সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৫)

একটা কথা বলা ভাল যে, আম আদমি এগুলো জানে। আর যখন আমি আম আদমির কথা বলছি, তখন আমি মহান গ্রিনেল এবং তার সাগরেদ ষড়যন্ত্রকারীদের কথা বলছি না। গ্রিনেল আর ওর সাগরেদরা সব বড়লোক, অভিজাত, দুধে ও মধুতে লালিত ধনিকশ্রেণী। হাজার হাজার সাধারণ মানুষের রক্ত শুষেই গ্রিনেলরা পুষ্ট হয়। এই সমস্ত শোষকগুলোই হয়ত রাষ্ট্রের সামিল, এদেরই তর্জনী শাসনে রাষ্ট্র চলে। রাষ্ট্রের মহান সম্পদ এই গ্রিনেল, আর বনফিল্ড, আর এই ধরনের লোকেরা, আর তাদের ভাড়াটে লোকেরা। ধর্মাবতার, শুনে রাখুন, আমি যখন বলছি সাধারণ লোকের কথা, আমি তখন বলছি অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষের কথা, যারা গতর খাটিয়ে ঘাম ঝরিয়ে তবেই খেতে পায়। যারা এখনো জানে না, ‘সাধারণ লোকের স্বার্থ’ বলতে বলতেই কী সাংঘাতিক বদমাইশি, কী জঘন্য শয়তানিটা গ্রিনেলরা করে চলেছে। এই যে বিচারের নামে বিচারের প্রহসন করে আটজন মানুষকে খুন করবার পরিকল্পনা আঁটা হয়েছে, সেই দুর্ভাগা মানুষগুলির একমাত্র অপরাধ হল, সাহস করে, মাথা উঁচু করে, সত্য উচ্চারণ করার স্পর্ধা দেখানো।
আটটা মানুষের এই হত্যা হয়ত লক্ষ লক্ষ শোষিত মেহনতি মানুষের চোখ খুলে দেবে, অসাড় হয় থাকা বোধের দুয়ারগুলি খুলে দেবে, তাদের জাগ্রত করবে। আপনারা শুনে রাখুন, আমি ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করেছি, আমাদের উপর এই বিচার, বা বলা ভাল, বিচারের প্রহসন সাধারণ মানুষকে চঞ্চল করে তুলেছে। যে শ্রেণীটা দাবি করছে, আমাদের ফাঁসির দড়িতে ঝোলাতেই হবে, আমাদের নিথর লাশ না দেখতে পেলে যাদের শান্তি হচ্ছে না, সেই সমস্ত ভদ্র সজ্জনেরা , সেই সমস্ত ধর্মিষ্ঠ খ্রিস্টানেরা যতরকম ভাবে পারে আমাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা আর বিদ্বেষের ঢেউ তুলছে। তাদের সংবাদপত্র ও প্রচারযন্ত্র অক্লান্তভাবে আমাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে চলেছে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য হল সত্যকে কি করে ঢেকে চেপে রাখা যায়। ভদ্রলোকেরা এই একমাত্র লক্ষ্য নিয়ে জোট বেঁধেছে। আমাদেরকে তারা অ্যানার্কিস্ট বা নৈরাজ্যবাদী হিসেবে লেবেল সেঁটে এমনভাবে দেখাতে চাইছে যেন আমরা কোনো অজানা অচেনা নরমাংসলোলুপ আদিম অধিবাসী, আর এইভাবে আমাদের চিনিয়ে আমাদের সম্পর্কে ভয়ংকর সব গল্প রটাচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষ এবং প্রকৃত সৎ মানুষদের কাছ থেকে যথার্থ সত্যকে আড়াল করতে চেয়েই তথাকথিত ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানেরা এইসব প্রচার করে চলেছেন। অথচ প্রকৃত সত্যটা হল, চৌঠা মে তারিখের সাঁঝবেলায় একটা খুনে