১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪০ তারিখে শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি কবিতা লেখেন। কবিতার নাম “শ্রাদ্ধ”। কবিতাটা সঞ্চয়িতায় সংকলিত হয়েছে। শ্রাদ্ধকে বলছি বটে কবিতা, তবে পণ্ডিতেরা কি বলবেন জানি না। ওঁরা ছড়া বলতে পারেন। কেননা, এখানেই আছে “আতাগাছের তোতাপাখি, ডালিমগাছের মউ; হীরেদাদার মড়মড়ে থান, ঠাকুরদাদার বউ।” আরো আছে, ” সাঁতরাগাছির নাচনমণি কাটতে গেল সাঁতার,/ হায় রে কোথায় ভাসিয়ে দিল সোনার সিঁথি মাথার। মোষের শিঙে বসে ফিঙে লেজ দুলিয়ে নাচে – শুধোয় নাচন, সিঁথি আমার নিয়েছে কোন্ মাছে?”
পণ্ডিতবর্গের মত যাই হোক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “শ্রাদ্ধ” রচনাটিতে আমি এমন কয়েকটি পংক্তি দেখতে পাচ্ছি, যা আজ আমাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করছে। বলা ভাল, আমি শিউরে শিউরে উঠছি। আর এই রকম এপ্রিল মাসের চার তারিখে ঘটে যাওয়া এক বিশ্ব অঘটনের সাথে জড়িয়ে আগামী দিনের ভারতের জন্য আশঙ্কিত হয়ে পড়ছি।
১৯২৫ সালে এপ্রিল মাসের চার তারিখে তৈরি হয়েছিলেন জার্মানির কুখ্যাত এস এস বাহিনী। পুরো নাম শুটজ়স্ট্যাফেল, ইংরেজি ভাষায় যার অর্থ দাঁড়ায় প্রোটেকশন স্কোয়াড্রন। হেন জঘন্য ও অমানবিক কাজ নেই যা এই শুটজ়স্ট্যাফেল করে নি। শুটজ়স্ট্যাফেলকে দুনিয়া এস এস নামেই চিনেছে। প্রতিষ্ঠার সময় এস এস এর সদস্যসংখ্যা ছিল মেরেকেটে দুশো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রাদ্ধ কবিতা লেখার সময়ে এর সক্রিয় সদস্য সংখ্যা আট লক্ষ। জঘন্য জার্মান হিটলারের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সঙ্গে এই শুটজ়স্ট্যাফেল এর সমৃদ্ধিশালী হয়ে ওঠা, আর হিটলারের পতনের সমান্তরাল ঘটনা হিসেবে এস এস এর পতন।
অ্যাডলফ হিটলারের একজন জঘন্যতম একনায়ক হয়ে ওঠার আগের ঘটনাগুলো জানা দরকার।
হিটলার জন্মেছিলেন অস্ট্রিয়ায়। এক জার্মান লোকের তিন নম্বর বউয়ের সন্তান অ্যাডলফ হিটলার। সালটা ছিল ১৮৮৯। তারিখটা ছিল এপ্রিল মাসের ২০। হিটলারের মৃত্যুও এপ্রিল মাসে। ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল। জার্মানির বার্লিনে মাটির নিচে এক বাঙ্কারে এই কুখ্যাত একনায়ক নিজের কপালে গুলি করে আত্মহত্যা করেন।
জার্মানিতে হিটলার ক্ষমতায় আসেন নাৎসি পার্টির সূত্রে। জার্মানির রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার অনেক আগেই হিটলার নাৎসি পার্টির ক্ষমতা হাসিল করেছিলেন।
১৯৩৩ এ হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হন এবং ১৯৩৪ সালে নিজেকে ফুয়েরার ও রাইখস্ক্যানজ়লার বা সর্বাধিনায়ক বলে ঘোষণা করেন।
১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ এর এপ্রিল, এই সময়কালে হিটলার জার্মানির সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। এর মধ্যেই ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি পোল্যাণ্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে দেন।
অ্যাডলফ হিটলার একটা অসুখী মেধাহীন শৈশব ও অপরিকল্পিত তারুণ্যের ফল। একে তো অ্যাডলফ তাঁর পিতা অ্যালোইস হিটলার আর তাঁর তিন নম্বর বউ ক্লারা পলজল এর ছয় সন্তানের মধ্যে চতুর্থটি। তার মধ্যে গুটি তিনেক শৈশবেই মারা পড়েছিল। অ্যাডলফ পড়ত ভোল্কস্কুল বা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৮৯৫ সালে অ্যাডলফ যখন বছর ছয়েকের শিশু, তখন অ্যালোইস, তার পিতা কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়ে চাষবাস ও মৌমাছি পালনে লেগে পড়লেন। অবশ্য তিনি ব্যবসায় আদৌ কোনো সুবিধা করতে পারেন নি। আবার স্কুলের শাসন অ্যাডলফ মানতে চাইতেন না। তাই বাবার হাতে নিয়মিত মারধর খেতে হত।
আট বছরের অ্যাডলফ চার্চে গানের দলে গলা মেলাত। আর একটু গানও শিখত। একসময় পুরোহিত হবার কথাও ভেবেছিল। এমন সময় ১৯০০ সালে হামে আক্রান্ত হয়ে অ্যাডলফের ছোটভাই এডমণ্ড মারা পড়লে তাঁর মনে নিদারুণ আঘাত লাগে। অ্যাডলফ ক্রমেই বিষণ্ণ বিরক্ত শৈশবের শিকার হয়ে পড়লেন। বাবার সঙ্গে তাঁর খিটিমিটি ঝামেলা ঝঞ্ঝাট লেগেই থাকত। এমন সময় ১৯০৩ সালে ৩ জানুয়ারি তারিখে তাঁর বাবা হঠাৎ করেই মারা পড়লেন।
স্কুলে অ্যাডলফের রেজাল্ট জঘন্য হল। নতুন করে অন্য একটা স্কুলে ঢুকে ১৯০৫ সালে কোনোমতে কেঁদে ককিয়ে দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় স্কুল থেকে পাশ দিয়ে বেরোলেন। পরবর্তী পড়াশুনার কোনো চেষ্টা বা পরিকল্পনা অ্যাডলফের ছিল না।
১৯০৭ সালের ২১ ডিসেম্বর অ্যাডলফের মা ক্লারা সাতচল্লিশ বছর বয়সে মারা পড়লেন। তখন অ্যাডলফের বয়স সবে আঠারো। পড়াশুনা করেন না। এক আধটু ছবি আঁকেন। সে ছবি বিক্রি করার তালে থাকেন। কখনো সখনো গানের দলে ভিড়ে টুকটাক রোজগার করেন। এইরকম বোহেমিয়ান জীবন। এই সময় থেকে জাতপাত নিয়ে ক্রূর কটু মানসিকতা তৈরি করে ফেলেন অ্যাডলফ। এরপর সেনাবাহিনীর নিচের তলায় পদাতিক সৈনিক হিসেবে ঢুকে পড়লেন।
এই সময়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯১৪ সালের আঠাশে জুন গ্যাভরিলো প্রিনসিপ নামে এক বসনিয়ান সার্ব যুগোশ্লাভ উগ্রপন্থী সারাজেভোতে আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ ও তাঁর স্ত্রী সোফিকে হত্যা করে। আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ ছিলেন অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরির রাজমুকুটের উত্তরাধিকারী। বসনিয়ান সার্ব যুগোশ্লাভ উগ্রপন্থী গ্যাভরিলো প্রিনসিপের ঘটানো এই হত্যাকাণ্ড এক ঘটনার ঘনঘটা গড়ে তোলে। একে সারাজেভো ক্রাইসিস বলা হয়।
আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ ও তাঁর স্ত্রীকে হত্যার বিরুদ্ধে অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরি সার্বিয়ার কাছে জবাব চায়।
সারাজেভো হত্যাকাণ্ডের ঠিক একমাস বাদে ১৯১৪ সালের আঠাশে জুলাই তারিখে অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরি সার্বিয়ার উপর যুদ্ধ ঘোষণা করে। রাশিয়াও এই যুদ্ধে নিজেকে জড়ায় ও ত্রিশে জুলাই তারিখে সৈন্যসমাবেশ করে। আগস্ট মাসে ১ থেকে ৩ তারিখে জার্মানির তরফে সৈন্য সমাবেশ হয়। আগস্টের চার তারিখে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ব্রিটিশ শক্তি। এর পরেই অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এভাবেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। চার বৎসর তিন মাস দুই সপ্তাহ যুদ্ধ চলার পর এগারো নভেম্বর ১৯১৮ তারিখে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। এরও ছয়মাসের বেশি সময় পার করে আঠাশে জুন, ১৯১৯ তারিখে ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ভার্সাই চুক্তিতে ফ্রান্স ও অন্যান্য জয়ীপক্ষ বিজিত পক্ষ (মূলতঃ জার্মানি) এর উপর ভীষণ একতরফাভাবে যুদ্ধ বাধানোর দায় চাপিয়ে ক্ষতিপূরণ আদায়ের সঙ্গে অসম্মানের ব্যবস্থা করে।
ভার্সাই চুক্তি জার্মানিকে বহু অধিকৃত এলাকা ছেড়ে দিতে বাধ্য করে। রাইনল্যাণ্ডকে অসামরিক এলাকা হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য করে। তার উপর বিস্তর অর্থনৈতিক বাধা নিষেধ ও প্রভূত পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করে জার্মানির জনতার মধ্যে উগ্র স্বাজাত্যবোধ খুঁচিয়ে তোলে। বহুসংখ্যক জার্মান নাগরিক এই ভার্সাই চুক্তিকে জার্মান জাতীয়তাবাদের উপর একটা ক্রূর ও কঠোর অপমান বলে বিবেচনা করতেন। বিশেষতঃ ভার্সাই চুক্তির আর্টিকেল ২৩১, যেখানে যুদ্ধ বাধানোর জন্য জার্মানিকে দায়ী করা হয়েছিল, সেটা ছিল তাঁদের চক্ষুশূল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিম্ন পর্যায়ের পদাতিক সৈন্য হিসেবে কাজ করতে গিয়ে হিটলার আহত হন, ও এইসব জেনে ফেলেন। জার্মান রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ যে ভার্সাই চুক্তিকে মেনে নিয়েছিলেন, এই বাস্তব সত্যটা হিটলারের অসুস্থ মনকে পীড়া দিত। ছোটবেলা থেকেই অনাদর অবহেলা আর অযোগ্যতার পরিবেশে থেকে তিনি ভার্সাই চুক্তিতে পিতৃভূমির অসম্মানজনিত ব্যথিত জার্মান অহমিকাকে নিজের রাজনৈতিক উচ্চাশার স্বার্থে ব্যবহার করেছেন।
এগারো নভেম্বর, ১৯১৮তে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। ১৯১৯ সালের জুলাই মাসে হিটলার জার্মান সেনাবাহিনীতে সামান্য একজন গোয়েন্দামাত্র ছিলেন।
তখন অ্যাডলফের বছর ত্রিশ বয়স। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে বিধ্বস্ত অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে জার্মান রাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের আর বেশি সৈন্য পোষার ক্ষমতা নেই। আবার ভার্সাই চুক্তির আওতায় গোটা রাইনল্যাণ্ডকে অসামরিক করে তুলতে হচ্ছে। তাই সেনাকর্মী ছাঁটাই অনিবার্য। আর কে না জানে, এসব ক্ষেত্রে নিচের তলায় আঘাত আসে আগে। তবু অ্যাডলফ ধরে করে যাহোক করে টিঁকে রইলেন সেনাবাহিনীর লেজুড় হয়ে। যাবেন কোথায়? পড়াশুনায় তো লবডঙ্কা। অন্য গুণও নেই।
১৯১৯ সাল গোটা জার্মানির বুকে এনেছে একটা হতাশাজনক পরিস্থিতি। এই সুযোগে মাথা তুলেছে চূড়ান্ত দক্ষিণপন্থা। আর ইহুদি বিদ্বেষ। আর মার্কসবাদ বিরোধিতা। এই ১৯১৯ এর গোড়ায়, জানুয়ারির পাঁচ তারিখে আন্তন ড্রেক্সলার ( ১৩.০৬.১৮৮৪ – ২৪.০২. ১৯৪২) নামে এক একবগগা চূড়ান্ত দক্ষিণপন্থী লোক জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি তৈরি করল। এই সময়ে নিচের তলার গোয়েন্দা অ্যাডলফের উপর তার উপরওয়ালারা নির্দেশ দিল, যে করে হোক এই সংগঠনে ঢুকে পড়ো।
১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বরের বারো তারিখ। জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টির এক মিটিংয়ে পার্টি চেয়ারম্যান আন্তন ড্রেক্সলারের নেকনজরে পড়ে যান অ্যাডলফ। হিটলারের ভাষণ ক্ষমতা ছিল তুখোড়। তথ্য নয়, যুক্তির নিশ্ছিদ্র বুনোট নয়, মন্ময় আলোকমুখীনতা নয়। শুধুমাত্র গাঁজিয়ে তোলা, ফেনিয়ে তোলা। গাজোয়ারি জনমোহিনী বক্তৃতা। হিটলার জানতেন ভার্সাই চুক্তি পরবর্তী উগ্রজাতীয়তাবাদী হাওয়ায় পাবলিক কি চাইছে? আর ক্ষুণ্ন জনমনের সেই ভার্সাই চুক্তিজনিত রোষটাকেই হিটলার বিষিয়ে তুললেন ইহুদিদের বিরুদ্ধে আর মার্কসবাদের বিরুদ্ধে।
হিটলারের তুমুল বক্তৃতা আন্তন ড্রেক্সলারকে পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে বিমোহিত করে। সামরিক বাহিনীর উচ্চ পদাধিকারীদের সম্মতি নিয়ে অধস্তন গোয়েন্দা হিটলার ওয়ার্কার্স পার্টিতে যোগ দেন। তাঁর সদস্যতা নম্বর ছিল ৫৫৫। না, আদৌ তখন ওই পার্টির সদস্য সংখ্যা বেশি ছিল না। লোককে ভাঁওতা দেবার জন্য এই ওয়ার্কার্স পার্টির সদস্যসংখ্যা শুরুই করা হয়েছিল পাঁচশো থেকে।
