সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ২০)

মজুর, মার্ক্স ও মে দিবস

আপনারা নিশ্চিতরূপেই বিশ্বাস করেন না যে মালিকেরা শ্রমিকদের কথায় সুড়সুড় করে ক্ষমতা আর বৈভব ছেড়ে চলে যাবে। তাহলে হাতে র‌ইল কী? না, গায়ের জোরে, বলপ্রয়োগের পথেই ঠিক করে নিতে হবে সবকিছু। না কি, আপনাদের আর ভিন্নতর কোনো পথ জানা আছে?

প্রশ্ন: তাহলে আপনারা একটা বিপ্লব সংগঠিত করে তুলছেন?

উত্তর: আমার গ্রেপ্তারির অল্প আগে আমি এই প্রশ্নের জবাবে বলেছিলাম, বিপ্লবের মতো জিনিসকে সংগঠিত করে তোলা অত‍্যন্ত শক্ত। বিপ্লব হল অত‍্যন্ত উত্তেজিত জনগণের একটা হঠাৎ বিপুল অভ‍্যুত্থান, জ্বোরো রুগির সাংঘাতিক খিঁচুনির মতো। তবে, আমরা সেই লক্ষ্যে সমাজকে তৈরি করে চলেছি। আমরা শেখাচ্ছি যে শ্রমজীবী মানুষ অস্ত্রের যোগাড় রাখুন, হাতিয়ার ধরতে শিখুন, যুদ্ধের জন্য জোট বেঁধে তৈরি হোন।

শ্রমজীবী মানুষ যত মজবুতভাবে সংগঠিত হবেন, যত দক্ষতা ও যোগ‍্যতা, কুশলতার সঙ্গে তাঁরা অস্ত্র ব্যবহার করতে শিখবেন, ততই যুদ্ধটা সহজ হবে, আর লোকক্ষয়‌ও হবে কম।

প্রশ্ন: নতুন সমাজ ব‍্যবস্থার নিয়মকানুনগুলি কী হবে?

উত্তর: আপনার এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া আমার ঠিক হবে না। কেননা, এখনো অবধি এই বিষয়টা একেবারেই সম্ভাবনার স্তরে রয়েছে। সমবায়ের নীতি ও পদ্ধতির ভিত্তিতে শ্রমিকদের সংগঠিত করতে কোনো সমস্যা হবে না। আজকের দিনে যেসব বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানগুলি দাঁড়িয়ে আছে, ওগুলিকে একটা প‍্যাটার্ন হিসেবে ব‍্যবহার করা যেতে পারে।

যাঁরা, যে চিন্তানায়কেরা এইসব প্রশ্নের মীমাংসা সন্ধানে কাজ করবেন, দায়িত্ব র‌ইল তাঁদের কাঁধেই। আমরা এই মীমাংসা সম্বন্ধে যা বলছি, আদৌ যদি আমরা এমন কোনো মীমাংসার হদিশ দিই, তাহলে সেই পথে তাঁরা হাঁটতে বাধ‍্য নন। তাঁরা তাঁদের সময়ের দাবি ও পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী পথের খোঁজ করবেন। এটা বলে নিই যে এসব এখনো আমাদের চিন্তা ও জ্ঞানরাজ‍্যের পরিসীমার বাইরে। আর এসব নিয়ে আপনাদের মাথাব্যথা করে কোনো ফায়দা নেই।

প্রশ্ন: কিন্তু, বন্ধু, আপনার কি মনে হয় না, সমাজে এমনতর ভাগাভাগি ঘটে যাবার সপ্তাহটাক সময় পরেই নিষ্কর্মারা সবকিছু পকেটে পুরে বসবে, আর যারা কষ্ট করে ধনসম্পদ জমিয়েছেন, তাঁরা নিঃস্ব হয়ে পথে বসবেন?

বিচারসভার চেয়ারম্যান আলোচনার মধ‍্যে হস্তক্ষেপ করে বললেন, এই প্রশ্নটি আমরা গ্রহণ করছি না, এটা আউট অফ অর্ডার, অপ্রাসঙ্গিক একটা প্রশ্ন। সমাজে ভাগাভাগি নিয়ে কিছুই এখানে বলা হয় নি।

অধ্যাপক উইলকক্স: মিস্টার স্পিজ, আপনি কি মনে করেন না যে সমাজতন্ত্র কায়েম হলে সমাজে ব‍্যক্তিস্বাতন্ত্র‍্য, ব‍্যক্তিমানুষের চিন্তা ও কর্মের অধিকার সামূহিকভাবে সমূলে ধ্বংস হয়ে যাবে?

স্পিজ: হাসালেন দেখছি। যা আদৌ নেই, তেমন জিনিসটা ধ্বংস হবে কেমন করে? আমরা যে সময়টা কাটালাম, এই সময় ব‍্যক্তিমানুষের স্বাতন্ত্র্যের অস্তিত্ব ক‌ই? ব‍্যক্তিস্বাতন্ত্র‍্য গড়েই উঠবে সমাজতান্ত্রিক পরিবেশে, যে সময় মানবসমাজ অর্থনৈতিক প্রশ্নে স্বাধীন হয়ে উঠবে। আজকের জমানায় আপনি ব‍্যক্তিস্বাতন্ত্র‍্য বলতে সত‍্যি সত‍্যি যা বোঝায়, তা খুঁজে পাবেন কোথায়? ভদ্রমহোদয়গণ, একবার নিজের নিজের পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে দেখুন, আপনাদের মালিকেরা আর কাস্টমারেরা যা অনুমোদন করেন না, তেমন ব‍্যাপারে মন খুলে মতামত দেবার স্বাধীনতা আছে আপনাদের? যা করলে মালিকদের শান্তি বিঘ্নিত হয়, গায়ে জ্বালা ধরে, তেমন কিছু করার এক্তিয়ার আছে আপনাদের?

আপনারা মালিকরা সব হিপোক্রিট (সভাস্থলে গুঞ্জন শোনা যায়। অস্বস্তি ঘনিয়ে ওঠে।) কান খুলে শুনুন, প্রত‍্যেকটা পুঁজিপতি ব‍্যবসাদার এক একটা হিপোক্রিট। সব কয়টা ব‍্যবসার নামে ভাঁওতাবাজি করে, নোংরা, অনর্গল মিথ‍্যে কথা বলে, যত্ত ঠগবাজ সব। আর শ্রমিকগণ! আপনারা এই মিথ‍্যাবাদী ভাঁওতাবাজ লোকগুলোর ব‍্যক্তিস্বাতন্ত্র‍্য নিয়ে চিন্তিত, তাই না? আর আপনারা শ্রমিকরা, আপনাদের গোটা শ্রেণীটাকেই তো মেশিন বানিয়ে দেওয়া হয়েছে! লোহালক্কড়ের মেশিনের সঙ্গে দিনের পর দিন দশ থেকে বার ঘণ্টা জুতে থেকে হাড়ভাঙা খাটুনির পর আপনার মধ‍্যে চিন্তা ভাবনা মতপোষণ আর মতপ্রকাশের কতটুকু সামর্থ্য অবশিষ্ট থাকে? এই জায়গায় যারা আপনাদের ঠেলে দিয়েছে, সেই পুঁজিমালিকদের ব‍্যক্তিস্বাতন্ত্র‍্য রক্ষার জন‍্য আপনারা দুশ্চিন্তা করছেন!

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।