গুণ্ডা, পুলিশ অফিসারের উর্দি গায়ে চাপিয়ে, শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের উপরে দুশো জন সশস্ত্র লোককে লেলিয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু কেন এই মস্তান পুলিশ অফিসার বনফিল্ডের নেতৃত্বে হে মার্কেটের শান্তিপূর্ণ শ্রমিক সমাবেশে এভাবে গুলি চালাতে হল? এর পিছনের মতললবটা কি ছিল? একটাই মতলব, মানুষ খুন করো। যতোটা বেশিসংখ্যক পারা যায়, মানুষ খুন করো। আমাদের সাক্ষীদের দুজনের বক্তব্য আমার বেশ মনে পড়ছে। চিকাগো শহরের গরিব মজুরেরা পুঁজির নির্মম শোষণের বিরুদ্ধে গলা তুলতে শুরু করেছিল। যেটা আসল সত্য, সেই কথাটা তারা বলতে শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু যালিকপক্ষ তাদের এই কথা কানে নিতে একেবারেই রাজি ছিল না। মালিকেরা ভেবেছিল, আটঘণ্টা ধরে নাকে দড়ি দিয়ে খাটাবো, আর আটঘণ্টার বদলে দুঘণ্টার মজুরি দেওয়াই যথেষ্ট। তাই মালিকরা শ্রমিকের ন্যায্য মজুরির দাবিকে বেআইনি বলছিল, আর এই দাবির টুঁটি টিপে ধরতে চাইছিল। শ্রমিকের আওয়াজকে স্তব্ধ করতে মালিকশ্রেণী সাংঘাতিক ভয় দেখানোর রাস্তা বেছে নিয়েছিল। আর শ্রমিকনেতাদের খুন করে শ্রমিক আন্দোলনের কোমর ভাঙতে চেয়েছিল।
আমরা যারা শ্রমিক সংগঠনের দাবিকে সুসংগঠিত ভাবে তুলে ধরছিলাম, সংবাদপত্রে কলম ধরছিলাম, পথসভায় বক্তৃতা করছিলাম, তারা অনেকেই জার্মান অভিবাসী। আমাদেরকে মালিকশ্রেণী বিদেশি কুত্তা তকমা দিয়ে এমন শিক্ষা দিতে চেয়েছিল, যাতে আমরা আর কখনোই পুঁজির নির্মম শোষণ আর খ্রিস্টান ধর্মধ্বজী প্রভুদের বিরুদ্ধে কোনো কথা না বলি। বনফিল্ড হে মার্কেট এলাকার পুলিশ অফিসার। ওকে দেখে নরকের যমদূতরাও লজ্জা পাবে। এই বনফিল্ড সিটিজেনস অ্যাসোসিয়েশনের নামে মালিকশ্রেণীর সংগঠনের ষড়যন্ত্রকে রূপ দিতে নেমে পড়েছিল। আমি আপনাদের বলছি, আমি যদি ওই বোমাটা ছুঁড়ে থাকতাম, অথবা ওই রকম ছোঁড়ার নির্দেশ কাউকে দিয়ে থাকতাম, কিংবা, ওই বোমার ব্যাপারে বিন্দুবিসর্গও যদি আমার জানা থাকত, তাহলে আমি তা স্বীকার করতে একবারও দ্বিধা করতাম না। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, বোমার আঘাতে বেশ কয়েকজন মারা গিয়েছে। অনেকেই আহত হয়েছে। কিন্তু তার বিনিময়ে শত শত লোকের প্রাণরক্ষা হয়েছে। যেক্ষেত্রে শত শত মেয়ে তাদের স্বামীকে হারাতো এবং শত শত বাচ্চা অনাথ হয়ে পড়ত, সেই ব্যাপারটা অনেক কমে গেল। বোমা বিস্ফোরণ হয়ে এটা হল, কিন্তু এই ঘটনাকে কায়দা করে চেপে যাওয়া হচ্ছে। আর প্রকৃত ষড়যন্ত্রকারীরা এবং তাদের দালালরা আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছে, আমাদেরকে ষড়যন্ত্রকারী বলে কয়েদ করেছে। মহামান্য ধর্মাবতার, এই কারণেই আপনার ধর্মাধিকরণে আমাদের বিরুদ্ধে প্রাণদণ্ড দেওয়া যায় না, অবশ্য, ধর্মাধিকরণ কথাটার যদি কোনো তাৎপর্য থাকে, তবেই আমি এই দাবি করতে পারি।