এবার হিটলার ওয়ার্কার্স পার্টির সভায় সমাবেশে গিয়ে গিয়ে পূর্ণ উদ্যমে উগ্রজাতীয়তাবাদী কথাবার্তা বলতে লাগলেন, আর তাতে মেশালেন কড়া ডোজের ইহুদি বিদ্বেষ। ইহুদি বিদ্বেষী জাতিঘৃণা ছড়ানোর এই কাণ্ডটা তিনি শুরু করলেন ১৯১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে। যত গরম বক্তৃতা তত হাততালি। বক্তব্যের বিষয়বস্তু কি আছে দেখার দরকার নেই, ঝাঁঝ কতটা, আর কতটা নেশা জোগায়, সেই খোঁজে ফেরে এক অংশের উগ্রজাতীয়তাবাদী জার্মান জনতা। ওয়ার্কার্স পার্টিতে থাকতে থাকতেই হিটলার ডায়েট্রিশ একার্টের সঙ্গে পরিচিত হলেন। একার্ট হয়ে উঠলেন হিটলারের মন্ত্রদাতা গুরু। এই সময়েই জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি বা ডিএপি নিজেদের নামের আগে ন্যাশনাল সোশিয়ালিস্ট কথাটা সাঁটিয়ে ফেলল। আর লোকের কাছে পরিচিত হল নাৎসি পার্টি হিসেবে। পার্টির ব্যানার রচনা করলেন হিটলার। লাল কাপড়ে শাদা বৃত্তের মধ্যে স্বস্তিকা চিহ্ন।
সামরিক ওপরওয়ালাদের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে ফেলেছেন অ্যাডলফ। নাৎসি পার্টির কেউকেটা হয়ে গিয়েছেন। ৩১ মার্চ, ১৯২০ তারিখে সেনাবাহিনীর থেকে হিটলারের পুরোপুরি অব্যাহতি মিলল। এবার তিনি পূর্ণ সময়ের পার্টিকর্মী।
হিটলার ভার্সাই চুক্তির বিরোধিতা করে তীব্র জ্বালাময়ী ভাষণ দিতেন। কিন্তু এই সময়ে তাঁর জনপ্রিয়তা ও গুরুত্ববৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নাৎসি পার্টির ভিতরে হিটলার বিরোধী শক্তিও জন্ম নিয়েছিল।
হিটলারের বিরোধী একজিকিউটিভ মেম্বাররা জার্মান সোশিয়ালিস্ট পার্টির সাথে মিশে যেতে চাইলেন। এদের উপর রাগ দেখিয়ে হিটলার পদত্যাগ পত্র পেশ করলেন। খেল শুরু হয়ে গেল।
কমিটি মেম্বাররা ভাবতে পারেন নি যে হিটলার পদত্যাগপত্র পেশ করে বসবেন। পদত্যাগ করে হিটলার যে দলে যোগ দেবেন খ্যাপা জনগণ সেদিকেই ছুটবে। কমিটি মেম্বাররা বেশ বুঝতে পারলেন হিটলার ছাড়া নাৎসি পার্টির অস্তিত্বই সংকটাপন্ন। তাঁরা হিটলারকে ধরে পড়লেন। আপনি পার্টিতে থাকুন। এবার হিটলার শর্ত দিলেন আন্তন ড্রেক্সলারকে সরিয়ে দিয়ে তাঁকে পার্টি চেয়ারম্যানের পদ দিলে তবেই তিনি থাকবেন। পার্টি রাজি হল। প্রতিষ্ঠাতা ড্রেক্সলার পার্টির চেয়ারম্যান পদ থেকে অপসৃত হলেন।
তবুও নাৎসি পার্টির ভিতর হিটলার বিরোধিতা কমে না। এমনকি হিটলারকে বিশ্বাসঘাতক, নিমকহারাম বলে গালি দিয়ে লিফলেট বিতরণ পর্যন্ত হল। এরপর এল সেই অদ্ভুত একটা দিন। ২৯ জুলাই, ১৯২০ তারিখে নাৎসি দলের স্পেশাল পার্টি কংগ্রেসে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত হয়ে হিটলার পার্টি নেতৃত্ব নির্বাচিত হলেন। ড্রেক্সলার বেচারি শুধুমাত্র নিজের ভোটটুকুই পেয়েছিলেন। অন্য ৫৩৩ জনের সকলেই ছিলেন হিটলারের পক্ষে।
নাৎসি পার্টির সর্বময় কর্তৃত্ব পেয়ে যাবার পর অ্যাডলফ হিটলার মিউনিখে সভাস্থলের শান্তি সুস্থিতি নিয়মানুবর্তিতা বজায় রাখার ছলে একটি ছোট স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গঠন করলেন। নাম দিলেন সাল শুটজ। আগে থেকেই নাৎসি দলে একটা ঝটিকাবাহিনী ছিল। এই হল স্টুরমাবটেইলুঙ। স্টর্ম ব্যাটালিয়ন। বা এস এ। এই স্টুরমাবটেইলুঙ সংগঠনটাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতেন না হিটলার। তিনি এর বদলে আটজন লোকের একটা দেহরক্ষী বাহিনী গড়লেন। নাম দিলেন স্ট্যাবস্যাশে বা স্টাফ গার্ড। গোড়ায় এই দেহরক্ষী বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন জুলিয়াস শ্রেইক ও জোসেফ বার্চটোল্ড। ১৯২৩ সালের মে মাসে এই বাহিনীর নতুন নাম হল শক ট্রুপ।
এগারো নভেম্বর, ১৯২৩ তারিখে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে হিটলার অ্যারেস্ট হন। বিচারের পর ১ এপ্রিল হিটলারকে পাঁচ বছর মেয়াদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু গোটা একটা বছর কাটতে না কাটতে হাওয়া ঘুরে যায়। বছরের শেষ দিকে ২০ ডিসেম্বর জেল থেকে মুক্তি পেয়ে যান হিটলার।
