ক্যাফে ধারাবাহিকে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৯)

বোর মডেলের সম্মান রক্ষা করতে ফের চেষ্টা করেছিলেন আমেরিকান পদার্থবিদ জন ক্লার্ক স্লেটার ( ২২ ডিসেম্বর ১৯০০ – ২৫ জুলাই ১৯৭৬)। তিনি ১৯২৩ এ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী পারসি উইলিয়ামস ব্রিজম‍্যান ( ২১ এপ্রিল ১৮৮২ – ২০ আগস্ট ১৯৬১) এর নির্দেশনায় পিএইচডি করেন। ব্রিজম‍্যান খুব উচ্চচাপে পদার্থের কী কী বৈশিষ্ট্য ও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, সেই বিষয়ে বিখ্যাত ছিলেন। স্লেটার এর গবেষণার বিষয় ছিল ক্ষারীয় হ‍্যালাইডকে কতদূর চাপ দেওয়া যায়, সেই নিয়ে। তারপর পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ করতে শেষমেশ কোপেনহেগেনে চলে যান।

স্লেটার তাঁর পিএইচডি করা কালীন গবেষণায় সাধারণ লবণ ও লিথিয়াম, সোডিয়াম ও পটাশিয়াম এবং রুবিডিয়ামের মতো ধাতুর সঙ্গে ফ্লোরিন, ক্লোরিন এবং ব্রোমিনের গোটা দশেক ক্ষারীয় যৌগের উপর উচ্চ চাপের ফলে কী পরিবর্তন ঘটে তা অতি যত্ন সহকারে লক্ষ্য করেছিলেন।

এই কাজটা করতে করতে স্লেটার নিলস বোরের চিন্তা ভাবনার গভীরে ডুব দেন। বিশেষ করে সমসময়ে পর্যায় সারণি ও ইলেকট্রনের বিন‍্যাসের মধ‍্যে বোর যে সম্পর্ক লক্ষ্য করছিলেন, স্লেটার তাঁর নিজস্ব গবেষণায় বোরের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সাযুজ্য লক্ষ্য করলেন।

১৯২২ এর গ্রীষ্মকালে স্লেটার কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে প্রবলভাবে উৎসুক জিজ্ঞাসু হয়ে ওঠেন। এই সময়ে হার্ভার্ডে একজন শিক্ষা সম্প্রসারক বিজ্ঞান প্রশিক্ষক ছিলেন এডুইন ক্রফোর্ড কেম্বল (২৮ জানুয়ারি ১৮৮৯ – ১২ মার্চ ১৯৮৪)। কেম্বলও ব্রিজম‍্যানের নির্দেশনায় পিএইচডি করেছিলেন। কেম্বল কোয়ান্টাম বলবিদ‍্যা নিয়েও কাজ করেছিলেন। কেম্বলের কোয়ান্টাম চর্চার সদর্থক প্রভাব স্লেটারের মধ‍্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। কোয়ান্টাম ধারণা আর বোরের ধারণা, দুটোর একটা মেলবন্ধন ও সাযুজ‍্য স্থাপনের কথা ভেবেছিলেন স্লেটার। কোপেনহেগেনে গিয়ে সেই কথাই তিনি নিলস বোরের কাছে পেশ করলেন। সেখানে ছিলেন বোরের একজন ছাত্র , ডাচ বিজ্ঞান গবেষক হেনড্রিক অ্যান্থনি হান্স ক্র‍্যামার্স ( ১৭ ডিসেম্বর ১৮৯৪ – ২৪ এপ্রিল ১৯৫২)। বোরের নির্দেশনায় পিএইচডি করে ক্র‍্যামার্স তখন কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাসোসিয়েট অধ্যাপক হিসেবে কাজ করতেন।

 

