দেবিকা লক্ষ্মীর খুব কাছের বান্ধবী। সে কয়েকদিন ধরে লক্ষ্মীর বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করছে। দেবিকা কৌতুহলে জিজ্ঞাসা করল,- লক্ষ্মী কি ব্যাপার বলতো তোর? চুপিচুপি কোথাও প্রেম করছিস নাকি?
লক্ষ্মী এক গাল হাসি হেসে বলল,- সে আর পারলাম কই? আমি তো আর তোর মত কপাল করে আসেনি।
দেবিকা সাইন্স এর সেরা ছাত্র প্রিতমের প্রেমিকা। এ কথা লক্ষী সহ স্কুলের প্রায় সবাই জানত। দেবিকা মুখ ফিরিয়ে হাসিয়ে স্তব্ধ করে বলল- প্রীতম কে বলব তোর কথা?
লক্ষী একটু হাসলো, তারপর বলল,- তুই ছাড়বি তারপর তো। কথা বলতে বলতে লক্ষী দেখলো সামনের সিঁড়ি দিয়ে রাজ উপরে আসছে। লক্ষী দেবীকাকে ডেকে বলল,- দেবী দ্যাখ ছেলেটাকে। দেবিকার এক মুহূর্ত চিনতে দেরি হলো না। সঙ্গে সঙ্গে বলল, ঐ -তো সেই ছেলেটি।
লক্ষী দেবিকা কে বলল, – শোন দেবি সেদিন থেকে আমি নিজের কাছে খুব ছোট হয়ে আছি। চল না ওর সঙ্গে একটু কথা বলি।
দেবিকার বুঝতে আর বাকি রইল না। সে বলল বেশতো দু-পিরিয়ডের পর আজ এক- পিরিয়ড অফ, ওই সময় বলা যাবে। আর হ্যাঁ আমি শুনেছি ও নাকি ভালো গান গায়। তুই চাইলে প্রশান্ত কে বলে ওর কাছে একটা গান শোনা যাবে।
লক্ষ্মী এমন একটা কিছু চাইছিল। তাই সে আর দ্বিমত না করে বলল, বেশ তাই হবে। লক্ষী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল তৃতীয় পিরিয়ডের অফ টাইম টার জন্য। ইতিমধ্যে দেবিকার সমস্ত ব্যবস্থা পাকা করে রেখেছিল।
প্রশান্ত কে ডেকে বলল, রাজ আজ একটা গান গাইতে হবে। প্রশান্তর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না থাকলেও খারাপ ছিল না। তাই কথা ফেলতে পারল না।
দেবিকা লক্ষী সহ আরো কয়েকজনকে নিয়ে প্রশান্ত আসর সাজে নিল। প্রশান্ত টেবিল বাজাতে শুরু করল, আর রাজ গাইল স্বর্গীয় শিল্পী মোহাম্মদ রফির একটি বাংলা গান-“ ও তোমার নীল দোপাটি চোখ, শ্বেত দোপাটি হাসি, আর খোঁপাটিতে লাল দোপাটি দেখতে ভালোবাসি।
আসর বেশ জমে উঠেছিল, কিন্তু পাশের ঘরের অবজেকশনে প্রধান শিক্ষক এসে হাজির, সমস্ত প্লানটাই হল মাটি।
এক পলক দেখে একটু হাসি নিয়েই শেষ হলো প্রায় বর্ষা। এখন মনের অজান্তে কখন ভালবেসে ফেলেছে দুজন দুজনকে। প্রেমের গভীরতা এতটাই বেশি একজন একদিন স্কুলে না এলে পৃথিবী শূন্য বলে মনে করত অন্যজন। হঠাৎ লক্ষ্মীর আসার কোন ধারাবাহিকতা নেই দিন দশেক। যেদিন আসতো পড়াশোনা বাদ দিয়ে রাজের মুখপানে তাকিয়ে বসে থাকতো। রাজ স্পষ্ট বুঝতে পারত লক্ষী কিছু বলতে চায়। কিন্তু অন্যদের ভয়ে লজ্জায় মুখ নিচু করে নিতো। বাড়ি ফিরে রাত্রি যখন পড়তে বসতো চোখের সামনে ভেসে আসত লক্ষ্মীর করুন মুখচ্ছবি। চোখের জলে ভেসে যেত ইতিহাসের পাতা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংবিধান…
হায়রে মানুষের মন! এ যে কিসে ভাঙ্গে কিসে গড়ে তার কোনো সঠিক তত্ত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। মাত্র ক’দিনের পরিচিত মানুষ কে হারিয়ে ফেলার ভয়ে কত রাত অনিদ্রায় অশ্রুপাতে ভাসিয়ে দেয়, আবার কত পরিচিত, আত্মীয়-স্বজন ভুলে গিয়ে কত অপরিচিত কোন মানুষকে কেমন করে আমার বলে তার মন জোগানো যায়!
রাত্রি অনেকক্ষণ চলে যায়, লক্ষ্মী তেমনভাবে বসে থাকে। তার অন্তরটা কষ্টে নয় অন্তর্দাহে জ্বলে যায় সমস্ত রাত্রি। কেবল মনে হতে লাগে যাকে ভালোবাসি সে যদি হারিয়ে যায় কালের প্রবাহে।
শীতের সকাল টা আজ কুয়াশায় ভরিয়ে দিয়েছে সমস্ত আকাশ। বৃষ্টি পড়ছে গুড়ি গুড়ি। লক্ষ্মী ও রাজ স্কুলে এলেও অনুপস্থিতির হার এত বেশি, প্রায় ক্লাস করা অসম্ভব।
লক্ষী বাড়ি থেকে আজ পণ নিয়ে এসেছে। ভালোবাসি -এই ছোট্ট কথাটির আজকে বলেই ফেলবো। কারণ আজ তার জীবনের শেষ স্বাধীন স্কুল। দুদিন বাদে আগামী বুধবার তার শুভ প্রণয় ঘটবে বাবার পছন্দমত সদ্যপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষকের সঙ্গে। খুব কষ্ট করে সে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। এরপর তাকে আর একা বাড়ির বাইরে যেতে দেবে না। কথা বলার শুভ সময় আজ। হয়তো আর কোনদিন রাজ -এর সঙ্গে তার দেখা হবে না।
লক্ষ্মী সুযোগ বুঝে ডাক দিল, রাজ, শোনো। জীবনের প্রথম রাজকে নাম ধরে ডাকলো।রাজ চৌকাট পেরিয়ে সামনের খোলা বারান্দায় আসলো। লক্ষ্মী রাজের হাত ধরে বলল, ওই পাশটায় চলো, তোমার সঙ্গে কথা আছে।