সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ২৮)

মজুর, মার্ক্স ও মে দিবস

যাঁরা টাকার পিছনে দৌড়োচ্ছেন, বড় ব্যবসায়ীরা, যাঁরা স্টক আর বণ্ডের কারবার করছেন, যাঁরা শেয়ার মার্কেটের ফাটকাবাজ আর যাঁরা মানুষকে খাটিয়ে নিংড়ে নিয়ে পয়সা করছেন, এই সমস্ত লোকগুলো, এরা হচ্ছে পুঁজিপতিশ্রেণী। কিভাবে কত লক্ষ টাকার মালিক হয়ে টাকার গদিতে শুয়ে বসে এই যারা জীবন ধারণ করে, তারা শ্রমিকদের দাবি সম্বন্ধে কণামাত্র ধারণাই রাখে না। শ্রমিক সমস্যা বলতে কি বোঝায়, সেটা তাদের চিন্তাজগতের বাইরে। গোদা বাংলায় বলতে গেলে এই বিষয়টি তাদের পক্ষে মগজে ঢোকানো শক্ত। তাদের এইটুকু যোগ্যতা নেই যে চেষ্টা করেও এটা মগজে ঢোকাবে।
আসলে ওরা এ বিষয়ে কোনো কিছু জানতেই চায় না। শুনতেও চায় না। আর ওদের মতলব হল এই সব প্রশ্নকে যে খুঁটিয়ে তুলবে তাকে পিটিয়ে মার, তাকে গারদে ঢোকাও। এই নিয়ে বিচারের দাবি তুললে তাদের ফাঁসিতে ঝোলাও। তাহলে এটা কি বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে যে দেশে শ্রমিক সমস্যা বলে কিছু একটা জিনিস রয়েছে।
       আমি একজন নৈরাজ্যবাদী; অ্যানার্কিস্ট। তাহলে আমায় মারুন। কিন্তু আমাকে বেঁধে মারার আগে আমার দুটো কথা তো শুনুন। কাকে বলে সমাজতন্ত্র? কাকে বলে নৈরাজ্যবাদ? দুটো কথায় বলতে গেলে সমাজতন্ত্র হল, উৎপাদনের উপকরণের উপর আর উৎপাদিত ফসলের উপর শ্রমিকের অবাধ, সমান অধিকার। এই হল সমাজতন্ত্র। মানুষের ইতিহাসটা হল বেড়ে ওঠার ইতিহাস। একই সঙ্গে এটা ইভলিউশনারি এবং রেভলিউশনারি। কখনো অতি ধীরে ধীরে বদল হয়েছে। আবার কখনো এক ধাক্কায় বিরাট মাপের বদল হয়ে গেছে। ঠিক কখন কোনটা হয়েছে, কোনটা শেষ হলে কোনটা শুরু হয়েছে এবং সীমারেখাটা বোঝা খুব দুষ্কর । হয়ত কখনো বোঝাই যাবে না ইভলিউশন হতে হতে কখন রেভলিউশন এসে যাবে। বোস্টন বন্দরে যখন আমাদের পিতৃপিতামহরা চায়ের পেটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন, তখন কে আন্দাজ করতে পেরেছিল যে ওই ধাক্কাটা সেই বিপ্লবের প্রথম স্ফূলিঙ্গ, যা কিনা তৃতীয় জর্জের কবল থেকে এই মহাদেশকে বিচ্ছিন্ন করে আজকের এই রিপাবলিক তৈরী করে দেবে।
আজ এই রিপাবলিকে আমরা, সেই তাঁদের উত্তরসূরীরা বসবাস করছি। কিন্তু এ দেশটা যে কোনোদিন ইংল্যান্ড থেকে আলাদা হয়ে যেতে পারবে, সেটা পিতৃপিতামহদের সময়ে টের পাওয়া যায় নি। ইভলিউশন আর রেভলিউশন যেন সমার্থক শব্দ । ইভলিউশনের গর্ভে রেভলিউশন জন্ম নেবে। অথবা ইভলিউশন হল রেভলিউশনের ভ্রূণাবস্থা। ও থেকেই রেভলিউশন জন্ম নেবে।  শ্রমজীবী শ্রেণীর দৃষ্টিকোণ থেকে মানবের ইতিহাস কী? একেবারে সূচনার দিকে এই পুরো পৃথিবী তার সমস্ত সম্পদ ছিল সমস্ত মানবের। সে ছিল যৌথ সম্পত্তি। সবার অধিকার ছিল সমান। তারপর এল হিংসা, লুঠতরাজ , ডাকাতি আর লাগাতার খুন, জখম, যার নাম যুদ্ধ। তারপর দেখা দিল দু ধরনের মানুষ। একদল ক্রীতদাস আর একদল হল প্রভু। সময় এগিয়ে চলল তারপর দেখা দিল সার্ফডম বা ভূমিদাস প্রথার মতো শ্রমব্যবস্থা। ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকে পৃথিবীর কোণে কোণে এই সার্ফ শ্রমিক ব্যবস্থা ছিল।
ক্রমশ…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।