এই জেলে বসেই তাঁর পুস্তক রচনা। অনেকে জানেন তাঁর সুবিখ্যাত বইটির নাম মেইন ক্যাম্পফ বা মাই স্ট্রাগল। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে ওটি লেখকের দেওয়া নাম নয়। হিটলার তাঁর বইয়ের নাম রেখেছিলেন মিথ্যা, নির্বুদ্ধিতা আর ভীরুতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের সাড়ে চারটি বছর। প্রকাশক ম্যাক্স আম্মান সেটিকে ব্যবসার খাতিরে বদলে দিয়ে করলেন মেইন ক্যাম্পফ বানিয়ে দিলেন। বই হয়ে বেরোনোর তারিখ ১৯২৫ সালের আঠারো জুলাই। প্রথমে জার্মান ভাষায় বইটি বেরোয়। দ্বিতীয় খণ্ড বেরোয় ১৯২৬ সালে। জার্মান ভাষায় বই প্রকাশের আট বছর পরে, ১৯৩৩ সালে হিটলার যখন রাষ্ট্রক্ষমতায়, তখন ১৩ অক্টোবর তারিখে ইংরেজি ভাষায় এই বইয়ের একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ বের হয়। আরো বছর ছয়েক বাদে ১৯৩৯ সালে এর পূর্ণাঙ্গ ইংরেজি সংস্করণ হয়।
কারান্তরীণ হিটলার মুখে মুখে বলে যেতেন তাঁর সংগ্রামের কথা। সংগ্রাম মানে আর কিছু না, কট্টর ইহুদি বিদ্বেষ আর উগ্রজাতীয়তাবাদী কথাবার্তা। তাই শ্রুতলিখন করতেন ওঁর শ্যোফার এমিল মরিস। পরে হিটলারের ডেপুটি রুডলফ হেস ওই কাজ করেছেন। হিটলার তাঁর বই উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর গুরুতুল্য ডায়েট্রিশ একার্টকে।
মেইন ক্যাম্পফ বইয়ের বিক্রি প্রথম দিকে আহামরি কিছু ছিল না। কিন্তু ১৯৩৩ সালে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর বইটির বিক্রি বেড়ে যায়। ১৯৩৯ এ বইটির সাংঘাতিক বিক্রি।
১৯২৩ সালে নাৎসি পার্টি মিউনিখে ক্ষমতাদখলের উদ্দেশে একটি অভ্যুত্থান ঘটায়। কিন্তু ওই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছিল। ওই সূত্রেই দেশদ্রোহিতার দায়ে হিটলারের কারাদণ্ড হয়েছিল। ১৯২৪ এর ডিসেম্বরের একেবারে শেষে কারাদণ্ড হতে অব্যাহতি পেয়ে হিটলার তাঁর অধস্তন জুলিয়াস শ্রেইককে আবার একটি ব্যক্তিগত দেহরক্ষী বাহিনী গঠন করতে বলেন। এই সংগঠনের নাম দেওয়া হয় শুটজকম্যাণ্ডো বা প্রটেকশন কম্যাণ্ড। নাৎসিদের বিভিন্ন সভা ও অনুষ্ঠানে হিটলারকে ব্যক্তিগত সুরক্ষা দেবার জন্য এর পত্তন। ওর অল্প কিছু দিন পরেই শুটজকম্যাণ্ডো গোটা জার্মানির প্রান্তে প্রত্যন্তে ছড়িয়ে পড়ে। নতুন করে এই সংগঠনের নাম হয় স্টর্মস্ট্যাফেল ও শেষ পর্যন্ত শুটজ়স্ট্যাফেল। ১৯২৫ সালের এপ্রিল মাসের চার তারিখে প্রতিষ্ঠা হলেও শুটজ়স্ট্যাফেল বা এস এস বাহিনী নভেম্বর মাসের নয় তারিখে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের দ্বিতীয় বার্ষিকী উপলক্ষে নিজেদের সংহতি দিবস ঘোষণা করে।
এস এস বাহিনী হিটলারের প্রশ্রয়ে ইহুদিসহ রোমানি ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর উপর প্রবল আক্রমণ নামিয়ে আনে। এস এস বাহিনীর মতাদর্শ ও ইহুদিবিদ্বেষী প্রচার প্রোপাগান্ডা চালানোর জন্য আলজেমাইন এস এস বা একটি সাধারণ শাখা ছিল। আর ছিল একটি সশস্ত্র শাখা বা ওয়াফেন এস এস। কনসেনট্রেশন ক্যাম্প চালাবার জন্য দায়িত্বভারপ্রাপ্ত শাখার নাম ছিল টোটেনকপফভারব্যাণ্ড, আর শত্রু খুঁজে বেড়ানোর শাখার নাম ছিল সিইচারহেইটডিয়েনস্ট বা এসডি বাহিনী। এদের গেস্টাপো নামেও পরিচিত করা হত। হাইনরিশ হিমলার ১৯২৫ সালে শুটজ়স্ট্যাফেল বাহিনীতে যোগদান করেছিলেন। জুলিয়াস শ্রেইক ছিলেন প্রথম এস এস চিফ। ১৯২৬ সালের পনেরো এপ্রিল তারিখে তাঁকে সরিয়ে জোসেফ বার্চটোল্ডকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯২৭ এর পহেলা মার্চ এস এস বাহিনীর নেতৃত্বে আসেন এরহার্ড হাইডেন। এই সব সময়ে শুটজ়স্ট্যাফেল বা এস এস বাহিনী যেন স্টুরমাবটেইলুঙ বা এস এ বাহিনীর একটি শাখা প্রতিষ্ঠান ছিল। ১৯২৭ সালের সেপ্টেম্বরে হাইনরিশ হিমলার এই শুটজ়স্ট্যাফেলের ডেপুটি হিসেবে উন্নীত হন। আর ১৯২৯ এর জানুয়ারিতে এই হিমলার হয়ে গেলেন সমগ্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক বা রাইখসফুয়েরার। হিমলার নেতৃত্বে আসার পরে পরেই শুটজ়স্ট্যাফেল বা এস এস বাহিনী বিপুলভাবে বিকশিত হতে থাকে। ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠার সময় যে শুটজ়স্ট্যাফেল বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল দুশো, এবং ১৯২৮ সালেও যে বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ২৮০ পেরোয় নি, হাইনরিশ হিমলার নেতৃত্বে আসা মাত্র সেই বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় হাজার। আর বছরের শেষে হয় তিন হাজার। ১৯৩০ – ৩৩ পর্বে সদস্য সংখ্যা ছিল বাহান্ন হাজার, ১৯৩৪ – ৩৯ পর্বে সদস্য সংখ্যা ছিল দুলক্ষ চল্লিশ হাজার। আর ১৯৪০ – ৪৪ এই পর্বে সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় আটলক্ষ।
এবারে তাকিয়ে দেখি জার্মানিতে বিভিন্ন নির্বাচনে নাৎসি পার্টি কেমন ভোট পেয়েছিল। ১৯২৪ সালের মে মাসের নির্বাচনে হিটলার কারান্তরীণ। তখন নাৎসি বাহিনী ৬.৫% ভোট পেয়ে বত্রিশটি আসনে জয়লাভ করে। কিন্তু ১৯২৪ সালের ডিসেম্বরে হিটলার জেল থেকে ছাড়া পেলে ভোটের শতাংশ ও বিজিত আসন সংখ্যা দুটোই উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। ভোটের শতাংশ তিন, আর বিজিত আসন সংখ্যা চৌদ্দ।
১৯২৮ এর মে মাসে ভোটের শতাংশ আরো তলিয়ে গিয়ে দাঁড়াল ২.৬% আর বিজিত আসনও হ্রাস পেয়ে হল ১২।
১৯২৯ এ বিশ্বজোড়া আর্থিক মন্দা দেখা দিল। সাংঘাতিক বেকারত্ব, আর ছাঁটাই। বহু বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হয়ে গেলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে জনমোহিনী স্লোগান দিয়ে নাৎসি পার্টি সেপ্টেম্বর ১৯৩০ এর নির্বাচনে নিজেদের ভোটের শতাংশ বাড়িয়ে ১৮.৩% করে নিল। বিজিত আসন বেড়ে দাঁড়াল ১০৭। এরপর ১৯৩২ এর জুলাইতে হিটলার প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ালে উন্মাদনা আরো মাত্রাছাড়া হল। ভোটের শতাংশ হল ৩৭.৩% আর বিজিত আসনের সংখ্যা হল ২৩০। ১৯৩২ এর নভেম্বরের ভোটে শতাংশ কিছু কমে দাঁড়াল ৩৩.১% আর আসন কমে হল ১৯৬। এরপর ১৯৩৩ এ হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হলেন। সেটা জানুয়ারি মাসের ৩০ তারিখ।
এর পরেই পার্টি সংগঠন শুটজ়স্ট্যাফেল বা এস এস হয়ে গেল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান।
ঠিক চার সপ্তাহ পরে রাইখস্ট্যাগে আগুন লাগল। রাইখস্ট্যাগ হল জার্মানির সংসদ বা পার্লামেন্ট ভবন। দোষ চাপল এক ডাচ কমিউনিস্ট ম্যারিনাস ভ্যান ডার লুব এর ঘাড়ে। কায়দা করে ব্যক্তিবিশেষের দোষকে সামগ্রিক ভাবে কমিউনিস্ট নেতাকর্মীদের উপর চাপিয়ে দিল হিটলারের বাহিনী। তারপর শুরু করল অকথ্য নির্যাতন।
শোনা যায়, ডাচ কমিউনিস্ট কর্মী ম্যারিনাস ভ্যান ডার লুব নাকি মানসিকভাবে অসুস্থ ও ভারসাম্যহীনতায় ভুগতেন। আরো শোনা যায়, আগুন লাগানোর পিছনে নাৎসি নেতাদের হাত ছিল।
রাইখস্ট্যাগ অগ্নিকাণ্ড হিটলারের পক্ষে অন্যায় ভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করবার বিরাট সুযোগ হিসেবে দেখা দিল। জার্মান প্রেসিডেন্ট পল ভন হিণ্ডেনবুর্গকে হিটলার চাপ দিয়ে সমস্ত রকম সিভিল লিবার্টি ও নাগরিক অধিকারের কণ্ঠরোধ করলেন। জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির সব নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হল। জার্মান পার্লামেন্টে যে কয়জন কমিউনিস্ট ডেলিগেট ছিলেন সকলকে আটক করে পদত্যাগ করিয়ে তাদের ত্যক্ত আসন নিজেরা দখল করে নিয়ে নাৎসি পার্টি দেশে প্রভূত ক্ষমতাধর হয়ে উঠল।
