• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১২)

আমার কথা 

৪৫
“এর চেয়ে ইংরেজ শাসনও ভাল ছিল”, এই বলে আক্ষেপের ছোঁয়া লাগালেন কথাটায়।
প্রতিপ্রশ্ন করলাম “কিন্তু কেন?”
বিরক্ত হয়ে বললেন “এত ইনডিসিপ্লিন সে সময় ছিল না। ভারতে এখন মিলিটারি শাসন দরকার। ডিসিপ্লিন দরকার। সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন স্বাধীনতার পর মিলিটারি শাসন চাই। অন্ততঃ পঁচিশ বছর।”
আমায় বলতে হল “ইতিহাস তো মোটেই পড়েন নি। ডিসিপ্লিন কারে কয়, তাও তো জানেন না। মিলিটারি শাসনের ওকালতি করেছিলেন সুভাষ চন্দ্র?
ভালো করে জেনে তবেই বলুন।
তর্কের খাতিরেও যদি ধরে নিই যে কোনো মহা মহোপাধ্যায় অমন উক্তি করেছিলেন, তবু মিলিটারি শাসন আমার কাছে সভ্যতার বিপ্রতীপ বস্তু।

৪৬

এমন কি হিটলার ও তাঁর সোনালী দিনগুলোয় অসামান্য জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি এতদূর জনমন আকর্ষণী ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন যে মহাত্মা গান্ধীকেও অনেকেই প্রশংসা করে ভারতের হিটলার বলে অভিহিত করতেন।
পরে পরে জানা গেল হিটলারের মতো অমানুষ দুশ্চরিত্র আর দুটি নেই।
জনপ্রিয়তা আর যথার্থতা অনেক সময়ই এক পাত্রে থাকে না।

৪৭

মৃত্যুদণ্ড?
আইন পড়েছি বলে জানি, সে বড় সোজা ব্যাপার নয়। স্বাধীন ভারতে যাঁদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রমাণিত অপরাধের চরিত্র আর আর্থিক সামাজিক অবস্থানের আলোচনা করলে আলমারি থেকে অনেক কঙ্কাল ঝাঁপিয়ে পড়বে।
আমি চাই যেটুকু আইন আছে তার বাস্তবায়ন করার পরিকাঠামো তৈরি হোক। নারী ও শিশুরা বাস্তবিক অর্থে লিগ্যাল এইড পাক।
আইনের শাসন যে আছে, এটা যেন মানুষ বুঝতে পারে।

৪৮

শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে বড়ু চণ্ডীদাস যে কাহ্নের কথা লিখেছেন, তিনি বৃহন্নলা আইহনের ঘরণী রাধার স্পর্শ খুঁজে চলেন। রাধা গোয়ালিনী। সে দুধ দই বেচে সংসারের টাকা যোগায়। গ্রামের অনেক গোয়ালিনীর সাথে সে দুধ দই বেচতে যায়। দানখণ্ড, ভারখণ্ড পড়ে দেখেছি কাহ্ন কিভাবে তরুণী গৃহবধূকে মলেস্ট করেছেন, শেষতঃ নানা কায়দায় একা করে নিয়ে রাধাকে পোশাক খুলতে বাধ্য করেছেন ও রেপ করেছেন। তার পরে যৌনতাবঞ্চিত রাধা যখন কাহ্নকে কামনা করবে ভেবেছে, তখন কাহ্ন সরে গিয়েছে। আইহনের থেকে যৌনতৃপ্তির কোনো সম্ভাবনা রাধিকার ছিল না। কাহ্নও তার নিজের হল না। এই আর্তিই রাধাবিরহের সম্পদ। গোটা বই গানে গানে সাজিয়েছেন বড়ু চণ্ডীদাস।
আমার ভয় হয় ভাগ্যে এই বই জনসমক্ষে ছিল না। পণ্ডিত আর শুদ্ধিবাদীদের হাতে পড়লে এই অনন্য সৃষ্টির বারোটা বেজে যেত।
কেষ্ট করলে লীলা, আর আমরা করলে বিলা …. এমনতর একটি কথা ক্লাস নাইনে পড়েছি। তার পর কালী সিংগীর “হুতোম পেঁচার নকশা” পড়তে গিয়ে দেখেছি বাঙালি কোলকাত্তাইয়া মধ্যবিত্তের গুরুরা যজমান বাড়ি এসে গোবর্ধন ধারণ, পুতনা নাশন প্রভৃতি আজেবাজে কাজ বাদ দিয়ে, বস্ত্রহরণ প্রভৃতি বাছা বাছা লীলায় ব্যস্ত থাকতেন। তার কিছু পরে শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে কাহ্নের কথা পড়েছি। বৈষ্ণব পদাবলীর কৃষ্ণ “দেবতা” গোত্রের। তাকে দিয়ে “কেষ্টলীলা’ মানায় না। লীলাখেলা শব্দের টানটা রবীন্দ্রনাথও এড়িয়ে যান নি। “চতুরঙ্গ” উপন্যাসে নারীমাংসলোলুপ ধর্মগুরুর নাম লীলানন্দ স্বামী। “গোরা” উপন্যাসেও ব্রাহ্ম গোষ্ঠীকর্তা হারাণবাবুকে লোকে পানুবাবু বলে ডাকে। তিনিও রাধারাণী সুচরিতাকে ছলে বলে কৌশলে পাকড়াও করতে চান।
কেষ্টলীলা যুগে যুগে।
কেষ্টলীলার কথা বলতে বলতে বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায় এর বয়সকালে লেখা “কৃষ্ণ চরিত্র” বইটির কথা মনে পড়ল। কৃষ্ণ চরিত্র বইটিতে বঙ্কিম কৃষ্ণকে “আদর্শ চরিত্র” হিসেবে দেখাতে চেষ্টা করেছেন। কৃষ্ণ চরিত্রটিকে বহুদিন ধরে বহু বিস্তৃত এলাকায় চলে আসা বিভিন্ন লেখার একটি ঘনপিনদ্ধ রূপ বললেই ঠিক হয়। যে কৃষ্ণ ভারত অর্জুন রূপী পিসতুতো ভাইকে বলছেন সব ধর্ম পরিত্যাগ করে আমাতে শরণ নাও, বা বলছেন, যখনই বিশ্ব সংকট উপস্থিত হয়, তখন আমি নিজেকে সৃজন করে যা কিছু সৎ ও সুন্দর, তাকে রক্ষা করি, (এমন আরো অনেক কথা বলেছেন। সে সব শ্রীমদ্ভাগবত গীতায় পাবেন), আবার সেই লোকটিই নদীতে স্নানরতা গোপিনীদের বস্ত্রহরণ করছেন, মিনতিতে কান না দিয়ে তাঁদের সম্ভ্রম হরণ করছেন, ভাবতে খারাপ লাগে। বঙ্কিম এই লোকশ্রুত বস্ত্রহরণকে উড়িয়ে দেন নি। বস্ত্রহরণের একটি ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছেন।
বঙ্কিম বলেছেন ভারতের নানা অংশে স্নান কালে বস্ত্র ছেড়ে রাখাই ছিল রীতি। কৃষ্ণ কথায় সেই তথ্য ধরা আছে। কিন্তু কৃষ্ণ বস্ত্রহরণ করেন নি, করতেই পারেন না, এই মাপের এঁড়ে তর্ক বঙ্কিম করেন নি।
যে কোনো যুক্তিবান লোকেই এঁড়ে তর্ক করতে লজ্জা পান।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।