শেষমেশ কোয়ান্টাম ধারণার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেল পরমাণুর গঠনের ধারণা। কোয়ান্টাম মানে একটা ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার জন‍্য যতটুকু না হলেই নয়, তেমন যৎসামান্য একটা বাস্তব জিনিস। ন‍্যূনতম একটা বাস্তব অস্তিত্ব। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ফোটো ইলেকট্রিক এফেক্ট বিষয়ক একটি সন্দর্ভে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ফিলিপ লেনার্ড ( ৭ জুন ১৮৬২ – ২০ মে ১৯৪৭) ইলেকট্রন বা বিদ‍্যুৎকণিকা বোঝাতে চেয়ে তার সংক্ষিপ্ত সংস্করণ হিসেবে কোয়ান্টা কথাটা ব‍্যবহার করেছিলেন। লেনার্ড বলেছিলেন, বিদ‍্যুৎসংক্রান্ত আলোচনায় হারমান ভন হেলমহোলৎজ ( ৩১ আগস্ট ১৮২১ – ৮ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪) প্রথম কোয়ান্টা কথাটি ব‍্যবহার করেছিলেন। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী ম‍্যাক্স প্ল‍্যাঙ্ক পদার্থ ও বিদ‍্যুতের সংক্ষিপ্ততম অস্তিত্ব বোঝাতে চেয়ে কোয়ান্টা কথাটি ব‍্যবহার করেন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বললেন, ছোট ছোট আলাদা আলাদা বিচ্ছিন্ন প‍্যাকেটের মতো করে বিকিরণ থাকে। তাকে তিনি বললেন আলোক কোয়ান্টা, তাঁর মাতৃভাষা জার্মানে লিখটকোয়ান্টা। কোন একটা বিকিরণের কোয়ান্টা হল যে বিকিরণের থেকে তা উদ্ভূত তার কম্পাঙ্কের তীব্রতার সমানুপাতিক শক্তির আলাদা আলাদা বিচ্ছিন্ন প‍্যাকেট।

নিলস বোরের পরমাণু মডেলে হাত লাগালেন পঁচিশ বছর বয়সী তাজা তরুণ বিজ্ঞানী উলফগ‍্যাং পাউলি ( ২৫ এপ্রিল ১৯০০ – ১৫ ডিসেম্বর ১৯৫৮)। ১৯২৫ সালে অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানসাধক পাউলি তাঁর এক্সক্লুশন নীতি প্রয়োগ করে বললেন, একটি পরমাণুর মধ‍্যে থাকা ইলেকট্রনগুলির কোয়ান্টাম
নম্বর প্রতিটির জন‍্য আলাদা আলাদা হবে। আগেই নিলস বোর বলেছিলেন, পরমাণুর অভ‍্যন্তরে নিউক্লিয়াস বা কেন্দ্রককে ঘিরে সুনির্দিষ্ট কক্ষপথে ইলেকট্রনগুলি পরিভ্রমণ করছে। এই গোছের মডেলের উন্নতি করতে করতে তিনি ইলেকট্রনের সুনির্দিষ্ট শক্তিস্তর ও চলনের জন‍্য কোয়ান্টাম নম্বর দিয়েছিলেন। বিজ্ঞানী পাউলি নিলস বোরের দেওয়া কোয়ান্টাম নম্বরের উপর আরো দুটি কোয়ান্টাম নম্বর জুড়ে দিলেন। এই যে পাউলির তরফে ইলেকট্রনের সুনির্দিষ্ট শক্তিস্তর ও চলনের ব‍্যাখ‍্যা করতে গিয়ে দুটি কোয়ান্টাম নম্বর জুড়ে দেওয়া, তার প্রেক্ষাপটটি লক্ষ্য করা প্রয়োজন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে যে সমস্ত পরমাণুগুলি জোড়সংখ‍্যার ইলেকট্রনের মালিক, তারা বিজোড়সংখ‍্যক ইলেকট্রনযুক্ত পরমাণুর তুলনায় রসায়নগতভাবে অধিকতর স্থিতিশীল। রসায়নবিদ গবেষকগণ এই ধারণা তুলে ধরছিলেন। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে গিলবার্ট এন লুইস ( ২৫ অক্টোবর ১৮৭৫ – ২৩ মার্চ ১৯৪৬) তাঁর “দি অ্যাটম অ্যাণ্ড দি মলিকিউল” শীর্ষক আর্টিকেলে দেখালেন, যে কোনো শেল এ পরমাণুগুলি জোড়সংখ‍্যক ইলেকট্রন রাখতে চায়, আর বিশেষ করে আটখানা ইলেকট্রন রাখতে চায়। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে রসায়নবিদ আরভিং ল‍্যাংমুইর (৩১ জানুয়ারি ১৮৮১ – ১৬ আগস্ট ১৯৫৭) দেখাতে চাইলেন পরমাণুর ইলেকট্রনগুলি যদি কোনো একটা ছক মেনে জোট পাকিয়ে থাকে, তাহলে পর্যায় সারণিকে ব‍্যাখ‍্যা করতে সুবিধা হয়।

রসায়নবিদদের তরফে তুলে ধরা এই ধরনের কথাগুলি খেয়াল করেছিলেন নিলস বোর। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিজের পরমাণু মডেলের পরিবর্তন করে স্থিতিশীল সীমাবদ্ধ শেল এ নির্দিষ্ট, ২,৮, বা ১৮ সংখ্যক ইলেকট্রন থাকার কথা বলেছিলেন।

এই জিনিসটা কাজের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছিল। কিন্তু পাউলি ওইখান থেকেই বিষয়টিকে চেপে ধরলেন। যা দেখতে পাচ্ছি, তা কেন দেখতে পাচ্ছি, সেই পিছনের যুক্তিটি ধরে নাড়াচাড়া শুরু করলেন উলফগ‍্যাং পাউলি।

তরুণ বিজ্ঞান গবেষক পাউলি ভীষণভাবে খুঁজছিলেন পারমাণবিক বর্ণালিবীক্ষণে জীম‍্যান এফেক্ট কেন হচ্ছে। ইতিমধ্যে আরেকজন কৃতী গবেষক এডমণ্ড ক্লিফটন স্টোনার ( ২ নভেম্বর ১৮৯৯ – ২৭ ডিসেম্বর ১৯৬৮) আবিষ্কার করেছিলেন যে, বাইরের চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের প্রভাবে ক্ষারীয় ধাতুর যে বর্ণালি হয়, তার সঙ্গে নিষ্ক্রিয় গ‍্যাসের সীমাবদ্ধ শেলের ইলেকট্রনের সংখ‍্যার একটা সাযুজ‍্য আছে। ১৯২৪ সালে একটি সন্দর্ভে স্টোনার তা প্রকাশ করলেন। ক্ষারীয় ধাতুর একক একটি ইলেকট্রনের প্রিন্সিপাল কোয়ান্টাম নম্বরের নির্দিষ্ট মানের প্রেক্ষিতে নিষ্ক্রিয় গ‍্যাসের সীমাবদ্ধ শেলের ইলেকট্রনের সংখ‍্যার এই বৈশিষ্ট্য তরুণ গবেষক পাউলির নজর কাড়ল।

স্টোনার এর এই গবেষণাপত্রে প্রকাশিত তথ‍্যের সূত্রে পাউলির মনে হল সীমাবদ্ধ শেলের ইলেকট্রনের সংখ‍্যার জটিলতাকে সহজ করে বুঝতে চারটি কোয়ান্টাম নম্বর দিয়ে ইলেকট্রনের অবস্থাকে দেখানো দরকার। পাউলি বললেন, ওই প্রেক্ষিতে একটি ইলেকট্রন একটাই অবস্থায় থাকবে। এজন্য পাউলি দু দুটি কোয়ান্টাম নম্বরের ধারণা দিলেন। পরে একে ইলেকট্রনের স্পিন বলে চেনানো হল। সে বাবদে কৃতিত্ব ছিল স‍্যামুয়েল আব্রাহাম গৌডস্মিট ( ১১ জানুয়ারি ১৯০২ – ৪ ডিসেম্বর ১৯৭৮) আর জর্জ ইউজিন আহলেনবেক ( ৬ ডিসেম্বর ১৯০০ – ৩১ অক্টোবর ১৯৮৮) এর।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *