(হেনরিক ইবসেন এর নোরাকে মনে করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “স্ত্রীর পত্র” নিয়ে আমার অনুভব।)
বিয়ে হয়ে সাতাশ মাখন বড়াল লেনের বাড়িটায় এল সে মেয়ে। কবিতা লিখত। কিন্তু কাউকে জানাবার কোনো তাগিদ অনুভব করত না সে। অথবা, শ্বশুরবাড়ির কাউকে ভরসা করে সে কথা বলা যায় বলেই মনে হয় নি ওর। হিন্দু মধ্যবিত্তের ঘরে বউ মানুষ একটা আসবাবের সামিল। থাকতে হয়, আছে। খেতে হয়, খায়। শুতে হয়, শোয়। তার যে আবার একটা মন আছে, চিন্তার সক্ষমতা আছে, সেটা কর্তৃপক্ষীয়রা ভাবেন না। কিন্তু বুদ্ধি জিনিসটার স্বভাব এই যে, তা নিজেকে জানান দেয়। আর চিরকাল যারা মানুষকে পায়ের নিচে দাবিয়ে রাখতে চেয়েছে, তারা এই বুদ্ধি জিনিসটাকে ভয় পেয়েছে।
বউটার পেটে একটা মেয়ে এসেছিল। তা সে আর বাঁচলো না। কিন্তু মাতৃত্ব তো শরীরে সীমাবদ্ধ নয়, তার প্রকাশ মনোলোকে। বাড়ির ছাইগাদার কাছেও সে একটা গাছ নিয়ে প্রাণের চর্চা করতে পারে। আর মানুষ এসে পড়লে তো মায়ের সত্তা নিজেকে লুকিয়ে রাখতেই পারে না। বিন্দু এসে পড়লো। সম্পর্কে বিন্দু তার বড়ো জায়ের বোন। বিন্দু মানে একেবারে এই একটুখানি। একরত্তি একেবারে। জ্যামিতি শাস্ত্রে বলে বিন্দুর শুধু অবস্থানটুকু আছে। অস্তিত্বের অন্য আর কোনো মাত্রা নেই। দিদির শ্বশুর বাড়িতেও বিন্দুর অবস্থান থাকে এই মাত্র। আর কোনো স্বীকৃতি থাকে না। বউটির স্নেহ গিয়ে পড়ে বিন্দুর দিকে। বিন্দু যার নিজের বোন, সেই জা সংকুচিত হয়ে থাকে। কিন্তু বিন্দুর অধিকার রক্ষার জন্য বউটি লড়ে যায়।
এ লড়াই বউটির দয়া নয়, করুণা নয়। এ তার না মরে জেগে থাকা মনুষ্যত্বের আত্মপ্রকাশ। বুদ্ধি ও বিবেক যার কিছুটাও থাকবে, তা জানান দেবে পদে পদেই। সেই জানান দেবার তাগিদে সে বসন্ত রোগকে ভয় পাবে না। বাজারি মতে দেখতে সুন্দর নয় মেয়েকে পাগলের হাতে গছিয়ে দেবার বিরুদ্ধে বলবে। তার মগজ তাকে ঝিমিয়ে থাকতে দেয় না।
শেষ অবধি মেয়েকে শ্বশুরবাড়ির আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হয়। যে মানুষই স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছে, স্থিতাবস্থার ঘেরাটোপ থেকে তাকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। প্রভুর চরণতলে সে নিজেকে বেঁধে রাখতে পারে নি। এসে দাঁড়িয়েছে জীবনযন্ত্রণার অগাধ নোনাজলের সামনে। হয়ে উঠেছে চরণতলাশ্রয়চ্ছিন্না ।