• Uncategorized
  • 0

রবিবারে রবি-বার – এ মৃদুল শ্রীমানী – ৭

রবীন্দ্রনাথ আর ছেলেটা

সূর্য ঢলেছে পশ্চিম দিগন্তে। সহসা কি হল, আবার একটুখানি ঝলমল করে উঠল আকাশ। সকলেই জানে এখনি সন্ধ্যা আসবে। দিনমণি অস্তে যাবেন। তবু যেন আবার ফিরে দেখা। ১৯৩২ সালের আগস্টের মাঝামাঝি, বাংলা ২৮ শ্রাবণ, ১৩৩৯ তারিখে একটি কবিতা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিতার নাম ‘ছেলেটা।’ স্থান পেয়েছে “পুনশ্চ” কাব্যগ্রন্থে। কবিতাটি বেশ দীর্ঘ। একটা বছর দশেকের ছেলেকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন সত্তর অতিক্রান্ত বিশ্বখ্যাত মানুষটি। ছেলেটার বয়স তো বললাম বছর দশেক। কিন্তু কেমন ছেলে? ও ছেলে মাকে হারিয়েছে কচিবেলায়। মা-মরা ছেলেকে দেখার কেউ ছিল না। বাপের খোঁজখবর সেভাবে পাওয়া যায় না। বাপ ছেলের দেখাশুনা করার জন্যে কোনো ব্যবস্থাও করে যায় নি। তাই কবি বলেন পরের ঘরে মানুষ। আর তার পরেই শৈশব থেকে ছেলেটা কিভাবে মানুষ হচ্ছে তার একটা আভাস দেন, ‘যেমন ভাঙা বেড়ার ধারে আগাছা।’ গোটা কবিতা জুড়ে ওই বছর দশেকের ছেলেটার মনের গহন গভীর তলে ডুব দিয়েছেন সত্তর পেরিয়ে যাওয়া আন্তর্জাতিক স্তরে সম্মানিত এক দার্শনিক শিক্ষাবিদ।
মানুষ জন্মায় পুরুষ ঔরসে, নারীর কোলে। মায়ের মুখে তার প্রথম ভাষাশিক্ষা। বাপ মায়ের হাত ধরে শিশুর প্রথম হাঁটতে শেখা। কিন্তু কবি যার কথা বলতে শুরু করেছেন, সেই ছেলেটা শৈশবেই মাকে হারিয়ে পরের ঘরে মানুষ হচ্ছে নিদারুণ অবহেলায়। মা মরা, বাপের খোঁজ না থাকা বাচ্চার খোঁজ কি সমাজ নেয়? আমাদের সমাজ কি বেঁচে আছে? সক্রিয় আছে? শুভবোধে উদ্দীপ্ত আছে? কবির কলমে সেই উদাসীন সমাজে প্রতিকূল পরিবেশে নিতান্ত অবহেলায় অনাদরে কি করে একটা শিশু বড় হতে থাকে, তার ছবি আঁকা হয়। তার তুলনা চলে ভাঙা বেড়ার ধারে আগাছার সঙ্গে। যে উদ্ভিদের জন্য মালীর যত্ন বরাদ্দ নেই, বেড়াটিও ভাঙা, পোকা মাকড়ের অবিরত আক্রমণ, তার উপর ছাগলের মত পশুর দ্বারা মুড়িয়ে যাবার ভয়, গরুর মাড়িয়ে দেবার ভয়। তবু জীবন এগিয়ে চলে। কোন অসামান্য মৃত্যুঞ্জয়ী স্পর্ধায় বছর দশেকের ছেলেটা সবার প্রতিকূলতা আর অনাদরকে পাশ কাটিয়ে মাথা তুলতে থাকে।
ওই প্রান্তিকজনের মাথা তোলা আর জীবনজয়ের গান শুনতে শিখছিলেন অভিজাত কবি। আগেই প্রথম মহাযুদ্ধের অভিঘাত গিয়েছে পৃথিবীর উপর দিয়ে। সালটা ১৯১৪ থেকে ১৯১৮। ১৯১৭ সালে সোভিয়েত বিপ্লব ঘটে এবং শ্রমজীবী মানুষের শ্রেণীরাষ্ট্র গড়ে ওঠে। এই দিনবদলের প্রবল অভিঘাত পড়ে গোটা পৃথিবী জুড়ে। দেশে দেশে শ্রমিক কৃষকের মুক্তির দাবি জোরদার হতে হতেই পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী চেহারাটা আরো কঠিন হতে থাকে। আর তার ভিতরের অনিরসনীয় দ্বন্দ্বটুকু কিছুতে চাপা থাকে না। ভেতরে ভেতরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি চলতে থাকে। শ্রমিকের মুক্তিকে চিরতরে স্তব্ধ করার লক্ষ্যে ফ্যাসিবাদ মাথা তুলেছে।
বিশ্ব পরিবেশের অনুষঙ্গে সাহিত্যের পরিবেশটাও বদলে গিয়েছে। পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, রাজা রাজড়ার চরিত্রগুলি সাহিত্যের কেন্দ্রবিন্দু থেকে গেল সরে। সেখানে এল রক্তমাংসের মানুষ। ক্রমে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ, প্রান্তিক মানুষ। চির দুর্বল, চির নিষ্পেষিতের কথা বলতে শুরু করে দিলেন কবি সাহিত্যিকেরা।
“পুনশ্চ” কাব্যগ্রন্থের এই ছেলেটা কবিতাটিতেও মা মরা, বাপের খোঁজ না থাকা, পরের ঘরে অবহেলার সাথে আধপেটা খেয়ে তবু মাথা তুলতে চাওয়া একটি সবুজ প্রাণ নজর কেড়ে নেয় কবির। অপূর্ব প্রাণচঞ্চলতা বালকটির। সেই সাথে তীব্র তার জিজ্ঞাসাবোধ। অসামান্য কুতূহলী মনের অধিকারী সে।
মাকে সে হারিয়েছে কচি বেলায়। হারানো মা কে মনে মনে খোঁজে বছর দশেকের বালক। সে শুনেছে মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছে তার মা কে। তাই বুঝি জিজ্ঞাসা মানুষ কী করে মরে! মাকে খোঁজার দুৰ্মর বালসুলভ আকুতিতে সম্ভব অসম্ভব কোনো কোনো কাজ করে বসে। কী করে মানুষ মরে? ওর প্রতি চারপাশের লোকজনের অবহেলা ওকে বোঝায় মা থাকলে এত অবছেদ্দা এত উপেক্ষার মধ্যে কাটাতে হত না তাকে। এই নিরাশ্রয়তার প্রতিকল্পে সে ভেতরে ভেতরে চারপাশের সকলের থেকে আলাদা হয়ে ওঠে। তার বাল সুলভ লীলাচাপল্য সকলের চোখে দুষ্টুমি হিসেবে প্রতিভাত হয়। তাইতে সকলে বিরক্ত বালকের পরে। নিজে মা হারা উপেক্ষিত বলেই বুঝি দুষ্টু বালকের মনের ভিতর অসহায় অবোলা প্রাণীর প্রতি মায়া মমতা অনেকটা। কোলা ব্যাঙ, গুবরে পোকা, কাঠবেড়ালি আর নেড়ি কুকুর তার একান্ত আপনজন। মাষ্টারেরা তাকে পোঁছে না। তারও যে খুব একটা শ্রদ্ধা জাগে মাষ্টারি পেশার প্রতি, তা নয়। দুষ্টুমি করে সে হেলে সাপ ধরে এনে রেখে দেয় মাষ্টারের ডেস্কে। মাষ্টার জানে না হেলে সাপের বিষ নেই। কামড়ালে মারা যাবার ভয় নেই। তা ছাড়া সাপ চোখে ভাল দেখে না। মানুষের প্রতি অসূয়া বিদ্বেষ তার থাকে না। বরং মানুষকে এড়িয়ে চলে সাপেরা। নেহাত ভয় পেয়ে কামড়ে ফেলে। অল্প কয়েকটি ছাড়া বেশিরভাগ সাপ নির্বিষ। বিষধর গুলিও সর্বদা পরিমাণ মতো বিষ ঢালতে পারে না। তাই সাপের বিষে তত নয়, ভয়ে হৃৎকম্প হয়ে মৃত্যু মুখে পড়ে বেশিরভাগ সর্পদষ্ট মানুষ।
কিন্তু এইসব কথা বৈজ্ঞানিক সত্য হলেও সামনে সাপ দেখলে বেভুল হয়ে পড়ে বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ। সাধারণ শিক্ষিত লোকের মতোই পুঁথি মুখস্থ করে নিবৃত্ত থাকে শিক্ষকের দল। জ্ঞানরাজ্যে অবগাহন তাদের কল্পনাতীত ব্যাপার। কাজেই ডেস্কে সাপ দেখে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়োনো সেইসব নেহাত মাষ্টারের পক্ষে খুব স্বাভাবিক। সেই রকম হেলেসাপ নিয়ে মজা দেখে বালক।
বালকটির ভালোবাসার পাত্র হল এক নেড়ি কুকুর। তার দশাও একেবারেই মনিবের মতো। খাওয়া কোনোমতে জোটে বা জোটে না। তাই কুকুরের পক্ষে চুরি না করলে দেহরক্ষা হয় না। সেই গতিকে মার খেয়ে নেড়ি কুকুরটার পা খোঁড়া হয়েছিল। অবোলা বন্ধুর শরীরের উপর আঘাত ছেলেটার বুকে বাজে। যারা কুকুরের পা ভাঙে, তাদের শসা ক্ষেতের বেড়া ভাঙতে ওর বাধে না। এর মধ্যেই পরের ঘরে ভাতের থালায় মুখ দেবার অপরাধে একদিন কুকুর মরল মার খেয়ে। যে নিজে মার খেলে সেভাবে কাঁদতে পারে না, সে বালক অবোলা বন্ধুর মৃত্যুতে দু দিন ডুকরে কেঁদে ঘুরে বেড়ালো।
দীর্ঘ কবিতাটিতে মা মরা বালকের নানা কীর্তিকলাপ লিখে চলেন প্রবীণ কবি। চিরকাল তিনি স্বপ্ন দেখেছেন নতুন স্পর্ধা নিয়ে বাঁচবেন। কবি নিজে ওই বালকের বয়সেই মাতৃহারা। নিজের শিশুসন্তানদেরও মাতৃহারা হতে দেখতে হয়েছে তাঁকে। আর দেখেছেন বাঙালির স্কুলে তথাকথিত মাষ্টারদের হৃদয়হীন ব্যবহার। তাঁর নিজেরও তো ভাল লাগত না স্কুলে যেতে। শ্রেণী কক্ষে শিক্ষক প্রশ্ন করলে, পড়া ধরলে বালক রবি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকতেন। কেননা বালকের মনে মাষ্টারের মুখের অপভাষা আর ক্লাসের পরিবেশ বিরক্তি উৎপাদন করত। বালক রবি লক্ষ্য করতেন পাঠদানের রকমে সকমে শিক্ষকবর্গের আন্তরিকতা ও যোগ্যতার ভয়াবহ অভাব। তাঁদের যেটুকু দক্ষতা তা স্কুলকে জেলখানা বানিয়ে তোলায়।
বাল্যকালের এইসব প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা মনে ছিল বলেই যেন শান্তিনিকেতনে নতুন স্পর্ধা ও নবীন প্রত্যয়ের পাঠদানের ব্যবস্থা করলেন। পরীক্ষা নিরীক্ষায় ভয় পেলেন না। তবু সাধের ও স্বপ্নের শান্তিনিকেতনেও মধ্য মেধার অস্তিত্ব দেখতে পেতেন। কবি বিপ্লবোত্তর রাশিয়া ভ্রমণে গিয়েছেন তীর্থযাত্রীর মন নিয়ে। সেখানে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের তরফে সর্বজনের শিক্ষার বিস্তৃত বহুধা আয়োজন দেখে আন্তরিক তৃপ্তি পেয়েছেন। রাশিয়ার গ্রামে গ্রামে মিউজিয়াম গড়ে তুলে সজীব শিক্ষার প্রসার তাঁকে মুগ্ধ করেছে। গ্রামের কর্ষণজীবী মানুষ তলস্তয়ের ধ্রুপদী নাটক আগ্রহের সঙ্গে দেখছে লক্ষ্য করে কবি আপ্লুত হয়েছিলেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট কর্মীদের কাজ করার যোগ্যতা দক্ষতা আর নিষ্ঠাভরা প্রশিক্ষিত মজবুত মন দেখে নিজের দেশের অকিঞ্চিৎকর বাঙালি যৌবনের শীর্ণতা খর্বতা অবসন্নতা স্মরণ করে দুঃখ করেছেন তিনি। বলেছেন, আমাদের দেশের লোকেরা পুরো একখানা মানুষ নয়। অনেক আগেই প্রশ্ন রেখেছেন বাঙালির যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতার দৈন্যের বিষয়ে। বলেছেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ কর নি।’
বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের বিকাশে তরল আবেগের প্রাধান্য, যুক্তির চাইতে উচ্ছ্বাসের বেশি গুরুত্ব, কাজের চাইতে ভাষণে বেশি আগ্রহ দেখে তিনি লজ্জা পেতেন। জানতেন যে কালের গতিকে ইংরেজ একদিন এই ভারত ছেড়ে চলে যাবে, কিন্তু ভারতবাসী নিজেরা নিজেদের দুর্বল করে রাখবে প্রতিনিয়ত।
শিক্ষাকে সর্বজনীন করার প্রচেষ্টাতে খামতি ছিলই। অনেক আগে ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণের হিন্দু এবং ধনী ও সম্পন্ন মুসলিম সম্প্রদায়ের পুত্র সন্তান ছাড়া কারো পাঠাভ্যাসের সুযোগ প্রায় ছিলই না। ব্রাহ্মণ পরিবারেও মেয়েদের মধ্যে লেখাপড়ার সুযোগ ছিল অত্যন্ত সীমিত। শিক্ষাকে গোষ্ঠীর করতলগত করে রেখে বিপুলসংখ্যক মানুষকে অশিক্ষার অন্ধকারে ঠেলে ফেলে রাখতে লজ্জা পায় নি হিন্দু উচ্চবর্ণের মাতব্বরগণ। মুসলিম সমাজেও সেই দশা। পাঠ্যবস্তুর বিন্যাসেও একই মানসিকতা ছিল।  নিতান্ত অভাব ছিল প্রকৃত পাঠ্য বইয়ের। আর বইটিকে শিশুমনের উপযোগী করে শ্রেণীকক্ষে তুলে ধরার মতো আন্তরিকতা সম্পন্ন শিক্ষকের অভাব তাঁকে পীড়া দিয়েছে বারংবার। শিশুপাঠ্য বইয়ের অভাব ঘোচাতে নোবেলজয়ী প্রবীণ কবি নিজেই কলম ধরে লিখে দিয়েছেন সহজপাঠ। নন্দলাল বসুর মতো শিল্পগুরুকে দিয়ে বহু আয়াসে বহু অপেক্ষায় আঁকিয়েছেন সেই সহজপাঠের পাতায় পাতায় ইলাস্ট্রেশন। লেখার বিষয়ে এনেছেন বৈচিত্র্য। দিয়েছেন ছন্দের দোলা। ছবি দিয়ে তাকে করেছেন মনোহর। খুব চেষ্টা করেছেন বালকের নিজের জগতের কবি হয়ে উঠতে।
সত্তরতম সাধারণতন্ত্র দিবস পার করে আজো শিক্ষার অঙ্গনে সকলকে টেনে আনা যায় নি। বহু শিশু শ্রমিক রয়েছে। দেশের নাগরিক স্বাবলম্বনের পরিবর্তে সরকারি দান খয়রাতিমূলক প্রকল্পের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। নিজের উদ্যোগে দিন বদলানোর কাজে লিপ্ত হওয়া তাদের চিন্তা চেতনায় স্থান পায় নি আজো। আজো বাল্যবিবাহ সহ নানা কুসংস্কার কুপ্রথা অভিশাপ হয়ে গেড়ে বসে আছে সমাজের বুকে। শিক্ষাকে কি করে একেবারে তৃণমূল স্তরে পৌঁছে দিতে উদ্যোগী হতে হবে, সে বার্তা আজও দিতে থাকেন কবি।
ছেলেটা দুষ্টু হাসে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।