে তুতলে যায়। রেগে খেপে গেলে আর কথাটাই বেরোয় না। গ্রামের পাঠশালায় পড়তে যেত ছাতা নিয়ে। বেঁটে মানুষ। বড়ো ছাতা। দেখে মনে হত, মানুষ নয়, একটা ছাতা হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে। ছেলেটার মাথাটা বড়ো গোছের বলে পাঠশালার অন‍্য পোড়োরা খ‍্যাপাতো যশুরে কৈ বলে। ওই কইমাছের মাথাটা একটু বড় কি না, ওরা মিল পেয়েছে। আবার মাঝে মাঝে ঈশ্বরকে তোতলামি পেয়ে বসে বলে পোড়োরা ওকে খেপিয়ে তুলতে কশুরে যৈ বলত। যাক্, কলকাতায় এলে একটা বড় চৌহদ্দি পাবে। গাঁয়ের মানুষের মন বড় সংকীর্ণ। পাঠশালায় বেত যত পড়ে, জ্ঞানের চর্চা তার সিকির সিকি হয় না।
নিজের গাঁয়ের বাড়িতে সে টোল খুলল না। সারা দেশ জুড়ে এখানে ওখানে ইশকুল বসিয়ে চলেছে। সাহেবরা ওকে ভালও বাসে। সাহেবরা এক আধজন চেয়েছিল এদেশের ছেলেপিলেরা সত‍্যিকারের পড়াশুনা করতে পাক্। দেশের মানুষ আধুনিক জ্ঞানের আলো পাক্। কিন্তু দেশের রক্ষণশীল লোকেরা তা চায় নি। চাইবে কেন? আলো এসে গেলে ভয় কেটে যাবেনা? ভয় দেখানোর ব‍্যবসা চালু রাখতে পুরোনো ধাঁচাটা বজায় রাখা দরকার। প্রশাসনের ওপর মহলের বেশিরভাগ লোক ওই লোকজনকে চটাতে চায় না। কি করলে ট‍্যাকসো আদায়ের ব‍্যবস্থাটা মজবুত থাকে, সেইটে দ‍্যাখো। বেশি কিছু ভেবো না। ইংরেজ যা করতে চাইল না, বাঙালি হয়ে ঈশ্বর সে কথা ভাবল।
বলল, গণিত পড়াও। গণিত কেন? না, গণিত শিখলে যুক্তি বুদ্ধি বাড়ে। বিদ‍্যাসাগর নিজের হাতে গণিতের সিলেবাস গড়ে অপূর্ব সর্বাধিকারী নামে ছাত্রকে বললেন, আমার সময় থাকলে আমিই এই সিলেবাস ধরে গণিতের একটা বই লিখতাম বাপু। এ যাত্রা সেটি হচ্ছে না। গণিত বইটা তুমিই লেখো।
বলল, বেদান্ত নয়, ব্রহ্ম সত‍্য, জগৎ মিথ‍্যা, ওসব কথার কথা। কথার জাগলারি। পাশ্চাত্য দর্শন আর জ্ঞান বিজ্ঞান পড়তে হবে। আর ওই ব‍্যাকরণের বোঝা কমাও। বারো বৎসরের ব‍্যাকরণ পাঠকে ছেঁটে কেটে ছোট করে ছয়মাসের মধ‍্যে গুঁজে দিল ঈশ্বর।
হিন্দি উৎস বৈতাল পচ্চিসী থেকে আনল বেতাল পঞ্চবিংশতি। শেকসপীয়রের নাটক কমেডি অফ এররস এর আখ‍্যানভাগ নিয়ে উপন্যাসের মতো করে লিখল ভ্রান্তি বিলাস।
মেয়েরা পড়বে। মেয়েরা শিখবে। আর বাল‍্যবিবাহ নয়। লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করে তারপর বিয়ে দাও। শিক্ষিত মায়ের সন্তান নিরক্ষর হয় না।
তখন ঈশ্বরের বয়স তেমন হয়নি। চেহারায় খুব বেশি ভারিক্কি ভাব আসেনি। কলকাতায় মেয়েদের ইশকুল খোলা দরকার বলে মেতেছে। ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুনকে রাজি করানো হল সামনে থাকতে। তিনি হোমরা চোমরা মানুষ। সরকারি শিক্ষা দপ্তরের উপরের থাকের লোক। তায় সাহেব। রাজার জাতের লোক। ওদের দাপই আলাদা। অমন একটা মানুষ সামনে থাকলে সহজেই কাজ উৎরে যাবে। শুরু হল বেথুন স্কুল। মদনমোহন তর্কালঙ্কার তাঁর কন‍্যাদের পড়তে পাঠালেন। মদনমোহন গুণী মানুষ। তিনিও বড়ো সরকারি আমলা।
মেয়েরা অল্পবয়সে বিয়ে হয়ে বড় কষ্ট পায়। পড়াশুনা করতে পেলে বাপ মা একটু ভাবতে শিখবে। হাতে একটু সময়ও পাবে। মেয়েদের মনটা একটু খোলামেলা বাতাস পাবে। মেয়েদেরকেও অত‍্যন্ত যত্ন করে লেখাপড়া শেখানো উচিত। বেথুন স্কুলের যে সব গাড়িতে করে ভদ্রলোকের পরিবারের মেয়েরা আব্রু রক্ষা করে পড়তে আসত, পণ্ডিত সেই সব গাড়ির গায়ে লিখে দিলেন কন‍্যাপেবং পালনীয়া শিক্ষণীয়াতি যত্নতঃ।
বাচ্চাদের পড়ার ভাল ভাল বই দরকার। যাতে বাস্তব জীবনে চলার উপযোগী বোধ সহজে জন্মায়। ঈশ্বর বই লিখলেন। বর্ণপরিচয়, কথামালা, বোধোদয়। আর সংস্কৃত সাহিত্যের গল্পকে বুকে নিয়ে সীতার বনবাস, আর শকুন্তলা। লোকে পাঠ‍্যপুস্তক রচয়িতা বলে ছোট করে! তা করুক না। ছোটদের পড়ার কাজের জন‍্য জুতসই বই কে লিখে দেয় বাপু?
ইশকুলে ইশকুলে ঈশ্বর এনে দিল আধুনিক যুগের হাওয়া। না অমাবস‍্যা পূর্ণিমায় সেকেলে শাস্ত্রসম্মত অনধ‍্যায় নয়, সায়েবি কেতায় রোববার ছুটি। আর গ্রীষ্মকালীন ছুটি। ছেলেরা আম জাম লিচু খাবে মজা করে।
সংস্কৃত কলেজের অধ‍্যক্ষের দায়িত্ব নিলেন। বাঙালি বড় অলস। আর শ্রমবিমুখ। মুখেন মারিতং জগৎ। অধ‍্যাপকেরাও তাই। ডিসিপ্লিন কারে কয় জানতে চান না। বুঝতেও চাননা। সমস্যা হল, সংস্কৃত কলেজের অধ‍্যাপকগণ অনেকেই তাঁরও অধ‍্যাপক ছিলেন। হলেনই বা অধ‍্যক্ষের পদে আসীন। বিদ‍্যাসাগরের শিক্ষক তো বটে। ফাঁকিবাজ শিক্ষককে শায়েস্তা করতে কি আর করেন বিদ‍্যাসাগর! কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে গেটে দাঁড়িয়ে থাকেন, আর শিক্ষক মশায়রা দেরি করে ঢুকলে বিদ‍্যাসাগর নীরবে ট‍্যাঁকঘড়িটা বের করে দেখতে থাকেন। অন‍্য সভ‍্য জাত হলে লজ্জায় মরে যেত। বাঙালি কি না। লাজলজ্জার বালাই নেই। একদিন এক শিক্ষক বয়সে অনুজ অধ‍্যক্ষকে বলেই বসলেন, ওহে, তুমি যদি কড়া কড়া কথা বলতে, তাও সহ‍্য হত। কিন্তু ওই যে কিছু বলো না, খালি ট‍্যাঁকঘড়িটা দেখিয়ে দেখিয়ে দেখতে থাকো, ওই তে গা আরো চিড়বিড় করে জ্বলে। দুটো কথা বললে, কথার পৃষ্ঠে কথা টেনে আনতে পারতুম। যে লোক কথাটি কয় না, তার সাথে বিরোধ করি কি করে?
এই ঘটনা একদিন ঘটবে নামকরা অ্যাটর্নি বিশ্বনাথ দত্তের ছেলে নরেন্দ্র নাথ দত্তের সঙ্গে। ছেলেটি যথেষ্ট মেধাবী। আর ব‍্যক্তিত্ব খুব। যদিও বিএর রেজাল্ট সে রকম কিছু নয়। নরেনের বাবা নিজের পরিবারকে রীতিমতো পথে বসিয়ে মরেছেন। বিএ পাশ নরেনের জন‍্য একটা শিক্ষকতার চাকরি হলে পরিবারটা বেঁচে বর্তে থাকতে পারে। বিদ‍্যাসাগর নরেন্দ্রকে চাকরি দিলেন। শিক্ষকতার চাকরি। কিন্তু সে ছেলে এখানে সেখানে সভা সমিতিতে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ায়। ক্লাস কামাই করে। ক্লাসেও সিলেবাসের বাইরে কী সব বলে, ছেলেরা বোঝে না। এভাবে তো চলতে পারে না। স্কুলে ডিসিপ্লিন চাই। কঠোর ডিসিপ্লিন। নরেন্দ্রকে চাকরি থেকে হঠিয়ে দেন বিদ‍্যাসাগর। ভাগ‍্যিস হঠিয়ে দিয়েছিলেন। নইলে বিশ্ববিজয়ী বিবেকানন্দের জন্ম হত কি?
অগাধ পড়াশুনা যে দেশে কারো ছিল না, তা তো নয়। বিদ‍্যাসাগর তো উপাধি মাত্র। বছর ঊনিশের ছেলেটা পাশ করে উপাধিই তো পেয়েছে।
কিন্তু ওটাকেই সে পরিচয় করে তুলল। বিদ‍্যার আসল কাজ আলো এনে দেওয়া। খোলা বাতাস বইয়ে দেওয়া। সাধারণ মানুষের জীবনকে পথ দেখানো। ঈশ্বর সেই কাজটি করে ছিলেন। বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন অল্পবয়সী বিধবাদের সামাজিক পুনর্বাসন দরকার। বিধবা হলেই সে আক্ষরিক অর্থে দেবী হয়ে যায় না। কামনা বাসনা লোপ পেয়ে যায় না। শরীরে যৌবন এলে বাড়ির আর পাঁচটা পুরুষ মানুষকে সামলানোও শক্ত। বাঙালি পুরুষ এমন কিছু ব্রহ্মচারী নয়।
ভাশুর ভাদ্দরবৌ সম্পর্ক ওপর ওপর থাকে। ভিতরে ভিতরে ঘরে ঘরে কেষ্টলীলা। বিদ‍্যাসাগর সার্ভে করলেন। কলকাতার যৌনপল্লীতে যত মেয়ে আছে অনেকেই ভদ্রলোকের ঘরের বিধবা। শুধুমাত্র কলকাতায়ই এমন মেয়ের সংখ‍্যা সাড়ে বারো হাজার। সাহেবরা নিয়মনিষ্ঠ জাত। বৈজ্ঞানিক যুক্তির কাছে তারা মাথা নত করে। এই যে কলকাতার যৌনপল্লী, সোনাগাছি, হাড়কাটা, এসব জায়গায় কাস্টমার কারা? সার্ভের ফলে দেখা গেল ভদ্রবাড়ির বিস্তর ছেলেপিলে বেশ‍্যাসক্ত। এই জিনিসটা ভাল? এই মেয়েদের সামাজিক পুনর্বাসন হবে না?
কিন্তু পণ্ডিতী করে খাওয়া মূর্খের দল ওসব বোঝেনা। অনুস্বার বিসর্গের ফোঁটা তিলককাটা জিনিস বের করে না দেখালে তাদের হয় না। হবেই বা কেমন করে, চিন্তার দরজা জানালায় ইস্ক্রুপ সেঁটে তারা যে বিচার বিবেচনাকে মমি বানিয়ে তোলার সাধনায় নিরত। শুষ্কং কাষ্ঠং সেই সব পণ্ডিতম্মন‍্যের জন‍্য ঈশ্বর দিনরাত পু়ঁথির পাতা ঘাঁটাঘাঁটি করেন। কোথায় পাওয়া যায় নতুন চিন্তার সমর্থনে একটা আধটা শ্লোক?
পরাশর সংহিতার পাতা থেকে উঁকি দিচ্ছে, ওটা কি? আরে, এই তো, পরাশর সংহিতা বলছেন, নষ্টে মৃতে প্রবজিতে, ক্লীবে চ পতিতে পতৌ
পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরন‍্যো বিধীয়তে।
এই তো বলা আছে, পতি মরলে নারীদের অন‍্য পতি চলবে। পতিরন‍্যো বিধীয়তে! হুররে!
কিন্তু, পণ্ডিতম্মন‍্যের দল এত সহজে হার মানবে? গোঁড়ামি আর গোঁয়ার্তুমিটাই যাদের একমাত্র ভরসা, তারা কি শাস্ত্রবাক‍্য পেলেই লাফিয়ে লাফিয়ে স্বাভাবিক বিচারবোধকে মান‍্য করবে?
তখন কথা এল দেশাচারের। দেশাচারের দাপট রুখতে বিধবা বিবাহ চালু করতে নগদ টাকা গিফট করবেন বললেন ঈশ্বর। তিনি নিজে যা সত‍্য বলে বুঝতে পারতেন, তার জন্য জান কবুল করতে দ্বিধা করতেন না।
মহামহোপাধ‍্যায় একটা প্রশংসা পত্রের উপর লাল কালি দিয়ে কি কাটছেন, আর বিড়বিড় করে কি বকছেন! হলটা কি মহামহোপাধ‍্যায়ের? ওহোঃ, ওঁকে যাঁরা প্রশংসা পত্র দিয়েছেন, তাঁরা ওঁকে বিদ‍্যাসাগর আখ‍্যা দিয়েছেন। তাই দেখে বেজায় খেপেছেন মহামহোপাধ‍্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। পঞ্চাশটি বার লাল কালি দিয়ে কাটতে কাটতে শাস্ত্রী বলেছেন, বিদ‍্যাসাগর একজনই হয়।
ব‍্যারিস্টার মধুসূদনের সঙ্গে কোনো মিলই নেই বিদ‍্যাসাগরের। মাইকেলের পরনে সর্বদা সাহেবি পোশাক। চলনে বলনে সব সময় পাক্কা সাহেবিয়ানা। ছিলেনও পয়সাঅলা বাপের ছেলে। কি মাথায় ভূত চাপল, পাশ্চাত্য সাহিত্য পড়বেন। বিশপস কলেজে গেলেন। তাঁরা হিসেবি মানুষ। কালা আদমিকে তাঁরা আসল জিনিসের সন্ধান দেবেন কেন? ধর্মের বিভেদ বলে একটা জিনিস আছে না? বাপ পিতামহের ধর্ম টান মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন মধু অন্তরের কবিধর্মের টানে। ১৮৬১ তে লিখলেন মেঘনাদবধ কাব‍্য। সেখানে অমিত্রাক্ষর ছন্দ। বাংলা ভাষায় মিল্টনের ব্ল‍্যাঙ্ক ভার্স। তারপর বীরাঙ্গনা ব্রজাঙ্গনা, এদিকে আরো আগেই নাটক শর্মিষ্ঠা, পদ্মাবতী, কৃষ্ণকুমারী। মেঘনাদবধ উলটে পালটে দেখেই বিদ‍্যাসাগর জহুরীর চোখ দিয়ে চিনে নিলেন বাংলা ভাষার আধুনিক যুগের একমাত্র মহাকবিকে। বাংলা ভাষাজননীর প্রতি বিপুল ভালবাসা দুজন সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের মানুষকে সত‍্যিকারের বন্ধু ও আত্মীয় বানিয়ে দিল। আর একটা মিল হল দুজনেই আচারের দুর্গ হেলায় লঙ্ঘন করে যেতে জানতেন। মাইকেল ছিলেন চার বছরের ছোটো। বয়সে আঠারো বছরের ছোটো বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কেও আত্মীয় বলে গণ‍্য করেছেন বিদ‍্যাসাগর। বাংলা ভাষাকে যে মানুষ অন্তর থেকে ভালবাসবেন, ঈশ্বর তারই দাসানুদাস, পরম হিতাকাঙ্ক্ষী।
নীলদর্পণ লিখেছেন দীনবন্ধু মিত্র। ও জিনিস নাম গোপন করে অনুবাদ করেছেন মধুকবি। সামনে রাখা হয়েছে রেভারেণ্ড জেমস লঙের নাম। ইংরেজের আদালত কারাদণ্ড দিল লঙ সাহেবকে। তার উপর অর্থদণ্ড। অর্থদণ্ডের টাকাটা গুণে দিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। হুতোমপেঁচা। বাংলা গদ‍্যের নব অবয়ব গড়তে হুতোমের দান অসামান্য।
নীলদর্পণ বাংলাদেশের মঞ্চ কাঁপাচ্ছে। নাটক দেখে বাঙালি জাগছে। নীলকর সাহেবের চরিত্রে চুটিয়ে অভিনয় করছেন অধীর মুস্তফি। হাবেভাবে চলনে বলনে মঞ্চে পাক্কা সাহেব সেজেছেন তিনি। নাটক দেখতে এসেছেন বিদ‍্যাসাগর। নাটক দেখতে দেখতে ভুলে গেছেন নাটক দেখছেন। মঞ্চের উপর অত‍্যাচারী নীলকর সাহেবকে চটি ছুঁড়ে মারলেন। মাথার উপর বিদ‍্যাসাগর মহাশয়ের চটি নিয়ে আপ্লুত অভিনেতা অধীর মুস্তফি। বললেন, এই আমার সব সেরা পুরস্কার।
বিধবাদের বিবাহ চালু করতে হবে। বিদ‍্যাসাগর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যা ভাল বলে বোঝেন, তার জন‍্য জান বাজি রাখতে জানেন। বিপক্ষের লোকেরা বিদ‍্যাসাগরের সঙ্গে যুক্তি বুদ্ধিতে না পেরে জানে খতম করে দিতে চায়। মায়ের প্রাণ কাঁদে। ঈশ্বরের জন‍্যে দেহরক্ষী হিসেবে শ্রীমন্ত লাঠিয়ালকে পাঠিয়ে দিয়েছেন মা। অন্ধকারে পথ চলছেন ঈশ্বর। ওই যে দূরে ওরা কারা? ছিরে, কাছে আছিস্ তো?
শ্রীমন্ত সর্দার কাঠখোট্টা গলায় বলে চিন্তা কোরো না, দা ঠাউর।
অনেক পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে নিয়ে ভাববেন। সেরা ভাবনাটি তাঁরই। পাঠসত্রের ছাত্রদের জন‍্য প্রশ্নপত্র বানান রবীন্দ্রনাথ। সহজপাঠ লেখেন রবীন্দ্রনাথ। তাতে ছবি চাই। নন্দলাল বসুর আঁকাই চাই। বইয়ের দাম বাড়লে বাড়ুক। ছেলেদের ঠিক ঠিক কি চাই তিনি জানেন। প্রথম যৌবনে বাবার উপর পূর্ণমাত্রায় নির্ভরশীল রবি এক বিধবা আত্মীয়ার পুনর্বিবাহ ঠেকাতে গিয়েছিলেন। পরে সেই রবীন্দ্রনাথ নিজের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিধবা বিবাহ আয়োজন করেন। না হাততালি পাবেন বলে নয়, ঊনত্রিশ বছর বয়সে তাঁর বধূ চলে গিয়েছেন চির চলার দেশে। মেয়েটিকে মৃণালিনী পছন্দ করে গিয়েছেন। বধূর ইচ্ছাকে সম্মান করেন রবীন্দ্রনাথ। নোবেল এল। সম্বর্ধনা জানাতে এল বাঙালি সাহিত্যসেবীর দল। সামনের সারিতে যারা বসে আছে তাদেরকে দেখে গা জ্বলে গেল কবির। দিনের পর দিন ওরা গালি দিয়েছে, কুৎসা করেছে, আর আজ নোবেল মিলেছে বলে দ‍্যাখো ভড়ং করতে এসেছে। ভাষার আগল খুলে দিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বিদ‍্যাসাগরকে মূল‍্যায়ন করতে গিয়ে নিজের মূল‍্যায়ন করেছেন। বলেছেন বঙ্গদেশে তিনি একক ছিলেন। একা লোকেই একাকিত্বের মর্ম বোঝেন। মাইকেল দূর হতে ভিজে চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে বলেন, দীন যে দীনের বন্ধু। রবীন্দ্রনাথ মাথাটি আকাশে ছুঁতে ছুঁতে বলেন তিনি বঙ্গদেশে একক ছিলেন। সহৃদয় যে জন, সেই একমাত্র বুঝতে পারে।
অজস্র যন্ত্রণা সয়েছেন বিদ‍্যাসাগর। অজস্র প্রতারণা। শেষে বীরসিংহে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। স্ত্রীর সাথেও বনিবনা ছিল না। গভীর হতাশা গ্রাস করতে চায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক পরে বলবেন, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ কর নি। হতাশার নোনা জলে হাবুডুবু খেতে থাকেন। এমন দিনে তিনি এলেন। বললেন, খাল নয়, বিল নয়, এ যে সাগর! অভিমানে ঈশ্বর বললেন, বেশ তো খানিকটা লোণা জল নিয়ে যান।
অমৃতের সাগরকে ঠিকটি চিনেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। চিনেছিলেন রক্তমাংসের ঈশ্বরকে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।