এরপর ১৯৩৪ সালের ত্রিশ জুন তারিখে হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি বাহিনী আরেক রক্তপিপাসু খেলায় মাতল। শুটজ়স্ট্যাফেল বা এস এস কে যে মূল প্যারামিলিটারি সংগঠনের শাখা হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল, সেই স্টুরমাবটেইলুঙ বা এস এ নামের মূল সংগঠনের ভিতরে হিটলারের কিছু বিরোধী শক্তি ছিল। এই বিরোধিতাকে সমূলে উচ্ছেদ করতে হেরমান গোরিং আর হাইনরিশ হিমলারের আবেদনে গুরুত্ব দিয়ে হিটলার শুরু করলেন পার্জ। পার্জ হল দলের মধ্যে বিরোধী শক্তিকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করা। স্টুরমাবটেইলুঙ বা এস এ র নেতৃত্বে ছিলেন আর্নস্ট রোহম। হিটলারের ভয় ছিল আর্নস্ট রোহম যদি ক্ষমতা দখল করে বসেন।
অথচ আর্নস্ট জুলিয়াস রোহম হিটলারের বন্ধুস্থানীয় ছিলেন। গোড়ার দিকে দুজনে একই সাথে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন। হিটলার রোহমকে স্টুরমাবটেইলুঙ বা এস এ র সর্বোচ্চ নেতৃপদে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৩৩ সালে হিটলার যখন জার্মানির চ্যান্সেলর হলেন, তার কয়েকটি মাস পরে জুন মাসের ২ তারিখে রোহমকে রাইখস্লেইটার পদে অভিষিক্ত করেন। কিন্তু রোহমের সঙ্গে হিটলারের একসময়ের সখ্যতা ও হৃদ্যতাই রোহমের কাল হল। রোহমকে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী বিবেচনা করে আর্থিক দুর্নীতি ও নৈতিক অনাচারের অভিযোগ তুলে ১৯৩৪ সালের ১ জুলাই রোহমকে খুন করা হয়। এর সাথে আরো প্রায় দুশো নাৎসি অফিসার ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের খুন করা হয়। এরই নাম দেওয়া হয়েছিল নাইট অফ দি লঙ নাইভস। বা রোহম পার্জ। বা অপারেশন হামিংবার্ড।
এরপর ১৯৩৪ সালের ২০ জুলাই তারিখে এস এস সংগঠনকে স্টুরমাবটেইলুঙ বা এস এ সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। হিমলারকে মাস তিনেক আগেই হিটলার গেস্টাপো বাহিনীর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তারিখটা ছিল এপ্রিল মাসের ২০ তারিখ। এবার স্টুরমাবটেইলুঙ বা এস এ সংগঠনের আওতা থেকে বেরিয়ে আলাদা অস্তিত্ব পেয়ে হিমলারের ক্ষমতা আরো বেড়ে গেল।
১৯৩৮ সালের সাত নভেম্বর আরেকটি কুৎসিত ঘটনা ঘটে। এক তরুণ ইহুদি তার পিতৃ পরিবারকে জার্মানি হতে বিতাড়িত হতে দেখে প্যারিসের জার্মান দূতাবাসে ঢুকে জনৈক অধস্তন কূটনীতিকের উপর পাঁচ পাঁচটিবার গুলি করে। দিনতিনেক পরে কূটনীতিক ব্যক্তি মারা যান। এই ঘটনাকে ছুতো করে নাৎসি ঝটিকাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে ইহুদিদের উপর নির্মম আক্রমণ নামিয়ে আনে।
১৯৩৩ সালের জানুয়ারিতে হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হবার পর এস এস বাহিনীর বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়। হিমলারের পরিচালনায় ২০৯০০০ কর্মী সমবেতভাবে কাজ করতে থাকে। এই লোকজন হিটলারের নির্দেশে ও হিমলারের পরিচালনায় দু কোটি মানুষকে খুন করে। এদের মধ্যে ষাট লক্ষ মানুষ ইহুদি, দশ লক্ষ মানুষ শ্লাভ, আর দু লক্ষ আটান্ন হাজার মানুষ রোমানি জাতিগোষ্ঠীভুক্ত।
আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রাদ্ধ কবিতা পড়তে পড়তে জার্মানির নাৎসি জঘন্যতার ভিতর ঢুকে পড়েছিলাম। ১৯৪০ সালে লেখা ওই কবিতায় দেখতে পাবেন
ওই শোনা যায় রেডিয়োতে বোঁচা গোঁফের হুমকি –
দেশ বিদেশে শহর গ্রামে গলা কাটার ধুম কি!
…
রেডিয়োতে খবর জানায় বোমায় করলে ফুটো,
সমুদদুরে তলিয়ে গেল মালের জাহাজ দুটো।
….
আকাশ থেকে নামল বোমা, রেডিয়ো তাই জানায়-
অপঘাতে বসুন্ধরা ভরল কানায় কানায়।
…
গ্যাঁ গ্যাঁ করে রেডিয়োটা কে জানে কার জিত,
মেশিন্ গানে গুঁড়িয়ে দিল সভ্য বিধির ভিত…
শ্রাদ্ধ কবিতায় উপরের পংক্তি গুলিতে গলা কাটার ধুম, মালবাহী জাহাজ সমুদ্রে বোমার আঘাতে ডুবে যাওয়া, আকাশ থেকে বোমাবর্ষণ করে নিরীহ মানুষকে হত্যা, এবং মেশিনগান দিয়ে সভ্য নিয়মকানুনকে গুঁড়িয়ে দেওয়া যত্নশীল পাঠকের নজর টানবে। আর বোঁচা গোঁফের হুমকি এটা পড়লে ইতিহাস সচেতন পাঠক সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি করতে পারেন কার কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলতে চেয়েছেন।
হিটলারের ওই যে স্টুরমাবটেইলুঙ বা এস এ সংগঠন, ওরই একটা শাখা ছিল সিইচারহেইটডিয়েনস্ট, বা এসডি, বা আরো সহজ কথায় গেস্টাপো বাহিনী, যার কাজ ছিল শত্রু খুঁজে বেড়ানো। হারমান উইলহেলম গোরিং এই গেস্টাপো বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। পরে, ১৯৩৪ সালের কুড়ি এপ্রিল তারিখে ওই বাহিনীর রাশ তুলে দেন হাইনরিশ লুইটপোল্ড হিমলারের হাতে। ওই যে ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রাদ্ধ কবিতায় বলেন, হিটলারের তরফে ‘দেশ বিদেশে শহর গ্রামে গলাকাটার ধুম কি’, গেস্টাপো বাহিনী ছিল সেইসব শত্রু খুঁজে বেড়ানোর দায়িত্বে। ১৯৩৯ সালের নভেম্বরের ছয় তারিখে পোল্যাণ্ডের ক্রাকাও এলাকায় সোনডার্যাকশন ক্রাকাউ নাম দিয়ে গুণ্ডামি চালায় গেস্টাপো বাহিনী। জাগিয়েলোনিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় ও ওখানে সমবেত অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গবেষক ছাত্রদের ধরে ধরে সাজা দেওয়া হল। ১৮৪ জন স্কলারকে পাঠানো হল কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। সেখানে নির্যাতনের প্রহরে বাঁচলেন না অনেক স্কলার। ওই নভেম্বরেরই সতেরো তারিখে প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে তছনছ করল হিটলারের বাহিনী। চেক জাতিগোষ্ঠীর নয়জন স্নাতক ছাত্রকে নাৎসিরা খুন করল, আর বারোশো’র বেশি ছাত্রকে আটক করে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হল অকথ্য নির্যাতনের উদ্দেশে। আজো ওই নির্মমতার স্মরণে আন্তর্জাতিক ছাত্র দিবস পালিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিটলারের নাৎসি বাহিনীর এইসব কার্যকলাপের বিস্তারিত খবর রাখতেন। এছাড়াও বোমা বা টর্পেডো প্রয়োগে জাহাজ ডোবানো আর আকাশ থেকে বোমা ফেলে জনপদ ধ্বংসের কথা উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। “শ্রাদ্ধ” কবিতা রচনার অল্প কয়েকটি মাস আগে ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৩ তারিখে এস এস অ্যাথেনিয়া ওশান লাইনার জাহাজটি জার্মান বাহিনীর হাতে টর্পেডো আক্রান্ত হয়ে অতলান্তিক মহাসাগরে ডুবে গেল। কয়েকটি দিন পরে, ১৭ সেপ্টেম্বর তারিখে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ এইচ এম এস কারেজিয়াস জার্মান বাহিনীর হাতে টর্পেডোয় ঘায়ল হয়ে ডুবল। অক্টোবর ১৪ তারিখে রয়াল ওক ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ জার্মান ইউ ৪৭ সাবমেরিনের হামলায় ডুবল। ডিসেম্বর মাসের ৪ তারিখে ব্রিটিশ যুদ্ধ জাহাজ এইচ এম এস নেলসন একটি জার্মান ইউ ৩১ সাবমেরিনের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ওই ৪ তারিখেই ব্রিটিশ সাবমেরিন এইচ এম এস স্যামন একটি জার্মান সাবমেরিনকে টর্পেডোর ঘায়ে ডুবিয়ে দেয়। সেই প্রথম ব্রিটিশ বাহিনী জার্মান সাবমেরিনকে ডুবিয়েছিল।
আজ, কুড়ি এপ্রিল, হিটলারের জন্মদিন। হিটলার কিভাবে দানবিক হয়ে উঠেছিলেন, আমরা দেখেছি। তার সাথেই দেখেছি হিটলারের চারপাশের লোকজনকে। আর ভার্সাই চুক্তি।
মহাত্মা গান্ধী ১৯৩৯ সালে যেমন ভারতে ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে ৩ মার্চ তারিখে বোম্বেতে অনশন ধর্মঘটে বসেছিলেন, তেমনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থামাবার লক্ষ্যে ২৩ জুলাই তারিখে হিটলারকে “মাই ফ্রেন্ড” বলে সম্বোধন করে চিঠি লিখেছিলেন। আগস্টের ২ তারিখে হিটলারের তরফে সম্ভাব্য পারমাণবিক যুদ্ধ আটকাতে আইনস্টাইনকে দিয়ে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের কাছে চিঠি লেখানো হয়। যার ফলে ম্যানহাটান প্রোজেক্ট, ও শেষপর্যন্ত হিরোশিমা নাগাসাকির পারমাণবিক বোমাবর্ষণ। তখন আইনস্টাইন খুব মনোকষ্ট পেয়েছিলেন। বলেছিলেন, আমি যদি জানতাম, হিটলার আদৌ পারমাণবিক বোমা বানিয়ে উঠতে পারবে না, তাহলে কিছুতেই ওই চিঠি লিখতাম না।
গোটা বিষয়টার জন্য হিটলার যেমন দায়ী, একই ভাবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলিও দায়ী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রাদ্ধ কবিতায় সেই দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেন।