শ্যামলী বাড়ি ফিরতেই বাবা মা জিজ্ঞাসা করলেন, কি রে কি হল?
শ্যামলী বলল, কিছুই হয় নি।
শশাঙ্ক বললেন, তাহলে ওর মা তোকে ডাকল যে?
শ্যামলী বলল, জ্যেঠিমা ডাকছেন বলে আমি গিয়েছি, এমন তো নয়! রমানাথের জন্য মনটা কেমন করে উঠল, তাই দেখা করে এলাম।
বাসন্তীবালা বললেন, দিদিকে প্রণাম করেছিস তো?
শ্যামলী বলল, খামোখা প্রণাম করতে যাব কেন? প্রথম পরিচয় হলে বুকের কাছে একটু হাতজোড় করলাম। ব্যস, হয়ে গেল। আমার ওসব প্রণাম ট্রনাম আসে না মা।
বাসন্তীবালা মৃদু অনুযোগের সুরে বললেন, একটা সম্পর্ক হতে যাচ্ছে, এখন একটু এসব করতে হয়।
শ্যামলী বলল, কী আবার সম্পর্ক হতে যাচ্ছে। সম্পর্ক তো একটা আছেই। সেইজন্যই তো ছুটে গেলাম।
শশাঙ্ক পাল বললেন, কী হয়েছিল রমানাথের?
শ্যামলী হেসে বলল, মায়ে ছেলেতে মন কষাকষি চলছে। বাবু বাড়িতে নিরম্বু উপবাস করছিলেন। আমি গিয়ে অনেক গল্পটল্প বলে উপবাস ভাঙালাম।
শশাঙ্ক পাল বললেন, বাঃ বেশ করেছিস্। তা রমানাথের মা আর কিছু বলল?
শ্যামলী বলল, কী আর বলবেন উনি! শুধু বললেন, ছেলের যখন এতই ইচ্ছে তখন সামনের অঘ্রাণেই ছেলের বিয়ে দেবেন। ওসব কালাশৌচ, মহাগুরুনিপাত, ওসব ভজকট মানবেন না। গুরুদেবের পারমিশন আনিয়ে নিতে পারবেন এমন কনফিডেন্স আছে বললেন।
বাসন্তীবালা বললেন, সে কি রে? এক্ষুণি আমাদের প্রস্তুতি কোথায়? তোর শুনি সামনে পরীক্ষা, ভাইগুলোর মাথার ওপর মামলা ঝুলছে, তোর বিয়ের গহনাগুলো বেচে দিয়ে কারবারের দেনা শোধ করলি। হাতে সে রকম টাকা নেই। অঘ্রাণ মাস তো চলে এল বলে!
শশাঙ্ক পাল বললেন, না না, নকুড়দাদা মারা যেতে না যেতে এ রকম হওয়া ঠিক নয়। দেখা সাক্ষাৎ করাটা কিছু এমন দোষের নয়, তবে লৌকিকতা বলে একটা ব্যাপার আছে। বাবা মা এই রকম আপনজনেরা মারা গেলে একটা বছর অপেক্ষা না করলে নিন্দে হবে। বাসন্তীবালার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে তিনি বললেন, মেয়েটা যেতে চায় নি, তুমিই কাল ঠেলেঠুলে জোর করে ওকে পাঠিয়েছিলে।
বাসন্তীবালা রেগেমেগে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি খুব জানি, শেষমেশ দোষ হবে সেই আমার। তোমার মেয়ে যদি নিজেকে সামলে সুমলে রাখত, দিদির কাছে কাছে থাকত, তাহলেই দিদি আর রাগ করার সুযোগ পেতেন না। আমি ওর মাকে বেশ জানি, একটু পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেই ওঁর সব রাগ গলে জল হয়ে যায়। তোমার মেয়ের কি দরকার ছিল রমাটার সাথে ছাতে গিয়ে আড্ডা মারার? বাড়িতে আত্মীয়স্বজন ভরতি। ওর বাপের শ্রাদ্ধ শেষ হতেই ছাতে গিয়ে গল্প না করলেই চলছিল না তোর?
সবিতা দাঁড়িয়ে কোমরে হাত দিয়ে বলল, চলো এখন সবাই খেয়ে নেবে চলো। আমার শরীর আর দিচ্ছে না।
বাসন্তীবালা তাকে তড়পে উঠে বললেন, তোর খিদে পেয়ে থাকে তুই খা গিয়ে।
সবিতাও গলা চড়িয়ে বলল, বৌরাণি, এটা কেমনধারা কথা হল? তোমাদের না খাইয়ে এই শর্মা খেয়েছে কোনো দিন? কেউ বলতে পারবে? বলি, ঘড়িটার দিকে তাকাবে না একবার?
