সেই এক খ্যাপা লোকের কথা তিনি বলেন। খ্যাপা পরশপাথর খুঁজে বেড়ায়। সংসারী লোকে সোনাদানা খোঁজে। খ্যাপা লোকটা যার স্পর্শ পেয়ে লোহা সোনা হয়ে যায়, সেই পরশপাথর খোঁজে। সে ওই পাথর খোঁজে হন্যে হয়ে। পরশপাথর খোঁজা ছাড়া আর তার জীবনের কোনো লক্ষ্য নেই। খ্যাপা লোকটার কাঁধে একটা লোহার শিকল। রাস্তায় চলার পথে খ্যাপা যে পাথরই দেখতে পাক না কেন, তার অভ্যেস দাঁড়াল, সেই কাঁধের শিকলে পাথরটি ঠেকিয়ে পরীক্ষা করা, দেখা কুড়িয়ে তোলা পাথরটির স্পর্শে লোহার শিকল সোনার হয়ে গেল কি না। আর তার কোনো জিজ্ঞাসা নেই, আকুতি নেই, সন্ধিৎসা নেই, পরশপাথর তার চাই, তার জন্যে খ্যাপা জীবনপণ করেছে।
অমন পরশপাথর তো কেউ কখনো দেখে নি, খ্যাপাও দেখে নি, অভ্যাসে, ভূতে পাওয়া মানুষের মতো সে ঝুঁকে পড়ে এক একটি পাথর তোলে, তারপর সে পাথরটি কাঁধের শিকলে ঠং করে ঠেকিয়ে দেখে, তার পর অবধারিত দেখা যায়, হাতেরটি একটি সামান্য পাথর। তখন খ্যাপা সেটি ছুঁড়ে ফেলে। এই যে ঝুঁকে পড়ে পাথর কুড়োনো, তারপর লোহার শিকলে সেটির গুণবত্তা যাচাই করা, তার পর নিরাশ হয়ে সেটি ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া, এই কাজটা দৈনিক ও অনবরত ভাবে করে যাবার কারণে খ্যাপাকে এ নিয়ে আর বিন্দুমাত্র ভাবতেও হয় না। খ্যাপা হাত পা ওয়ালা যন্ত্রের মতো প্রতিনিয়ত এই কাজ করে যেতে থাকে। খ্যাপা এই কাজ করতে করতে জীবনের আর পাঁচটা দিকের প্রতি আকর্ষণ খুইয়ে বসেছে, শরীরের যত্ন নিতে ভুলে গিয়েছে। এক হতশ্রী জীবন্ত লাশের মতো সে ঘুরে বেড়ায়। তার নিজের ভিতরে পরশপাথর পাবার সামান্যতম যে আশাটুকু ছিল, তাও যেন নিভু নিভু। তবু কায়ক্লেশে খ্যাপা এই কাজ করে চলে।
এভাবেই হয়তো খ্যাপার জীবন শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু একদিন গ্রামের ছেলেরা দেখল খ্যাপার শরীরে সোনার শিকল, আর তারা সচকিত হয়ে সোনার শিকলের অস্তিত্ব ব্যাপারে অর্ধোন্মাদ খ্যাপার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
খ্যাপার তখন কী অসম্ভব মনোবেদনা। তাহলে কখনো সে পরশপাথর পেয়েছিল। তার নিরন্তর একমুখী চেষ্টায় কখনো তার মুঠির মধ্যে ধরা দিয়েছিল সেই অমূল্য সম্পদ। অথচ, সে মনের ভুলে, অভ্যাসের ক্লিন্নতায় নিজের হাতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে সেই পরশপাথর।
সোনা নয়, সে যে সমস্ত প্রাণমন দিয়ে খুঁজে ছিল পরশপাথর, আর সে জিনিস ছল করে ধরা দিয়েও কোথায় পালাল!
অবসন্ন শরীর, বিবশ মন নিয়ে তবু খ্যাপা আবার পুরোনো পথে খুঁজতে চলল পরশপাথর।
যে কবি গাইবেন, .. চিরদিন আমি পথের নেশায় পাথেয় করেছি হেলা … আমি যেন দেখি এক ব্যাকুল বাউল পরশপাথর খুঁজতে গিয়ে নিজেই হেমপ্রভ হয়ে গিয়েছেন, অনন্ত রহস্যময় পথে।