কৃষ্ণা যাজ্ঞসেনীর কাপড় ধরে টেনেছিলেন দুঃশাসন। প্রকাশ্য রাজসভায়। দুর্যোধনের তাতে সায় ছিল। এহেন ঘটনায় দেশে ছ্যা ছ্যা পড়ে গিয়েছে। তাতে ধৃতরাষ্ট্র নড়েচড়ে বসে ভাইপোদের হৃতরাজ্য দান করে দিয়েছেন। তবুও ছিছিক্কার থামতে চায় না। তাই পরিস্থিতি সামলাতে দুর্যোধনের স্ত্রী ভানুমতী এসেছেন জায়ের কাছে।
দিদি, তোমাকে ওরা যা করেছে, বিশ্বাস করো, আমি তোমার কাছে মুখ দেখাব কি করে তাই ভাবছি।
দ্রৌপদী, কেঁদে কেঁদে চোখ লাল করে ফেলেছেন। এখন কান্নার জল আর নেই। রাগ রাগ মুখে অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন।
ভানুমতী বললেন, দিদি, আমি কিন্তু স্বামীর হয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে আসি নি।
পাঞ্চালীর পোষা সারিকা সোনার খাঁচার ভিতর থেকে কটকট করে বলে উঠল, তবে এয়েচ কেন বাছা? রঙ্গ দেখতে?
অত দুঃখের মধ্যেও পোষা টিয়ের কথা শুনে হাসি পেয়ে গেল দ্রৌপদীর। টিয়াকে বললেন, তুই চুপ করবি?
সারিকা যাজ্ঞসেনীর বকুনি শুনে ঘাড় গোঁজ করে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল।
ভানুমতী বললেন, দিদি ওঠো, গা ধোও। আমি তোমাকে নতুন শাড়ি গয়না পরিয়ে তবে বাড়ি যাব।
সারিকা ফট করে বলে বসল, তোমাকে আর আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না। নতুন নতুন শাড়ি কেষ্ট ঠাকুর অনেক দিয়েছে। ডাঁই করে রাখা আছে, ওই দ্যাখো।
শাড়ির কথায় মেয়েরা তাকাবে না, এতো হয় না। ভানুমতী উপছে পড়া বড়ো তোরঙ্গের দিকে তাকালেন। বিকর্ণ, দুর্যোধনের একটা ভাই, সে উদ্যোগ করে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছে।
দ্রৌপদীও শাড়ির তোরঙ্গের দিকে তাকালেন। কৃষ্ণ ছিলেন ভাগ্যিস।
ভানুমতীর দিকে একটু কোমল হয়ে তাকালেন তিনি। পরিস্থিতি হালকা করতে সারিকাকে ডালিমের দানা খাওয়াতে খাওয়াতে বললেন, সব আমার কপালে ছিল বোন।
ভানুমতী বললেন, তুমি কিন্তু বট্ ঠাকুরকে আচ্ছা জুতো মেরেছ।
জুতো শব্দটা কট করে কানে লাগল দ্রৌপদীর। তবু শব্দটা হজম করে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন।
ভানুমতী বললেন, ওই যে তুমি বললে না, রাজা তুমি কি নিজেকে আগে বাজি রেখেছ, না কি আগে আমায়! ওটা দুঁদে ব্যারিস্টার ছাড়া কারো মাথাতেই আসত না। তুমি শামলা আঁটলে তোমার পয়সা খায় কে!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্রৌপদী জাকে বললেন, আর বোন, কোনোকিছুই তো কাজে লাগল না। পাঁচ পাঁচটা মহাবল সোয়ামী যার, তার কিনা এত অবছেদ্দা!
ভানুমতী বললেন, তবুও মেঝ ঠাকুর খেপে উঠে বট্ ঠাকুরের হাতটা পুড়িয়ে দিতে যাচ্ছিলেন। সত্যি বলছি দিদি, ওই মানুষটা তোমাকে একটু হলেও ভালবাসেন।
অজ্ঞাতবাসের দিনগুলি মনে পড়ে গেল পাঞ্চালীর। ভীমসেন বিরাট রাজার বাড়িতে পাচকের কাজ করতেন।
ভানুমতী বললেন, ওকে তুমি বল্লভ বলে ডাকতে, তাই না দিদি? রবিঠাকুরের গান আছে জানো, ওহে জীবন বল্লভ, ওহে সাধনদুর্লভ… বল্লভ মানে ডার্লিং। মেঝ ঠাকুর খুব রোমান্টিক না গো দিদি!
দ্রৌপদীর জিভে এসে গিয়েছিল, না, বল্লভ বলে পাবলিকলি ডাকা হত। আমার একটা গোপন ডাক ছিল, জয়ন্ত। কিন্তু মনখারাপ থাকায় সে কথা বলতে ইচ্ছে করল না।
তুমি কি এখনো আদর খাবার সময় বল্লভ বলো দিদি?
পাঞ্চালী অন্য দিকে তাকালেন। রাগ হচ্ছিল নিজের ওপর। ভানুমতী কী করে বুঝবে একেক রাতে একেকজনের অঙ্কশায়িনী হতে কেমন লাগে!
বল্লভ কথায় মনে পড়ল কৃষ্ণের কথা। ওই একটা মানুষকেই জীবন বল্লভ বলার ইচ্ছে করেছিল। সেই দুর্বাসার ক্রোধ থেকে বাঁচিয়েছিলেন। কিন্তু আজ তিনি দুঃশাসনের হাতটাই স্থবির করে দিলে পারতেন। শাড়ির তোরঙ্গের দিকে আবার একবার চোখ পড়ে গেল।
সারিকা ভানুমতীর দিকে তাকিয়ে বলল, এবার তুমি ওঠো বাছা। আমাদের আরো গেস্ট এয়েচে। বলতে বলতেই ঘরে ঢুকলেন সত্যভামা, রুক্মিণী, জাম্ববতী, সুশীলা, আর লক্ষ্মণা। এঁরা সবাই কৃষ্ণের প্রধানা মহিষী।
তাঁদের দেখে ভানুমতী সরে পড়লেন। সত্যভামা বললেন, ওরে, তোর কপালে যে এই হেনস্থা তোলা ছিল আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবি নি রে!
রুক্মিণী বললেন, আমরা সবাই মিলে চটপট করে চলে এলাম তোমার কাছে। শুনচি, তুমি নাকি কী একটা প্রতিজ্ঞা করেছ!
সারিকা বলল, হ্যাঁ। দুঃশাসনের রক্ত না দেখে মেয়ে আমাদের বেণী বাঁধবে না।
লক্ষ্মণা হেসে বললেন, ও লো, তোদের টিয়েটা কি চমৎকার কথা বলে!
জাম্ববতী বললেন, দ্যাখো পাঞ্চালী, তোমার মোটেও উচিত হয় নি সভায় যাওয়া। তায় তোমার ইয়ে চলছে।
লক্ষ্মণা বললেন, তোর ওটা বলার কি দরকার ছিল, একটা মোটে কাপড় পড়ে আছি?
রুক্মিণী বললেন, চুপ কর্ তো তোরা! দুঃশাসনটা পুরো একটা ডাকাত। শোয়ার্জেনেগার ওর কাছে বাচ্চা ছেলে। কিজানি বাপু ওর বৌ কি করে ওকে সামলায়।
সুশীলা বললেন, পুরুষ মানুষকে সামলাতে জানতে হয় দিদি। দ্রৌপদী তোমার উচিত ছিল বরের জুয়োখেলার নেশাটা কাটানো। আমাদের শংকর গুহনিয়োগী তো বলেই গেছেন নেশার হাত থেকে মুক্তি না পেলে সামাজিক উন্নতি আসবে না।
লক্ষ্মণা বললেন, পুরুষ মানুষের নেশা কাটানো? শংকর গুহনিয়োগী খুন হয়ে গেল তবু দেশ থেকে মদের নেশা কাটল না।
সত্যভামা গম্ভীর হয়ে বললেন, তোরা আর পুরুষ মানুষের দোষ দেখিস নি। আমাদের টাকে দ্যাখ্ না! আমরা পাঁচ পাঁচটি বৌ। তবুও কত্তার মন ওঠে না। আরো চাই।
সহসা রাধার কথা মনে পড়ে গেল কৃষ্ণার। রাধা বৃন্দাবনে পড়ে আছেন। মথুরা থেকে কৃষ্ণ একবারও যান না আর তার কাছে।
লক্ষ্মণা বললেন, তোমাকে নাকি উনি অনেক শাড়ি দিয়েছেন নিজের হাতে! আমাদের বাপু অতো সৌভাগ্য হয়না। বলেন, যা ইচ্ছে দোকানে গিয়ে কিনে নিও। পেটিএমে টাকা দেওয়া হয়ে যাবে। হ্যাঁ রে পেটিএম নাকি চীনের কোম্পানি?
রাধার কথা ভাবেন পাঞ্চালী। কৃষ্ণকে তিনি বন্ধু হিসেবে জানেন। বন্ধু। যাকে সঅব বলা যায়। সঅব। দুর্বাসা আসছে শুনেই কৃষ্ণ স্মরণ করেছিলেন পাঞ্চালী। আজো বদমাশটা কাপড় ধরে টান দিতেই কৃষ্ণ স্মরণ করেছেন। কিন্তু রাধিকা সুন্দরী? কৃষ্ণ আসবেন বলে সাজ সজ্জা করছিলেন বৃষভানু নন্দিনী। কিন্তু তারপর? চির চন্দন উরে হার ন দেলা। বুকের স্পর্শ যাতে সবটুকু পাও, তাই হার পরি নি, চন্দন মাখি নি, আঁচলে ঢাকি নি।
…
জেলখানার দরজায় রাধিকা চাপড় মারছেন, ওগো ওকে ওষুধটা খেতে দিও।