জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর।
বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন।
চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।
চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ, ঝড় আর জীবাণু
কি আশ্চর্য, ঝড় আর চন্দ্রগ্রহণ একসাথে!
কিছু লোকের খোকামি কোনোদিন কাটে না।
চন্দ্রগ্রহণ হয় তখন, যদি চাঁদ আর সূর্যের মাঝখানে পৃথিবী চলে আসে। সূর্যের থেকে আসা আলো চাঁদের উপর পড়ে। তাই আমরা চাঁদকে দেখি। চাঁদ আর সূর্যের মাঝে পৃথিবী চলে এলে পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপর খানিকটা সময় পড়বে। যেহেতু চাঁদ ও সূর্যের মতোই পৃথিবীও চলছে, তাই কিছু ক্ষণের মধ্যে ওই ছায়াটাও সরে যাবে। সূর্যের আলোতে চাঁদের গায়ে পৃথিবীর ছায়া পড়াটাই হল চন্দ্রগ্রহণ।
চাঁদ আছে পৃথিবী থেকে তিনলক্ষ চুরাশি হাজার চারশ কিলোমিটার দূরে। এটা গড় দূরত্ব। এই দূরত্ব কখনো প্রায় চারলক্ষ কিলোমিটার ছাড়ায়, আবার কখনো তিনলক্ষ তেষট্টি হাজার কিলোমিটার এর একটু বেশি হয়।
সূর্য আছে পৃথিবী থেকে পনের কোটি কিলোমিটার দূরে। অবশ্য এটা গড় দূরত্ব। সূর্য আর পৃথিবীর মাঝখানে চাঁদ ঢুকে পড়লে সূর্যগ্রহণ হয়। আমরা তখন সূর্যের গায়ে চাঁদকে দেখতে পাই।
চাঁদ সূর্য আর পৃথিবী সবসময় সমতলে থাকে না। সমতলে থাকা কালে গ্রহণ হয়।
পৃথিবীর উপর বাতাসের একটা চাদর আছে। তার যে এলাকায় ঝড় বৃষ্টি হয় , সেটা আট থেকে দশ কিলোমিটার পুরু। এর উপরে বাতাস বেশ পাতলা। পৃথিবীর একশো কিলোমিটার উপরে কারমান লাইন। ধরা হয়, ওখান থেকে মহাকাশের শুরু। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, পৃথিবী থেকে চাঁদের মাঝখানে যে ফাঁকা জায়গাটা, তার বেশিরভাগই একদম ফাঁকা। ফাঁকা মানে ফাঁকা, বাতাসটুকুও নেই। তাই ঝড়ের প্রশ্ন নেই। চন্দ্রগ্রহণের সঙ্গে ঝড়ের কোনো সম্পর্ক থাকতেই পারে না।
জীবাণু জিনিসটা মানুষ এই সেদিন জেনেছে। ১৬৭৬ সালে আন্তন ভ্যান লিউয়েনহক অণুবীক্ষণ যোগে প্রথম অণুজীব দর্শন করেছিলেন।
মানুষের পেটের ভিতর বিপুল পরিমাণে জীবাণু থাকে। সবথেকে বেশি জীবাণু থাকে মানুষের চামড়ায়। মানুষ এবং জন্তুর মলে যথেষ্ট পরিমাণে জীবাণু থাকে। প্রাণীর শরীর থেকে নির্গত নানাবিধ পদার্থে জীবাণু থাকে ও প্রাণীর কামড় ও আঁচড় থেকে জীবাণুর সংক্রমণ হতে পারে।
পৃথিবীর প্রায় সবখানে জীবাণু ছড়িয়ে আছে। একগ্রাম মাটিতে চল্লিশ মিলিয়ন জীবাণু আছে। এক মিলিলিটার জলে এক মিলিয়ন জীবাণু আছে। মিলিয়ন মানে দশলক্ষ। সব জীবাণুই মানুষের শত্রু নয়। জীবাণুদের অনেকগুলিই মানুষের কাজে লাগে। জীবাণু মানবশরীরে দরকারি ভিটামিন বি ১২ তৈরি করে। আমাদের জন্য প্রোটিন তৈরি করতেও জীবাণুর ভূমিকা আছে। শিম্ব অর্থাৎ ডালজাতীয় উদ্ভিদের শিকড়ে তারা থেকে বাতাসের নাইট্রোজেনকে পাকড়াও করে প্রোটিন তৈরির কাজ করে। দুধ থেকে দই তৈরির কাজে ব্যাকটেরিয়ার ভূমিকা আছে। ভাল ব্যাকটেরিয়ার পাশাপাশি বিপজ্জনক ব্যাকটেরিয়াও আছে। তারাই কলেরা, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ এসব রোগ বাধায়।