শশাঙ্ক পাল সবিতাকে বললেন, আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে হয়েছে। তুই নিচে গিয়ে যোগাড়যন্ত্র কর্, আমরা এক্ষুণি যাচ্ছি।
সবিতা হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলল, না দাদা, সবিতা আর আগের সেই বোকা মেয়েটা নেই, যে যা হোক কিছু একটা ভুলভাল বুঝিয়ে নিচে পাঠিয়ে দিলে তারপর চালিয়ে গেলে তোমাদের গোলটেবিল বৈঠক। আমি সবাইকে নিয়ে নিচে যাব, আর খাইয়ে ওপরে পাঠাব। তারপর গলার স্বর নামিয়ে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল, বেশি দেরি করে খাওয়া কি ভাল!
খাবার টেবিলে তিনজনের জন্য খাবার সাজানো হয়েছে দেখে বাসন্তীবালা বললেন, সে কিরে, আমাকেও টেবিলে দিলি কেন? আমি তো তোর সাথেই খাব।
সবিতা বলল, গল্প করতে করতে খেয়ে নাও দিকি। তাহলে ওপরে গিয়ে তাড়াতাড়ি শুতে পারবে। বৌরাণি তো আবার কথা বলতে শুরু করলে গলাটা সপ্তমে চড়ে যায়!
বাসন্তীবালা রেগে গিয়ে বললেন, কি বললি তুই সবিতা, আমিই সব সময় চেল্লাই? আর কেউ চেল্লায় না, না?
শশাঙ্ক পাল হেসে সবিতাকে মৃদু ধমক দিয়ে বললেন, তুই মাঝে মাঝে সত্যি কথা বলে ফেলিস্ কেন? তোর বৌরাণি চেঁচিয়ে কথা বলে তো তোর কি? আমার ওটা বেশ সয়ে গিয়েছে। শুধু সয়েই যায় নি, এখন তোর বৌরাণি চেঁচিয়ে কথা না বললে আমি শুনতেই পাই না।
বাসন্তীবালা বললেন, কপাল, কপাল। সব আমার কপাল! বুক দিয়ে ঠেলে ঠেলে এই সংসারটাকে দাঁড় করালাম, এখন আমিই হলাম চক্ষুশূল!
শশাঙ্ক পালের দিকে তাকিয়ে বাসন্তীবালা বললেন, মেয়েটাকে লাই দিয়ে দিয়ে তুমি মাথায় তুলেছ, আর এখন একটা বিপদ ঘাড়ে চাপল বলে আমার ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছ, যে আমি কেন ওকে পাঠালাম! সামাজিকতা, লোক লৌকিকতা বলে একটা কথা আছে না? মানুষ নিজে বাড়ি বয়ে নিমন্ত্রণ করে গেলে যেতে হয়। তার উপর তারা গাড়িটা পর্যন্ত পাঠিয়ে দিয়েছে। যাব না বলা যায়?
শশাঙ্ক পাল বললেন, খাও, খেয়ে নিয়ে কথা বলো। হঠাৎ সবিতার দিকে চেয়ে বললেন, ওরে, তোর থালা কই রে? রুটিই বা কই? কি খাচ্ছিস দেখি?
হাত দিয়ে সবিতা তাঁর খাবারের পাত্র আড়াল করেন। বলেন, ও কিছু না।
শশাঙ্ক পাল বললেন, কিছু না মানে কি? রুটি কই তোর?
সবিতা বললেন, বেড়ালের জন্যে একটু ভাত রেখেছিলাম। তো সে হতভাগা আজ আর আসেনি। তাই আমি খেয়ে নিচ্ছি।
কড়া গলায় শশাঙ্ক বললেন, তোর রুটি করিস্ নি?
সবিতা বলল, করেছিলাম। মাংসটা বড্ড বেশি ভাল লাগছিল বলে ছোটো খোকা খেয়ে ফেলেছে।
শশাঙ্ক পাল নিজের পাত থেকে দুটো রুটি তুলে নিজে সবিতার কাছে গিয়ে বললেন, দাদা হই, আমার এঁটো খেতে তোর দোষ হয় না। খা!
শ্যামলী হেসে বলল, এবার থেকে রান্না কেমন হয়েছে আগে টেস্ট করবে। বেশি রকম ভাল হলে রুটি মাখা আটার বরাদ্দ বাড়াবে।
বাসন্তীবালা বললেন, বাজে কথা থামাবি? ওদের বাড়ির ব্যাপারটা কি করে সামলাবি, বাবার সাথে সেই পরামর্শ কর্।
শ্যামলী বলল, ও তুমি চিন্তা কোরো না মা, আমি সব ম্যানেজ করে ফেলেছি।
রুটি চিবাতে চিবাতে শশাঙ্ক বললেন, কি রকম ম্যানেজ?
শ্যামলী নির্বিকার ভাবে বলল, আমি জ্যেঠিমা কে বলে এসেছি, আমি আপনার ছেলেকে বিয়ে করব না।