দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব -২০১)

পর্ব – ২০১

দূর থেকে একটা মোটরসাইকেল আসছে। ফাঁকা নির্বান্ধব পথ। বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থেকে নেমে রমানাথ দেখতে পেলেন শ‍্যামলীকে। কি ব‍্যাপার, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? বাড়িতে ঢোকো নি কেন?
শ‍্যামলী বলল, উফফ, অত প্রশ্ন করতে হবে না। বলুন, আপনি কেমন আছেন?
রমানাথ বললেন, ভেতরে চলো।
শ‍্যামলী বলল, আমি আপনার কাছে বিদায় নিতে এসেছি।
রমানাথ বললেন, কি হয়েছে তোমার শ‍্যামলী? তোমাকে এত বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে কেন?
হেসে ওঠার চেষ্টা করে শ‍্যামলী। পুরোপুরি পেরে ওঠে না। বলে, শুনুন রমানাথবাবু, ওই বাড়ি ছেড়ে আমি চলে এসেছি। ওখানে গিয়ে আর আমায় দেখতে পাবেন না। বলে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস আর আটকাতে পারে না। অধৈর্য হয়ে বাড়ির কলিংবেল টেপেন রমানাথ।
আসছি বাবা, আসছি। যেন একেবারে ঘোড়ায় জিন দিয়ে এসেছে।
দরজা খুলেই কাজের সহায়িকাটি শ‍্যামলীকে দেখে অবাক হয়ে যায়।
রমানাথকে শ‍্যামলী বলে, আপনি বিশ্রাম নিন। সারাদিন খেটেখুটে ফিরেছেন। আমি চলে যাই।
কাজের সহায়িকা মেয়েটি অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। অনেকটা গড়িয়ে যাওয়া সন্ধ্যায় শ‍্যামলী কোথা থেকে এল, আর দরজা খোলামাত্র কেন‌ই বা সে চলে যেতে চাচ্ছে, সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
একটু রুক্ষস্বরে রমানাথ সেই মেয়েটিকে বলল, তুমি ভিতরে যাও। তারপর গলাটা অনেকখানি নামিয়ে শ‍্যামলীকে বলল, এসো, আমার ঘরে এসো।
শ‍্যামলী ইতস্তত করতে থাকে।
রমানাথ বলেন, আজ কি আবার ওরা তোমাকে মেরেছে? তুমি বলো, শালাকে যদি কান ধরে ওঠবোস করাতে না পেরেছি, আমার নাম রমানাথ‌ই নয়। বড্ড বেশি বেড়ে গেছে।
শ‍্যামলী বলল, ছিঃ, কখনোই মুখ ফসকে হলেও স্ল‍্যাং বলবেন না। আপনাকে মানায় না।
রমানাথ কঠোরভাবে বলেন তুমি ওদের এগেইনস্টে কিছু না করে করে মাথায় তুলে দিয়েছ। ওরা ভদ্র ব‍্যবহারের যোগ‍্য‌ই নয়।
শ‍্যামলী বলল, আজ আমি অ্যাকশন নিয়েছি। চিরতরে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছি। আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। এবার আমি আসি।
রমানাথ বললেন, কি বলছ টা কি তুমি? কি বলছ, বুঝে বলছ? চিরতরে বেরিয়ে এসেছি, একথার মানে কি? কি হয়েছিল বলো?
নিজের ঘরের বন্ধ দরজা খুলে রমানাথের মা বেরিয়ে এলেন। রমানাথের ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে বললেন, খোকন, কি হয়েছে রে? কে এসেছে?
তারপর শ‍্যামলীকে দেখতে পেয়ে বললেন, কি ব‍্যাপার, তুমি এতরাতে এভাবে? বাড়িতে সবাই ভাল আছেন তো?
শ‍্যামলী বলল, হ‍্যাঁ জ‍্যেঠিমা, সবাই ভাল আছেন।
রমানাথ বলল, মা, শ‍্যামলী বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছে। ও আমাদের বাড়িতে থাকবে।
রমানাথের মা বললেন, এ আবার কি কথা, বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বেরিয়ে আসাই বা কেন, আর এবাড়িতে এসে ওঠাই বা কেন?
রমানাথ বলল, সে অনেক কথা মা। অত বলতে গেলে রাত ভোর হয়ে যাবে। শ‍্যামলী এখানে আমার কাছে থাকবে।
কঠোর গলায় তার মা বললেন, না থাকবে না। ও মেয়ে বিচ্ছিরি ঝগড়ুটে মেয়ে। সব জায়গায় অশান্তি করে বেড়ায়। শশাঙ্কবাবু এমন বাঁদর মেয়েকে  তাড়িয়ে দিয়েছেন বেশ করেছেন। তাঁর উচিত ছিল আরো আগে তাড়িয়ে দেওয়া।
শ‍্যামলী টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, বাবা আমাকে তাড়িয়ে দেননি। আমি নিজের খুশিতে বেরিয়ে এসেছি। রমানাথের মা বললেন, এবার তুমি এ বাড়ি থেকে বেরোও। আমার ছেলের অনেক ক্ষতি করেছ। এবার ছাড়ান দাও।
রমানাথ মাকে ধমকে উঠে বলল, কি হচ্ছেটা কি মা? শ‍্যামলী এবাড়িতে থাকবে।
তার মা ততোধিক গলা চড়িয়ে বললেন, না থাকবে না। বিয়ে হয় নি, কিছু হয় নি, থাকব আবদার করলেই হল? মুড়ো ঝ‍্যাঁটা আছে না, মেরে তাড়াবো।
রমানাথ শান্ত স্বরে বলল, মা, ওর কোনো আশ্রয় নেই। বাবা ওকে পছন্দ করে রেখে গেছেন। এ বাড়িতেই ও থাকবে।
নিজের মাথার চুল ধরে টানতে টানতে রমানাথের মা বললেন, তাহলে এখনই আমি বাপের বাড়ি চলে যাব। ও খোকন, গাড়ি বের করতে বল্। এই বাড়িতে হয় ও থাকবে, নয় আমি থাকব। রমানাথ মাকে জাপটে ধরে শান্ত করতে চেয়ে বলে, মা, বাপের বাড়ি যাব বলে এখুনি বায়না ধরলে কি করে হবে? কাল সকালে না হয় তোমাকে সেখানে রেখে আসব। এখন ও বেচারাকে বিশ্রাম নিতে দাও।
চিৎকার চেঁচামেচি শুনে কাজের সহায়িকা, বাগানের মালি, আর দু একজন আশ্রিত দরজার বাইরে এসে জড়ো হয়েছে। রমানাথ তাদের ধমক দিল। মজা দেখতে এসেছ না? যাও, যার যার নিজের কাজে যাও। তারপর মাকে বলল,
মা, তুমি জানো, ওকে আমি ভালবাসি। বিয়ে হ‌ওয়া না হ‌ওয়াটা খুব বড় ব‍্যাপার নয়। আমি বলি নি, যে ও আর আমি এক বিছানায় এখনি শোবো। শুধু ও এখন এখানে থাকবে। ওর সামনে পরীক্ষা মা।
উন্মত্তের মতো কাঁদতে থাকেন রমানাথের মা। বলেন, ওগো, এই পরিণাম দেখতে হবে বলে আমাকে তুমি রেখে গেলে গো! আমার কেন মরণ হয় না গো!
শ‍্যামলী রমানাথের মায়ের কাছে গিয়ে বলল, জ‍্যেঠিমা,  আমার সঙ্গে বাবা বা মায়ের কোনো অশান্তিই হয় নি। বাবা তাঁর নিজের ছেলেদের বাড়ি ঘরদোর কারখানা সব‌ই দান করে দিয়েছেন। আমি তাঁদের কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে। আমাকে যে এতদিন ধরে থাকতে দিয়েছেন, এতেই আমি কৃতজ্ঞ। আমি ভায়েদের গলগ্রহ হয়ে থাকব না বলেই বেরিয়ে এসেছি। এখানেও আমি থাকব না। কেবল বিদায় চাইতে এসেছি।
রমানাথের মা বললেন, তুই কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে?
শ‍্যামলী মৃদু হেসে বলল, হ‍্যাঁ। আমি আজ‌ই সে কথা জানতে পেরেছি।
রমানাথের মা বললেন, কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে মানে জাতজন্মের ঠিক নেই!
রমানাথ বলল, হ‍্যাঁ মা, ও একটা কি বলল না বলল, আর তুমি সেটাকেই সত‍্যি ভেবেছ? কুড়িয়ে পাওয়া বাচ্চা কখনো দেখতে এত সুন্দর হয়? পড়াশুনায় মেডেল পায়?
শ‍্যামলী বড় বড় চোখ করে বলল, হ‍্যাঁ, সত‍্যি সত‍্যি আমি একটা কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে। আমি বানিয়ে বলি নি।
রমানাথ কড়া স্বরে বললেন, বাজে কথা বাদ দাও শ‍্যামলী। তোমার অতীত যাই হোক না কেন, তা নিয়ে আমার কিছুমাত্র মাথাব্যথা নেই। তোমাকে আমি যেভাবে পেয়েছি, সেভাবেই বরণ করে নিতে চাই।
রমানাথের মা বললেন, তার আগে আমায় আশ্রমে রেখে আয় বাবা। তুই আমার একমাত্র সন্তান। তোকে আমি অজাত কুজাতের সঙ্গে থাকতে খেতে দেখতে পারব না।
 রমানাথ বলল, মা, এই বাড়িতে বাবার ওয়ারিশান হিসেবে তুমি একটা মালিক। আমিও একটা। তুমি আমাকে দূর করে দিতে পারো না। তবুও তুমি যদি চাও কাল‌ই আমি শ‍্যামলীকে নিয়ে কোথাও ঘর দেখে উঠে যাব। আজ রাতটুকুর মতো শান্ত হ‌ও মা। কাল সকালেই আমরা দুটিতে দূর হয়ে যাব।
রমানাথের মা শ‍্যামলীর দিকে অতিনাটকীয় ভঙ্গিতে বললেন, ওগো, তুমি এই বিধবার বাছার দিকে দৃষ্টি দিও না। মায়ের কোল থেকে তার বাছাকে কেড়ে নিও না।
শ‍্যামলী রমানাথকে বলল, আমি চললাম। আপনারা ভাল থাকুন। বলে সে একরকম দৌড়ে বেরিয়ে গেল।
রমানাথ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে র‌ইলেন। বিছানায় শ‍্যামলীর চোখ মুছে তুলে নিতে ভুলে যাওয়া রুমালটা দেখিয়ে কাজের সহায়িকাকে বললেন, হাঁ করে দেখছিস কি? ডাইনি মাগি তুক করে রুমালটা রেখে গেছে। ওটা বাগানে নে গে পুড়িয়ে দে গে যা।
অশিক্ষিত মেয়েদুটি শিউরে উঠে থরথর করে কাঁপতে লাগল।
রমানাথ সবার দিকে কঠোর দৃষ্টি হেনে বলল, একখুনি সবাই নিজের নিজের কাজে যাও। বলে রুমালটা অতি সমাদরে পাট করে আলমারিতে তুলে রাখল।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *