রবীন্দ্র কবিতা ক্যামেলিয়া : একটি নিবিড়পাঠ
ক্যামেলিয়া একটি ফুল। দার্জিলিং জেলার পাহাড়ি জায়গায় হয়। এই ফুলের অনুষঙ্গে একটা গল্প বলবেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর ক্যামেলিয়া কবিতায়। ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের শ্রাবণের ২৭ তারিখে লেখা কবিতাটা পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থে স্থান পেয়েছে। এ সেই পুনশ্চ, যেখানে নিজের কাব্যরীতিকে নতুনতর পথে ছুটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। ইংরেজি তারিখে ১৯৩৩ সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি লেখা কবিতাটি। কবিতাটি বুঝতে ১৯৩০ থেকে ১৯৩২ সালের ভারত ইতিহাসের কিছু কথা প্রাসঙ্গিক ভাবে এসে যাবে।
ফুটবল বাঙালির প্রিয় খেলা ও প্যাশন হলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কলমে ফুটবল শব্দটি খুব বেশি চোখে পড়ে না। “সে” গল্পে ফুটবল খেলার উল্লেখ পেয়েছি। আর ফুটবল খেলোয়াড়ের ব্যাপার নিয়ে এই “ক্যামেলিয়া” কবিতা। আমরা ফুটবলের কথায় পরে আসছি। প্রথমে মেয়েটির কথা বলি।
কমলা তার নাম। সে কলেজ ছাত্রী। সহযাত্রিণী হিসেবে মেয়েটি চোখে পড়ে যায় কবিতার কথক আমির। প্রথম দিনে মেয়েটিকে কী রকম দেখেছিলেন কথক? কবিতায় একেবারে গোড়াতেই আছে, “মুখের একপাশের নিটোল রেখাটি দেখা যায়,/ আর ঘাড়ের উপর কোমল চুলগুলি খোঁপার নীচে। / কোলে তার ছিল বই আর খাতা।” মেয়েটির আর কি দেখেছেন কথক? সে কথা কবিতার প্রথম পংক্তিতে। নাম তার কমলা। দেখেছি তার খাতার উপর লেখা। বোঝাই যাচ্ছে সুবেশা সুদেহিনী একটি মেয়েকে দেখে একটি যুবক আপ্লুত হয়ে গিয়েছেন। মেয়েটিকে আগাপাশতলা তিনি নিরীক্ষণ করেছেন। আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন, তার কাছে আর কি কি দেখার মতো আছে। কলেজ ছাত্রী মেয়ের কোলের উপর পাঠাভ্যাসের খাতা। সে খাতার মলাটে কী আছে, তাও নজর করেছেন কথক। মেয়েটির নাম জানা হয়ে গেল খাতার মলাট লক্ষ্য করে।
ট্রামে করে সে মেয়েটি কলেজে যাচ্ছিল। একা নয়। সাথে ভাই ছিল। সেকালে অমন ছিল। মেয়েরা বাড়ির বাইরে বেরোনোর সময় একজন পুরুষ মানুষ না নিয়ে বেরোতেই পেত না। সে পুরুষ পুঁচকে বালক হলেও চলবে। মানে লিঙ্গপরিচয়ে পুংলিঙ্গধারী হলেই হল। অথচ যুগটা বদলাচ্ছিল। নারীমাত্রেই দেবী, এ কথাটা শুনতে ভাল। কিন্তু নারী নরকের দ্বার, এ কথাটাও চালু ছিল। বিদ্যাসাগরের মতো হাতে গোণা দুচারজন মানুষ নারীকে মানুষ বলে ভাবতে শেখাতেন। অথচ বাঙালি শিখতে চায়নি। নারী ছিল ভোগের বস্তু। অথচ যুগটা বদলাচ্ছিল। ট্রামে করে যে ছাত্রী কলেজে চলেছে, তার সাথে আলাপ পরিচয় না করেই তাকে, তার দেহবল্লরী তনুশোভাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে একজন পুরুষ, যাকে মোটের উপর ভদ্রলোক না বলে উপায় নেই।
‘ক্যামেলিয়া’ কবিতাটা জনৈক আমির স্বগতভাষণ। গল্পের মতো করে সে একটা ধারাবিবরণী পেশ করছে। খানিকটা যেন আত্মগ্লানি থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টাও আছে বিবরণীদাতার। কেন আত্মগ্লানি শব্দটি উঠে এল আমার কলমে?
কথক নিজেই বলেছেন, এবং সেটা একেবারে প্রথম স্তবকেই বেরিয়ে এসেছে, যেখানে আমার নামবার সেখানে নামা হল না। কথক যে কলেজছাত্রী মেয়েটিকে দেখে কতদূর উচাটন হয়েছেন, তা স্পষ্ট করেই আমরা জানতে পেরে গেলাম। আর তারপর? রোজ ঘটতে থাকল একই ঘটনা। ‘এখন থেকে সময়ের হিসেব করে বেরোই।’ কি রকম হিসেব? সে হিসেব কথকের কাজের সঙ্গে ঠিকটি মেলে না। প্রায় ঠিক মেলে কমলার বেরোবার সময়ের সঙ্গে… তারপর অবধারিত একটি কথা, প্রায়ই হয় দেখা। বলা দরকার, এটা সম্পূর্ণ একতরফা দেখা। এবং একটা লিবিডো যেন ক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছে।
অথচ কথক জানেন যে তিনি ভদ্রলোক। আর একটা সম্পূর্ণ অপরিচিত অনাত্মীয় ভদ্রঘরের কলেজছাত্রীকে এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করা ভদ্ররুচিবহির্ভূত, এই বোধ কথকের ভিতর নড়েচড়ে বসেছে আর তা কথকের মনকে শাসনও করেছে। তখন কথক নিজের মনের কাছে নিজের লিবিডোর হয়ে নিজেই তার সাফাই যুগিয়েছেন, মনে মনে ভাবি, আর কোনো সম্বন্ধ না থাক,/ ও তো আমার সহযাত্রিণী। রোজ মেয়েটিকে আগাপাশতলা দেখতে থাকেন লোকটি, যিনি একজন ফুটবল খেলোয়াড়। হ্যাঁ, তাঁর নাম আছে ফুটবল খেলায়, নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন বেশ একটু চওড়া গোছের নাম। সেই চওড়া গোছের পরিচয়, আর ফুটবলারের দৈহিক শক্তি নিয়ে কথক লোকটির মানসিক গড়নটি আমরা দেখতে চাইছি।
একটা মেয়েকে একটা মানুষ হিসেবে ভাবলে অনেক সমস্যা কেটে যায়। আর তাকে অতিরিক্ত সম্ভ্রম দেখাতে গেলেই কোথাও একটা টান পড়ে একটা ভারসাম্যের অভাব তৈরি হয়। দুর্বল নৈতিক মানসিক গঠন থাকলে সেখান থেকে গজিয়ে ওঠে নারী লাঞ্ছনার বীজ। সতী সাবিত্রীর দেশ বলেছেন, পথি নারী বিবর্জিতা। এখানে অসূর্যম্পশ্যা মেয়ের শতেক গুণগান করেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। তারপর তাকে দেবী বানিয়ে বলেছে বারো হাত কাপড়ে তার কাছা হয় না। এই বলে মেয়েদের বাইরের জগৎটাকে নিজের চোখে দেখবার অধিকারটাই কেড়ে নিয়েছে সনাতনী ভারত। মেয়েরা বাইরে বেরোলে পুরুষের লোভের শিকার হবে, এ একটা ছেঁদো যুক্তি। প্রকৃতির অপার রহস্যের কারণেই নারীর শরীর এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে পুরুষ সেই দেহের প্রতি আকৃষ্ট হয়। পুরুষ শরীরের প্রতিও নারীর আকর্ষণ অত্যন্ত স্বাভাবিক। এটা জীবধর্ম। মনুষ্যেতর জীব এটা প্রকাশে দ্বিধা করে না। মানুষ চেষ্টা করে এই জৈবিক আগ্রহটাকে সংযত সংবৃত ভাবে পেশ করবার। খোলামেলা করে দিলে সমস্যা এত ঘোরালো হতও না। প্রাচীন ভারতে মন্দিরগাত্রে বিশেষতঃ খাজুরাহো ও কোণার্কে যে নিদর্শন আছে তাতে নারীশরীরকে ঢেকে চেপে রেখে দেখানোর ঐতিহ্য নেই। কামকে ধর্ম অর্থ ও মোক্ষের পাশাপাশি রাখতে প্রাচীন ভারত দ্বিধা করেনি। বিদ্যার দেবী সরস্বতীর স্তুতি করতে গিয়ে তাঁর স্তনসৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে সংকোচ বোধ করেনি প্রাচীন ভারত। আমরা ক্যামেলিয়া কবিতায় এক যুবকের একতরফা গাজোয়ারি ভাবে একটি মেয়েকে পছন্দ করার দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি।
দিনের পর দিন নিজস্ব কাজকে পিছিয়ে দিয়ে কমলার পিছু নিয়ে গিয়েছেন ফুটবলার। গায়ে যথেষ্ট পরিমাণে জোর থাকলে কি হবে, যে সৎ সাহস থাকলে এগিয়ে গিয়ে আলাপ করা যায়, তা কিন্তু ফুটবলারের নেই। অথচ লোভ ষোলোআনার উপর আঠারো আনা। বলা দরকার, এই কবিতাটি লেখার সময়ে যুগ কিন্তু বদলাচ্ছিল।
১৯৩০ সালের বারো মার্চ মহাত্মা গান্ধী (১৮৬৯ – ১৯৪৮) র নেতৃত্বে লবণ আইন অমান্য শুরু হয়। গান্ধীজির বয়স তখন ৬১। তিনি সবরমতী আশ্রম থেকে ৩৯০কিমি দূরে ডাণ্ডি অবধি পদব্রজে গিয়ে ব্রিটিশ সরকারের অসঙ্গত লবণ আইন ভঙ্গ করেন। এই দীর্ঘ পথে তাঁর সহযাত্রী হয়েছিলেন আটাত্তরজন মানুষ, যাঁদের অনেকেই সদ্যযুবা। ৫ এপ্রিল ১৯৩০ সমুদ্রের তীরবর্তী এলাকায় পৌঁছে যান। পরদিন সমুদ্রজল থেকে লবণ তৈরি করে গান্ধী আইন অমান্য করেন।
আটাত্তরজন বিশ থেকে ত্রিশ বছরের যৌবনকে নিয়ে মার্চের বারো তারিখ থেকে এপ্রিলের ছয় তারিখ অবধি ছাব্বিশ দিন লাগাতার হেঁটে তিনশো নব্বই কিলোমিটার দূরে গন্তব্যে পৌঁছনো খুব সোজা ব্যাপার ছিল না। আর ঘরোয়া মেয়েরাও এতে যোগ দিয়েছিলেন। তৈরি হয়েছিল একটা রাজনীতির ভাষা, যা একেবারে নিচের থাকের মানুষের জীবন যাপনের সংকটের সাথে জড়িয়ে গিয়ে একটা অন্যরকম শক্তি সঞ্চয় করে ফেলল। এই যে যুবক যুবতীদের রাজনৈতিক কার্যক্রমে স্পষ্ট একটা জায়গা করে দিতে পারা, এটা গান্ধিজির অসামান্য সংগঠনী প্রতিভার পরিচায়ক।
এ ঘটনা আর এর সুদূরপ্রসারী সম্ভাবনা ব্রিটিশ সরকারের নজর না এড়ানোই স্বাভাবিক ছিল। ওই ১৯৩০ সালের মে মাসের চার তারিখে বেশি রাতে গান্ধিজি গ্রেফতার হলেন। দেশজুড়ে গ্রেফতার হল প্রায় ষাট হাজার মানুষ।
এই ১৯৩০ সালেই শুধুমাত্র ভারতীয় ফুটবলারদের নিয়ে তৈরি দল শুভেচ্ছা সফরে অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, থাইল্যান্ডে যাচ্ছে। এর আগে ১৯২৪ সালে গোষ্ঠ পালের নেতৃত্বে ভারতীয় ফুটবল দল বিশ্বপরিক্রমা করেছে। ব্রিটিশ খেলোয়াড়রাও সে দলে ছিলেন। এর বছর ত্রিশ আগেই ইণ্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বা আইএফএ-র বেঙ্গল শাখা তৈরি হয়েছে। ১৮৯৮তে গড়ে উঠেছে ক্যালকাটা ফুটবল লীগ। ১৯১১ সালে বাঙালির মোহনবাগান ফুটবল দল দুই এক গোলে ইয়র্ক শায়ার রেজিমেণ্ট দলকে হারিয়ে আইএফএ শীল্ড জিতেছে। জাতীয়তাবাদী স্পর্ধা জনজীবনের বহুধাবিস্তৃত ক্ষেত্রে প্রকাশ পাচ্ছে।
গান্ধিজির নেতৃত্বে লবণকে কেন্দ্র করে অহিংস আইন অমান্য আন্দোলন গড়ে ওঠার আগে বিক্ষিপ্তভাবে সহিংস আন্দোলন ছিল। এর মধ্যে ভগৎ সিংহ ছিলেন অন্য ধরণের মানুষ। ১৯২৯ সালের এপ্রিল মাসের আট তারিখে তিনি সহযোগী বটুকেশ্বর দত্তকে নিয়ে নয়াদিল্লির সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলিতে বোমা ছোঁড়েন। কিন্তু সে বোমা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল, যাতে কেউ আহত না হয়। বোমার মারণক্ষমতা বাড়াতে বোমার মধ্যে রাখা হয় ছোট ছোট কঠিন ধারালো বস্তুর টুকরো। একে বলে স্প্লিন্টার। বিস্ফোরণ ঘটলে এই স্প্লিন্টারগুলি তীব্রভাবে মানুষকে আঘাত করে বিপর্যয়ের পরিমাণ বাড়ায়। বলা দরকার, ভগৎ সিংহের ছোঁড়া বোমাটি তৈরি করার সময় বিশেষ করে লক্ষ্য রাখা হয়েছিল, যাতে তার ভিতরে কোনোভাবেই স্প্লিন্টার না থাকে। শুধুমাত্র কানফাটানো শব্দ হয়। ভগৎ সিংহ বলেছিলেন, বধিরকে শোনানোর জন্য উচ্চ শব্দের প্রয়োজন।
সেই রকম বোমা, যাতে একজনও স্প্লিন্টারের ঘায়ে আহত না হন, এত সচেতনভাবে সযত্নে তৈরি বোমা নয়াদিল্লির সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলিতে ফাটানো, বিপ্লবী প্রচারপত্র বিলি আর ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ শ্রমিক সংহতির এই ধ্বনি গর্জন করায় ভগৎ সিংহের গ্রেফতারি ও ২৩ মার্চ, ১৯৩১ তারিখে প্রাণদণ্ড হিসেবে ফাঁসি হয়। ওই একই দিনে ফাঁসি হয়েছিল শুকদেব থাপার নামে আরেকজন বিপ্লবীর। আরও এক বিপ্লবী শিবরাম হরি রাজগুরুরও ওই একই অভিন্ন দিনে ফাঁসি হয়েছিল।
থাপার আর রাজগুরুর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ব্রিটিশ পুলিশকর্তা জে পি সণ্ডার্স হত্যার। সণ্ডার্স ছিলেন লাহোরের অ্যাসিসট্যান্ট পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট। এর অল্পদিন আগে ফেব্রুয়ারির সাতাশ তারিখে মৃত্যু হয়েছিল চন্দ্রশেখর আজাদ নামে বলিষ্ঠ বিপ্লব সংগঠকের। ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা দেবার পরিবর্তে সাংগঠনিক দায়ভারপ্রাপ্ত নেতারা আত্মহত্যাকে শ্রেয় বিবেচনা করতেন।
লালা লাজপত রাই ছিলেন সর্বভারতীয় নেতৃত্ব। “লাল বাল পাল” নামে বিখ্যাত ত্রয়ীর লাল। তিনি ছিলেন আপোসহীন ধারায় শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ গড়ে তুলতে বিশ্বাসী। ভারতে নানাভাবে বিদ্রোহ বিপ্লব ঘনিয়ে উঠছে বলে সুশাসনের অছিলায় ব্রিটিশ শক্তি সাইমন কমিশন গঠন করে ভারতীয়দের পরিস্থিতি বিচার বিবেচনার প্রতিশ্রুতি দেয়। এই সূত্রে একটি কমিশন গঠিত হয়। এই কমিশনের নেতৃত্বে ছিলেন জন সাইমন।
ভারতীয়দের ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য একটি কার্যকরী ও উন্নত সংবিধান গড়ে তোলার বার্তা দিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট একটি কমিটি গঠন করেন। এর শীর্ষপদে বসানো হয়েছিল জন আলসব্রুক সাইমনকে। সাইমন ছিলেন ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ। সিনিয়র ক্যাবিনেট সদস্য। আইনসংক্রান্ত বিষয়ে সাইমনের বিপুল যোগ্যতা ও জ্ঞান ছিল। কিন্তু এত সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার গোড়ায় একটি গলদ রেখে দিয়েছিলেন। সেটি হল, সাইমন কমিশনে একজন ভারতীয়কেও সদস্য হিসেবে গ্রহণ না করা। ভারতের জনগণের উন্নয়ন ঘটানোর কথা বলে তৈরি সংবিধান প্রণয়ন কমিটি তথা সাইমন কমিশনে একজন ভারতীয়কেও স্থান না দেওয়াটা খুব অদ্ভুত মানসিকতার প্রতিফলন ছিল। আপোসহীন ধারার প্রতিবাদী নেতৃত্ব ব্রিটিশ সরকারের এই কমিশনকে খুব স্বাভাবিক কারণেই ভাল মনে নিতে পারেন নি। লালা লাজপত রায় (২৮.০১.১৯৬৫ – ১৭.১১.১৯২৮) ছিলেন এই প্রতিবাদী অংশের প্রথম সারির নেতৃত্ব। তেষট্টি বৎসর বয়সে লালা লাজপত রাই পঞ্জাবের মাটিতে এ নিয়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলেন। লাহোর শহরে জন সাইমনের নেতৃত্বে কমিশন উপস্থিত হলে রাইয়ের নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ জনতা কালো পতাকা দেখিয়ে ক্ষোভ ব্যক্ত করে। কিন্তু সেই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদেও নিষ্ঠুর ভাবে দমন পীড়ন করে ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ। পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট জেমস এ স্কট স্বয়ং উপস্থিত থেকে লাঠি ধরেন ও বর্ষীয়ান নেতা লালা লাজপত রাইকে নির্মমভাবে প্রহার করেন।
তারিখটা ছিল ১৯২৮ সালের ত্রিশ অক্টোবর। তেষট্টি বৎসরের প্রবীণ নেতা পুলিশ সুপারের নির্মম লাঠিচার্জে মারাত্মক আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভরতি হন। কিন্তু এই কঠিন আঘাত তিনি কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। নভেম্বরের সতের তারিখে প্রবীণ নেতার দেহাবসান ঘটে। শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিবাদের ঘটনায় ব্রিটিশ সরকারের এমন মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ব্রিটিশ স্বার্থের গোপন উদ্দেশ্যটি প্রকটিত করে দেয়। সর্বমান্য নেতৃত্ব পঞ্জাব কেশরীর উপর এই আচরণ দেশের যৌবন নতশিরে মেনে নিতে পারে নি। তারা ফুঁসে উঠেছিল। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের এই পাওনা হলে তাহলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের রাস্তা নিতে হয়। পুলিশ কর্তা জেমস এ স্কট, যিনি পঞ্জাব কেশরীর উপর নিজের হাতে নির্মমভাবে লাঠিচার্জ করে তাঁকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়েছিলেন, তাঁকেই টার্গেট করেন হিন্দুস্তান সোশিয়ালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্ব।
শুকদেব থাপার, ভগৎ সিংহ, শিবরাম হরি রাজগুরু সেই সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মী আর চন্দ্রশেখর আজাদ ছিলেন সংগঠনের নেতৃত্ব।
কিন্তু জেমস এ স্কটকে টার্গেট করলেও ভুলক্রমে তুলনায় নিম্নপদস্থ অ্যাসিসট্যান্ট পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট পদমর্যাদার অফিসার জে পি সণ্ডার্সকে গুলি করে হত্যা করেন থাপার ও রাজগুরু। সঙ্গে ছিলেন আজাদ।
ধরা পড়া এড়াতে আজাদ আত্মহত্যা করেন। আর থাপার ও রাজগুরুর ফাঁসি হয়।
সুদূর পঞ্জাবের মাটিতে বিপ্লবী যৌবন যেভাবে আত্মসম্মানের লড়াই লড়ছিলেন, বাংলা ভূমিও কিন্তু তার থেকে পিছিয়ে ছিল না। ১৯৩১ সালে মৃত্যুর সময় পঞ্জাবের ভগৎ সিংহ, থাপার প্রমুখের বয়স তেইশ; আর আজাদের বয়স চব্বিশ। আর ১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ছয় তারিখে বাংলার বীণা দাশ একুশ বৎসর বয়সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশন হল-এ বেঙ্গল গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনের উপর পাঁচ পাঁচটি বার গুলি ছোঁড়েন। অবশ্য পাঁচবারই ব্যর্থ হন। বীণাকে পিস্তল যুগিয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী কমলা দাশগুপ্তা। বিচারে বীণার নয় বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ড হলেও মেয়াদ পূর্ণ হবার আগেই তিনি ছাড়া পান।
ওই ১৯৩২ সালেই দেশের আরেকটি কোণায় চট্টগ্রামে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান হয়। মাস্টারদা’র দলের মহিলা কর্মী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার কলকাতার বেথুন কলেজের ছাত্রী ছিলেন। দর্শন বিষয়ে স্নাতক হয়ে প্রীতিলতা শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হন। কিন্তু অন্যায়ের প্রতিবাদে তিনি এগিয়ে আসেন। চট্টগ্রামের পাহাড়তলি ইউরোপিয়ান ক্লাব ছিল স্থানীয়ভাবে ব্রিটিশ দম্ভ ও আত্মম্ভরিতার প্রতীক। ইউরোপিয়ান ক্লাবের প্রবেশ পথে লেখা ছিল ডগস্ অ্যাণ্ড ইণ্ডিয়ানস নট অ্যালাউড। এটা যে কোনো মর্যাদাবোধসম্পন্ন ভারতীয়কে আঘাত করার কথা। মাস্টার দার দল ইউরোপিয়ান ক্লাবের এই সীমাহীন ঔদ্ধত্যের নগ্ন প্রকাশকে প্রতিহত করতে চেয়েছিলেন।
একুশ বছর বয়সের মেয়ে প্রীতিলতা পঞ্জাবী যুবক সেজে বিপ্লবী দলের নেতৃত্ব দিতে এগোন। ১৯৩২ সালের চব্বিশ সেপ্টেম্বর রাত পৌনে এগারোটায় ক্লাবে ঢোকেন বিপ্লবীরা। ক্লাবে তখন জনা চল্লিশ ইউরোপীয়। তাঁদের দিকে গুলি ছোঁড়েন প্রীতিলতারা। এরপর ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। ধরা পড়ার আগে প্রীতিলতা আত্মহত্যা করেন। সেকালে এভাবে আত্মহত্যার প্রচলন ছিল বিপ্লবী মহলে।
গান্ধিজির উদ্যোগ, আর লালা লাজপত রাই, ভগৎ সিংহ, চন্দ্রশেখর আজাদ, আর প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের আত্মত্যাগের প্রেক্ষিতে ১৯৩৩ সালে লেখা ক্যামেলিয়া কবিতাটি পড়লে বোঝা সহজ হয় দেশের মানুষের ধ্যান ধারণা তখন কিভাবে চলছিল।
কবিতাটির তৃতীয় স্তবকে দেখতে পাবেন, ‘একদিন ছিল ঠেলাঠেলি ভিড়,/ কমলার পাশে বসেছে একজন আধা-ইংরেজ/ ইচ্ছে করছিল, অকারণে, টুপিটা উড়িয়ে দিই তার মাথা থেকে-/ ঘাড়ে ধরে তাকে রাস্তায় দিই নামিয়ে।’
তার পরের পংক্তিটি লক্ষ করলে চমকে উঠতে হয়, ‘কোনো ছুতো পাই নে, হাত নিশপিশ করে’। কিন্তু আধা ইংরেজটিকে খামোখা অসম্মান করার ছুতো খুঁজতে আমাদের ফুটবলার লোকটি ব্যস্ত হয়ে পড়ল কেন?
দ্বিতীয় স্তবকে তার উত্তরটি দেওয়া আছে। কমলাকে দেখে মুগ্ধ শুধুই নয়, লোভাতুর এবং লালায়িত হয়েছেন আমাদের ফুটবলার লোকটি। এখন নিজের কাজের চাইতে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে তিনি কমলার পিছু নিচ্ছেন। কমলার চোখ যে উজ্জ্বল, আর তার দৃষ্টি যে নিঃসঙ্কোচ, এটাও ফুটবলার বুঝে গিয়েছেন। এবার চাইছেন কমলাকে কোনো সংকটে পড়তে হোক, আর সেই সংকট থেকেই কমলাকে উদ্ধার করে তিনি বড়ো রকম ইতিহাস গড়বেন।
পুরুষ মানুষ মেয়েদের শক্তি ও সহ্যক্ষমতা সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত ধারণার খোঁজ টুকু করতে চায় না অনেক সময়। নৈর্ব্যক্তিক নিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক মন নিয়ে খোঁজ নিলে দেখা যাবে, মেয়েদের দুর্বল বলা এক বিকট রকম ভ্রান্তি। প্রকৃতি মেয়ে এবং পুরুষের মধ্যে আকর্ষণ তৈরি করেছে। দুজনকেই দুজনের প্রয়োজন। একজন পুরুষ একটি মেয়েকে বিয়ে করে উদ্ধার করে না। মেয়েজন্মটা একটা বোঝা নয়। অথচ, এই ভ্রান্ত ধারণাগুলি আজো দেশের বুকে চেপে আছে। এইরকম ধারণার বশবর্তী হয়েই আমাদের ফুটবলার ধরেই নিয়েছিলেন যে কমলাকে যখন তার ভাল লেগেছে, তখন কমলা তাঁর, এবং তিনি কমলার পাণিপীড়ন করে তার নারীজন্ম সার্থক করবেন। সেই লক্ষ্যেই নিত্য কমলার পিছু নেওয়াতে তিনি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এমনকি কমলা যেখানে যেখানে পারিবারিকভাবে বেড়াতে যাচ্ছে, ফুটবলার লোকটি যৌনতার টানে সেখানে দৌড়ে যাচ্ছে।
অথচ দেশ বদলাচ্ছিল। এই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বিরুদ্ধে মেয়েরা জাগছিল। কমলার দিক থেকে আমরা একধরণের প্রতিবাদ দেখতে পাব। ঘোলা জলের ডোবা থেকে অনেক উঁচুতে মাথা তুলেছে কমলা।
শেষ পর্যন্ত পুনশ্চের ক্যামেলিয়া একটা উত্তরণের কবিতা। এক গোঁয়ার মানুষের অসঙ্গত আচরণের প্রতি একটি শিক্ষিত মেয়ের সযত্ন উপেক্ষার মাধ্যমে প্রতিবাদ। একটা মেয়ে বদলে দিল একটা গোঁয়ার মানুষকে। তাকে করে দিল সংযত ও মার্জিত সৌন্দর্যপিপাসু।