কিন্তু রাষ্ট্র কী বলছেন? বলছেন, আরে তোমরা তো ডিনামাইট আর বোমা কেমনভাবে তৈরি করতে হয়, সেই নিয়ে খবরের কাগজের পাতায় প্রবন্ধ লিখেছ। আচ্ছা, এই শহর থেকে বের হয়, এমন একটাও দৈনিক খবরের কাগজ আমাকে দেখান তো, যারা ডিনামাইট আর বোমা নিয়ে কোনো না কোনো আর্টিকেল ছাপায় নি? স্পষ্ট মনে আছে, তেইশ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮৫, তারিখে চিকাগো ট্রিবিউন ডিনামাইট নিয়ে একটা দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। ওরা ওদের কাগজে বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র আর বোমার বিশদ বিবরণ আর ড্রয়িং ছেপেছিল। এই কাগজের কথাটা আমার এত ভালভাবে মনে আছে এই কারণে যে, একদিন রেলসফরে গিয়ে আমি এই কাগজটা কিনেছিলাম আর হাতে যথেষ্ট সময় ছিল বলে, ওই লেখাটা ধরে ধরে পড়েছিলাম। কিন্তু তারপর থেকে ডিনামাইট আর বোমা নিয়ে টাইমস কাগজ বারে বারেই নানা প্রতিবেদন ছেপেছে। আর ডিনামাইট বিষয়ে প্রতিবেদনগুলি আরবেইটার জাইটুং কাগজে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে ছাপা হত। টাইমস কাগজে ওইসব প্রতিবেদনগুলি লিখতেন সেনাবাহিনীর বড়োকর্তারা, জেনারেল মলিনিউ, এবং জেনারেল ফিটজন পোর্টার। ওঁরা লিখতেন যেসব শ্রমিক ধর্মঘট করছে, তাদেরকে ডিনামাইট মেরে উড়িয়ে দেওয়া দরকার। ওইটাই নাকি শ্রমিকদের বাগে আনার কার্যকর উপায়। ধর্মাবতার, আমি কি জানতে পারি, কেন এইসব সংবাদপত্রের সম্পাদকদের এহেন প্রতিবেদন ছাপার জন্য অভিযুক্ত করা হয় নি, এবং কেন তাদেরকে খুনের দায়ে কয়েদ করা হয় নি? এইসব সম্পাদকেরা সাধারণ গরিব মানুষের উপর অত্যাচারের সমর্থনে লিখেছেন বলেই এদের কোনো অপরাধ হয় নি? আমি জানতে চাই, কেন নিউজ সংবাদপত্রের মিস্টার স্টোনকে এই মামলায় একজন অভিযুক্ত বলে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হল না? তাঁর কাছে তো একটা বোমাও পাওয়া গিয়েছিল! তার উপরে মিস্টার স্টোন জানুয়ারি মাসে বোমা বানানোর কায়দা কৌশল সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে একটা দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন। প্রকাশিত এই তথ্যের ভিত্তিতে যে কেউ যৎসামান্য পয়সা খরচ করলেই একটা বোমা বানিয়ে ফেলতে পারত।
এই দি নিউজ কাগজটার প্রচার সংখ্যা আরবেইটার জাইটুং এর অন্তত দশগুণ। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, চৌঠা মে তারিখে হে মার্কেটে যে বোমাটা ছোঁড়া হয়েছিল, সেটা খুব সম্ভব দি নিউজ কাগজে প্রতিবেদন প্রকাশের পরে পরেই তৈরি করা হয়েছিল। অন্ততঃ এমনটা কি ধরে নেওয়া যায় না?
তাই, যতক্ষণ না এইসব কাগজওয়ালাদের খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত করে কয়েদ করা না হচ্ছে, ততক্ষণ আমি বলব নিরপেক্ষ বিচার বলতে যা বোঝায়, এখানে সেটা অন্তত হচ্ছে না। বিচারটা পুঁজির দিকে নতমস্তকে ঝুঁকে আছে, এবং সেই কারণেই আপনারা সুবিচারের নামে এভাবে আমাদের প্রাণদণ্ড দিতে পারেন না। আমাদের প্রতি গ্রিনেলের সওয়ালের মূল কথাটা হল আমরা না কি বিদেশি, আমরা না কি নাগরিকই নই। আমি অন্যদের ব্যাপারে বলতে যাব না, শুধুমাত্র নিজের ব্যাপারেই বলছি, গ্রিনেল যতদিন এই দেশে আছেন, আমিও প্রায় ততদিনই এই দেশের বাসিন্দা। আর নাগরিক হিসেবে আমার রেকর্ডও যথেষ্ট ভাল। তবে গ্রিনেলের ভালত্বের সঙ্গে আমার ভালত্বের তুলনা হোক, এটা আমি চাই না। গ্রিনেল বারে বারে জুরি মহোদয়দের দেশপ্রেমিক বিবেকের কাছে আবেদন জানাচ্ছিলেন। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে আমি ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব জনসনের ভাষা ধার করে বলতে পারি, প্যাট্রিয়টিজম ইজ দি লাস্ট রিসর্ট অফ এ স্কাউন্ড্রেল।
আমার লড়াইটা বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের সপক্ষে। এ জীবনে যারা শুধু দিল, বিনিময়ে পেল না কিছুই, আমার সংগ্রাম তাদের সজাগ করতে। আমি তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক চেতনা যোগাতে চেষ্টা করেছি। সহজ কথায় আমি খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও সচেতনতার আলো জ্বালতে চেয়েছি। আর আমার এই চেষ্টাটাকেই বলা হচ্ছে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, বলা হচ্ছে সমাজবিরোধী কার্যকলাপ। এই যে সমাজ কথাটা বলা হচ্ছে, এটা আসলে রাষ্ট্র কথাটার উপর একটা মোলায়েম প্রলেপ জড়িয়ে দেওয়া। আসলে এই দেশ, সমাজ বা রাষ্ট্র, এইসব কথাগুলি বড়লোকদের শ্রেণীস্বার্থ ছাড়া আর কিছুই নয়। গরিব মানুষ অর্থনীতির অন্ধিসন্ধি জেনে ফেললে তলিয়ে বুঝতে ও স্বাধীনভাবে ভাবতে শিখে গেলে বড়লোকেরা শ্রেণীগতভাবে বিপন্ন বোধ করে। তাই শাসকশ্রেণী সর্বদা চায়, সাধারণ মানুষ অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবে থাক। সাধারণ মানুষ যে বিনয়ী, এটাকে বড়লোকেরা দুর্বলতা বলেই জানে। গরিব লোকের ঘরে শিক্ষার আলো, চেতনার আগুন পৌঁছে গেলে তাদের দাসত্ববোধ, এবং ভক্তিপ্রবণতা হারিয়ে যাবে। আজ থেকে মাত্র পঁচিশ বছর আগেও কৃষ্ণাঙ্গ দাসশ্রমিকের ঘরে লেখাপড়া শেখা ছিল একটা অপরাধমূলক কাজ। কিন্তু কেন? কেননা, শিক্ষিত বুদ্ধিদীপ্ত শ্রমিক যে কোনো মূল্যে তার দাসত্বশৃঙ্খল ছুঁড়ে ফেলে দেবে। কেন বলুন তো একটি বিশেষ শ্রেণী গরিব মানুষের শিক্ষাপ্রচেষ্টাকে রাষ্ট্রদ্রোহের সামিল করে দেখে? শ্রমিকরা শিক্ষিত হয়ে উঠলে মালিকদের বিপদ ঘনায়। কিন্তু রাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ এই মামলায় খুব সুচতুরভাবে আমাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শাণিয়েছে। শাসকদের তরফে কোর্টে যা বলা হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে যেন আমরা ডিনামাইট ফাটানো আর ধ্বংস করার বিষয়ে বক্তৃতা দেওয়া আর লেখালেখি করা ছাড়া আর কিছু করি নি। আপনাদের এই কোর্ট আজ সকালেই বলে বসলেন, এই হে মার্কেট মামলার মতো কেস দুনিয়ায় না কি আর কোথাও কখনো হয় নি। বিশ্ব ইতিহাসে না কি এমন কোনো কেস এর আগে আসে নি। আমাকে বলতেই হচ্ছে, যেসব ভদ্রলোকেরা আইনজীবী হিসাবে এখানে রয়েছেন, তাঁরা ইতিহাস জিনিসটা ভাল করে পাতা উলটে দেখেননি। এই সমস্ত প্রত্যেকটি কেসে শাসনক্ষমতায় থাকা লোকজনেরা সত্যকে চাপা দিয়েছে। ঘটনাকে যেমনভাবে উপস্থাপনা করলে তাঁদের নিজেদের স্বার্থ টেঁকে, তেমনটি করেই তাঁরা ঘটনাকে পেশ করেছেন।
আমরা আমাদের বক্তৃতায় আর লেখাজোখায় কী বলেছি?
আমরা সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চেয়েছি তাঁরা কোন্ পরিস্থিতিতে আছেন এবং সমাজের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কের বিন্যাসটা ঠিক কেমন। আমরা তাঁদের বিভিন্ন সামাজিক ঘটনাপ্রবাহ, সামাজিক বিধি বিধান আর কানুনী মারপ্যাঁচ এবং তার মধ্যে কীভাবে তারা বঞ্চিত ও নিপীড়িত হচ্ছেন, সেই কথাগুলি বুঝিয়ে বলেছি। আমরা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা নিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁটিয়ে দেখে তাদের সামনে সুনিশ্চিত ভাবে প্রমাণ করে দিয়েছি, যে মজুরি ব্যবস্থার কারণেই আজকের এই সামাজিক বৈষম্য। বঞ্চনা আর অবহেলা এত ব্যাপক আকার নিয়েছে যে, তা যেন আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছে।
আমরা আরো বলেছি যে, এই মজুরি ব্যবস্থা সমাজ বিকাশের একটা বিশেষ অবস্থা হিসেবে যুক্তির খাতিরেই উন্নততর মানবিক চেতনার জন্য জায়গা করে দিতে বাধ্য। বলেছি যে, এই মজুরি ব্যবস্থার এমনভাবে সংশোধন করতে হবে, যা দিয়ে কি না এক উন্নততর সহযোগিতা ও সহভাগিতার সামাজিক পরিবেশের বুনিয়াদি কাঠামো তৈরি হয়ে যায়। এই সহযোগিতা আর সহভাগিতার পরিবেশটাকেই সমাজতন্ত্র বলছি। এই যে আমরা ভবিষ্যৎ ব্যবস্থার লক্ষ্যে এটা ওটা সেটা তত্ত্ব এবং নানাবিধ প্রকল্পের কথা বলছি, এটা কিন্তু এমন নয় যে, পছন্দ করলে কেউ মানবে, বা মানবে না। এটা একটা ঐতিহাসিকভাবে প্রয়োজন হিসেবে দাঁড়িয়েছে। আর আমাদের কাছে এই যে সমাজপ্রগতির চেষ্টা, এটাকেই মনে হচ্ছে নৈরাজ্যবাদ, অর্থাৎ স্বাধীন, সার্বভৌম ব্যক্তিদের মুক্ত সমাজ, যেখানে সকলে অবাধ জীবন এবং অর্থনৈতিক সাম্য একটা স্বাভাবিক পরিবেশ হিসাবে উপভোগ করে। তবে মহান বনফিল্ড আর মহামান্য গ্রিনেল পুলিশের বজ্রমুষ্টিতে সুরক্ষিত শাসনব্যবস্থা ছাড়া ভিন্নতর কোনো ব্যবস্থা কল্পনাতেই আনতে পারেন না। তাঁদের বিজ্ঞ মানসিকতায় পুলিশম্যানদের ক্লাব থাকবে, তাঁদের মুক্ত সমাজ জেলখানা, ফাঁসিকাঠ আর সরকারি উকিল দিয়ে তৈরি। আমরা যে মুক্ত সমাজের কথা বলি, তাতে বনফিল্ড আর গ্রিনেলরা কোনো জায়গা খুঁজে পাবেন না, এবং সেই জন্যই আমাদের নৈরাজ্যবাদ তাঁদের কাছে জঘন্য, ঘৃণ্য, সর্বনাশা আর পরিত্যাজ্য একটা ধারণা। গ্রিনেল এই বিচার চলাকালীন আমাদের জানিয়েছেন, শুধু আমাদের না, গোটা নৈরাজ্যবাদী দর্শনের বিচার চলছে। নৈরাজ্যবাদ একটি সম্ভাবনাপূর্ণ দর্শন। আমরা হে মার্কেটের সমাবেশে নৈরাজ্যবাদ নিয়ে একটি কথাও উচ্চারণ করি নি। ওই সমাবেশের আলোচনার একমাত্র বিষয় ছিল মজুরদের দৈনিক কাজের শ্রমঘণ্টা কমানো। কিন্তু গ্রিনেল সাহেব ফুঁসে উঠে বলছেন, নৈরাজ্যবাদের বিচার চলছে। তাই যদি হয়, হে ধর্মাবতার, আমি বলছি, আমি একজন নৈরাজ্যবাদী। আপনি নিশ্চিন্তে আমার প্রাণদণ্ড মঞ্জুর করুন। আমি বিশ্বাস করি, হ্যাঁ, বাকল, পেইন, জেফারসন, এমারসন, এবং স্পেনসার এবং এই শতাব্দীর আরো অনেক মহান জ্ঞানতাপস চিন্তানায়কদের সঙ্গে আমিও মনে করি জাতপাতে ও শ্রেণীতে বিভাজিত এই রাষ্ট্রব্যবস্থায়, যেখানে একটা শ্রেণী অন্য একটা শ্রেণীকে শোষণ ও শাসন করে, এবং দরিদ্র শ্রেণীর পরিশ্রমের উপর পরজীবীর মতো বেঁচে থাকে, এবং সেই ব্যবস্থাটাকে আখ্যা দেয় নিয়ম বলে। হ্যাঁ ধর্মাবতার, আমি মনে করি এই জাতীয় সামাজিক সংগঠন, যা কিনা বড়লোক শ্রেণীকে লুঠপাট আর খুনের আইনি অধিকার দিয়ে রেখেছে, এ একদিন ধ্বংস হতে বাধ্য। এ সমাজ, এ ব্যবস্থা, ধ্বংস হয়ে এর ধ্বংসাবশেষ থেকে গড়ে উঠবে একটি মুক্ত সমাজ। একটি স্বাধীন, স্বতঃস্ফূর্ত সংগঠন, এবং বিশ্বভ্রাতৃত্ব। হে ধর্মাবতার, আমার এ বিশ্বাস ও মতপোষণের জন্য আপনি আমায় প্রাণদণ্ড দিতে চাইলে দিতেই পারেন। কিন্তু গোটা দুনিয়া জেনে যাবে, ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে ইলিনয় প্রদেশে আটজন মানুষকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, কেননা তারা ভবিষ্যতের গর্ভে এক উন্নততর সমাজ গড়ে উঠবে বলে বিশ্বাস করত। তারা মনে করত, একদিন প্রকৃত মুক্তি আসবে, একদিন সুবিচার আসবে। ব্যাঙ্কার্স আর সিটিজেনস অ্যাসোসিয়েশনের মতো ধনিকশ্রেণীর দালাল গ্রিনেল বলছেন, তুমি সমাজ আর সভ্যতাকে ধ্বংস করার শিক্ষা দিয়েছ। কিন্তু গ্রিনেল লোকটা জানেই না, সভ্যতা জিনিসটা কী! এ সেই মানবপ্রগতির বিরুদ্ধে বস্তাপচা ছেঁদো যুক্তি। গ্রীসের ইতিহাস পড়ুন, পড়ুন রোমের ইতিহাস, ভেনিসের ইতিহাসে চোখ রাখুন, চোখ রাখুন চার্চের অন্ধকার যুগে; আর কিভাবে কণ্টকাকীর্ণ পথে রক্ত ঝরাতে ঝরাতে বৈজ্ঞানিক এষণা মাথা তুলেছে লক্ষ্য করুন। পরিবর্তন নয়, পরিবর্তন চলবে না, তোমার সমাজ এবং সভ্যতাকে গুঁড়িয়ে ছারখার করে দেবে, এইভাবে শাসকশ্রেণী হুঙ্কার ছাড়ত। বিরাজমান ব্যবস্থায় তাদের যে দিব্য আরামে থাকার সুবিধা ছিল তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা যৎসামান্য পরিবর্তনকেও ঘৃণা করত ও ভয় পেত। তারা যে সুবিধাগুলো পেত, তা ছিল তাদের কাছে প্রাণের মতোই দামি; আর প্রত্যেকটি পরিবর্তন ওইসব সুবিধাগুলোর দিকে আঙুল তুলছিল।