ব্যাকটেরিয়া নামটি দিলেন ক্রিশ্চিয়ান গটফ্রিড এহরেনবার্গ। সেটা ১৮২৬ সাল। ১৮৫৯ এ লুই পাস্তুর (১৮২২ – ১৮৯৫) দেখালেন দুধ, ফলের রস ইত্যাদি স্বতস্ফূর্তভাবে গেঁজে ওঠে না। বাতাসে থাকা ব্যাকটেরিয়া এই গেঁজে ওঠার কারণ। আর জলাতঙ্ক রোগের টীকা আবিষ্কার করলেন। ১৮৮৫ সালের ১৬ জুলাই জোসেফ মিইস্তার নামে এক বালক যাতে জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত না হয়, তার প্রতিষেধক টীকা তিনি দেন। লুই পাস্তুর এর হাত ধরে ব্যাকটেরিয়া নিয়ে আমাদের খোঁজ খবর শুরু হল। ব্যাকটেরিয়া নিয়ে কাজে খুব বড় অবদান আছে রবার্ট কখ এর। কলেরা, অ্যানথ্রাক্স, যক্ষ্মা, এইসব মারাত্মক রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তিনি বিখ্যাত। রবার্ট কখ কলকাতাতেও এসেছিলেন। সেটা ১৮৮৪ সাল। তখন কলকাতায় কলেরার প্রকোপ চলছে। হাজার হাজার মানুষ মরছে কলেরায়। কখ দেখালেন গঙ্গার জলে বিপুল পরিমাণ কলেরার জীবাণু থিকথিক করছে। কলেরায় মৃত শতখানেক মানুষের শবব্যবচ্ছেদ করে তা প্রমাণ করে দেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে তাঁর অবদানের জন্য ১৯০৫ সালে তাঁকে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। ১৯০২ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন রোনাল্ড রস। তিনি কলকাতায় বসে ম্যালেরিয়া রোগের কারণ আবিষ্কার করেন। স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশা তার শরীরের লালাগ্রন্থিতে একটি আদ্যপ্রাণী বা প্রোটোজোয়া বহন করে। প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপেরম, প্লাজমোডিয়াম ভাইভ্যাক্স, আর প্লাজমোডিয়াম ম্যালেরি।
নরওয়ের বিজ্ঞানী গেরহার্ড হেনরিক আরমাউয়ার হ্যানসেন ( ১৮৪১ – ১৯১২) ১৮৭৩ সালে দেখালেন কুষ্ঠ রোগের জন্য দায়ী একটা জীবাণু। তার নাম হল মাইকোব্যাকটেরিয়াম লেপরি।
টাইফয়েড আরেকটি বিপজ্জনক অসুখ। তার পিছনে যে ব্যাকটেরিয়া ক্রিয়াশীল, তাকে আমরা চিনি সালমোনেল্লা এনটেরিকা এনটেরিকা নামে। ১৮৮০ সালে বিজ্ঞানী কার্ল যোসেফ ইবার্থ তাকে টাইফয়েড বাধানোর জন্য দায়ী করেন। তার প্রকোপ ঠেকানোর ওষুধ বের করেন বিজ্ঞানী আলমরথ এডওয়ার্ড রাইট। সেটা ১৮৯৬ সাল।
ব্যাকটেরিয়া রুখতে অ্যান্টিবায়োটিকের ধারণা আনলেন পল এহরলিক। সিফিলিস এর মতো বিপজ্জনক রোগকে বাগ মানানোর চেষ্টা করলেন তিনি। সেটা ১৯১০ সাল। আলেকজান্ডার ফ্লেমিং ব্যাকটেরিয়া নিয়ে কাজ করতে গিয়ে লক্ষ করলেন পেনিসিলিয়াম ছত্রাকের উপস্থিতিতে ব্যাকটেরিয়ার বাড়বাড়ন্ত রুখে যায়। তিনি জীবাণুনাশক পেনিসিলিন আবিষ্কার করলেন। সেটা ১৯২৮ সাল। ১৯৩০ সালে ফ্লেমিং এর ছাত্র চোখের সংক্রমণ সারাতে পেনিসিলিন ব্যবহার করে সাফল্য পেলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনে আহত মানুষের ঘা সারাতে প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পেনিসিলিনের প্রয়োজন ছিল। সেকাজে সাফল্য পেলেন হাওয়ার্ড ফ্লোরি আর আর্নস্ট বরিস চেইন। সেটা ১৯৪০ সাল। এরজন্য তাঁরা ১৯৪৫ সালে ফ্লেমিং সাহেবের সঙ্গে একযোগে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
১৯৭২ সালে কার্ল উয়োসে জীবাণুবিদ্যায় গভীর আলোকপাত করেন।
জীবাণু আছে পৃথিবীতে। পৃথিবীর মাটিতে জলে বাতাসে তাদের রাজত্ব। মহাশূন্যে বাতাস মাটি জল নেই বলে জীবাণুর দাপটও নেই। গ্রহণের ফলে আলাদা করে জীবাণুর সংখ্যাবৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনা নেই।
বৈজ্ঞানিকগণ তাঁদের দীর্ঘ গবেষণায় দেখিয়ে দিলেন জীবাণু আটকাতে তুকতাক মন্ত্রতন্ত্র নয়, যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ দরকার। তার গোড়ায় আছে খুঁটিয়ে বোঝা, পরীক্ষা নিরীক্ষার মানসিক গঠন।