|| স্মৃতিকথায় এডুইন পাওয়েল হাবল || লিখেছেন মৃদুল শ্রীমানী

এডুইন পাওয়েল হাবল: জন্মদিনে স্মরণলেখা

তাঁর নামাঙ্কিত একটি দুরবিন পৃথিবীকে কেন্দ্র করে মহাকাশে চোখ মেলে আছে। তিনি এডুইন পাওয়েল হাবল। আমেরিকান জ‍্যোতির্বিজ্ঞানী। আজ ২০ নভেম্বর তাঁর জন্মদিন। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৮৯ সালে। ১৯৫৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তারিখে তেষট্টি বৎসর বয়সে প্রয়াত হন।
এডুইন হাবলের সৌজন্যে আমাদের জানা চেনার জগৎটা অনেক বেড়ে গিয়েছে। আগে ধারণা ছিল যে মিল্কিওয়ে গ‍্যালাক্সিই হল একমাত্র বস্তু যার অভ‍্যন্তরে তাবৎ সৃষ্টি রয়েছে। হাবল বললেন যে, না তা নয়, আরো অনেক গ‍্যালাক্সি নিয়ে আমাদের মহাবিশ্ব।
১৯১৯ সালে মহাজাগতিক প্রশ্নে এক অসাধারণ বিপ্লব ঘটে গেল। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ক‍্যালিফরনিয়ার মাউন্ট উইলসন মানমন্দির থেকে আমেরিকান জ‍্যোতির্বিদ এডুইন হাবল ( ২০ নভেম্বর ১৮৮৯ – ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩) একশো ইঞ্চি ব‍্যাসের হুকার টেলিস্কোপ দিয়ে মিল্কিওয়ে গ‍্যালাক্সি বেশ ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে তার সীমা নির্ধারণ করলেন। মিল্কিওয়ে বা ছায়াপথ নীহারিকা নিয়ে কিছু কিছু ধারণা ছিল অনেক আগে থেকেই। মিল্কিওয়ে গ‍্যালাক্সি বা ছায়াপথ নীহারিকা নাকি তারার আলোর আভা। অ্যানাকসোগোরাস এবং ডিমোক্রিটাসকে উল্লেখ করে পণ্ডিত আরিস্ততল ( ৩৮৪ – ৩২২ খ্রীস্ট পূর্বাব্দ) তাঁর “মিটিওরলজিকা” গ্রন্থে এই খবর দিলেন।
আন্দালুসিয়ার জ‍্যোতির্বিদ আভেমপেস ( মৃত্যু ১১৩৮ খ্রীস্টাব্দ) বলতেন ছায়াপথ অনেক তারা দিয়ে তৈরি। তবে পৃথিবীর বাতাসে তাদের আলো প্রতিসরিত হয়ে যায় বলে অমন আভার মতো দেখায়।
টেলিস্কোপ হাতে মিল্কিওয়ে দেখেছিলেন গ‍্যালিলিও। সেটা ১৬১০ সাল। তিনি বলেছিলেন ওগুলো তারা। অনেক দূরে আছে বলে আবছা লাগে। ১৭৫৫ সালে জার্মান দার্শনিক ইম‍্যানুয়েল কান্ট ( ২২ এপ্রিল ১৭২৪ – ১২ ফেব্রুয়ারি ১৮০৪) বললেন ছায়াপথ নীহারিকা হল বিপুল সংখ্যক তারার একটি ঘূর্ণায়মান বস্তু। ওই ১৭৫৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর গবেষণাপত্র বেরিয়েছিল। তার নাম প্রিনসিপিওরাম প্রাইমোরাম কগনিটিওনিস মেটাফিজিকে নোভা ডিলুসিডেটিও। ১৭৭০ সালের আগস্টে কান্টের আরেকটি গবেষণাপত্র বেরিয়েছিল। তার নাম ছিল দে মুন্ডি সেনসিবিলিস আটকে ইনটেলিজিবিলিস ফরমা এট প্রিনসিপিইস। তবে তাঁর সেরা বইটি ছিল ক্রিটিক অফ পিওর রীজন। ১৭৮১/ ১৭৮৭। ১৭৮৫ সালে উইলিয়াম হার্শেল মিল্কিওয়ের চেহারাটা বোঝার চেষ্টা করলেন। আর তাতে কত সংখ‍্যক তারা থাকতে পারে, তাও গণনা করতে চেষ্টা করলেন।
মিল্কিওয়ে গ‍্যালাক্সি যে একটি ঘূর্ণায়মান মহাজাগতিক অস্তিত্ব, এ নিয়ে বিশদ আলোকপাত করেন ডাচ জ‍্যোতির্বিদ জ‍্যাকোবাস করনেলিয়াস ক‍্যাপটেইন ( ১৯ জানুয়ারি ১৮৫১ – ১৮ জুন ১৯২২)। তিনি ডার্ক ম‍্যাটার নিয়ে গবেষণা করেন।
মিল্কিওয়ের ঘূর্ণন বিষয়ে আরো আলোকপাত করেন সুইডিশ জ‍্যোতির্বিদ বারতিল লিন্ডব্লাড ( ২৬ নভেম্বর ১৮৯৫ – ২৫ জুন ১৯৬৫)। তিনি মিল্কিওয়ের ঘূর্ণন নিয়ে যা বলেছিলেন, তা যে যথাযথ, সে ব‍্যাপারে অবগত করেন ডাচ জ‍্যোতির্বিদ জান হেনড্রিক উর্ট ( ২৮ এপ্রিল ১৯০০ – ০৫ নভেম্বর ১৯৯২)। উর্ট রেডিও জ‍্যোতির্বিদ‍্যার অন‍্যতম পথিকৃৎও ছিলেন। ১৯৩২ সালে তিনি ডার্ক ম‍্যাটার নিয়ে আলোকপাত করেন। কিন্তু এডুইন হাবল দেখিয়ে দিলেন মিল্কিওয়ে গ‍্যালাক্সির মধ‍্যেই তাবৎ বিশ্বজগৎ ধরা নেই। তার বাইরে প্রতিবেশী হিসেবে রয়েছে অ্যান্ড্রোমীডা গ‍্যালাক্সি। আরো অনেক অনেক গ‍্যালাক্সি থাকা সম্ভব।

আজ আমরা জানি ল‍্যানিয়াকিয়া সুপার ক্লাসটারের মধ‍্যে রয়েছে ভার্গো সুপার ক্লাসটার। মিল্কিওয়ে রয়েছে এর মধ‍্যে। মিল্কিওয়ে একটি সর্পিল গ‍্যালাক্সি। এর মধ‍্যস্থল থেকে অনেকগুলি প্রলম্বিত অংশ বা হাত বা আর্ম রয়েছে। তাদের নাম নিয়ার থ্রি কেপিসি আর্ম, পারসিয়ুস আর্ম, নরমা আর্ম, আউটার আর্ম, স্কুটাম- সেন্টরাস আর্ম, কারিনা স‍্যাগিটোরিয়াস আর্ম। গোটা দুয়েক তুলনায় ছোট ছোট বাহুর একটি ওরিয়ন সিগনাস আর্ম।
মিল্কিওয়ে গ‍্যালাক্সির গোউল্ড বেল্টের লোকাল বাবল অংশে লোকাল ফ্লাফের মধ‍্যে ওরিয়ন আর্মের প্রান্তসীমায় সূর্যের অবস্থান। সূর্য মিল্কিওয়ের কেন্দ্রীয় মণ্ডল থেকে প্রায় পঁচিশ হাজার আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে। আর মিল্কিওয়ের নিজের ব‍্যাস একলক্ষ আলোকবর্ষ। এই গ‍্যালাক্সির বয়স সাড়ে তের বিলিয়ন বছরের কিছু বেশি। আর এতে তারার সংখ‍্যা ১০০ – ৪০০ বিলিয়ন। অ্যান্ড্রোমীডা গ‍্যালাক্সি মিল্কিওয়ের থেকে কিছুটা বড়। তা আছে পৃথিবী থেকে আড়াই মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরত্বে। অ্যান্ড্রোমীডার ব‍্যাস মিল্কিওয়ের থেকে বেশি। অন্ততঃ একলক্ষ দশহাজার আলোকবর্ষ। আর তার ভরও বেশ খানিকটা বেশি। তার অভ‍্যন্তরে তারার সংখ‍্যা এক ট্রিলিয়ন।

সূর্য মিল্কিওয়ে গ‍্যালাক্সিকে প্রদক্ষিণ করছে। মিল্কিওয়ের চারপাশে সূর্য ঘন্টায় চুরাশি হাজার কিলোমটার গতিবেগে দৌড়ে চলেছে। এই বিপুল বেগে মিল্কিওয়ে গ‍্যালাক্সিকে একবার পাক খেতে সূর্যের সময় লাগে দুশো চল্লিশ মিলিয়ন বছর। সূর্য সৃষ্টির পর থেকে এখনো পর্যন্ত সূর্য এই গ‍্যালাক্সিকে আঠারো থেকে কুড়িবারের বেশি পাক খেতে পারে নি। মিল্কিওয়ে গ‍্যালাক্সিও স্থির নয়। সে প্রতি সেকেণ্ডে ছয়শো ত্রিশ কিলোমিটার গতিবেগে দৌড়ে চলেছে।
এডুইন হাবল অক্সফোর্ডের কুইনস কলেজে পড়াশুনার পর চিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন। তাঁর নামের স্মারক হয়ে রয়েছে হাবল সিকোয়েন্স, হাবলের নিয়ম, হাবল লুমিনোসিটি নিয়ম, হাবল – রেনল্ডস নিয়ম প্রভৃতি।
তবে, সাধারণ মানুষের কাছে যেন হাবল টেলিস্কোপের পরিচিতি অনেক বেশি।
আজ বত্রিশ বৎসর ছয়মাস সাতাশ দিন ধরে সে ৫৪০ কিলোমিটার দূরে থেকে পৃথিবীকে প্রায় পঁচানব্ব‌ই দশমিক বেয়াল্লিশ মিনিটে একবার করে পাক খেয়ে চলেছে। ওই অবস্থাতেই সাতফুট দশ ইঞ্চি ব‍্যাসের দুরবিনটি তেতাল্লিশ বর্গফুটের চোখ দিয়ে দৃশ্য আলো সহ অবলোহিত রশ্মি ও অতিবেগুনি রশ্মির সাহায্যে কতকিছু দেখে চলেছে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।