৯৭ “বল্লালী বালাই”
কৈশোরেই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “বামুনের মেয়ে” পড়েছিলাম । বেশ মনে আছে বৃদ্ধ বিগত যৌবন কুলীন ব্রাহ্মণ বহু সংখ্যক বিবাহে অভ্যস্ত ছিলেন । সেই সব বামুনেরা তাঁদের স্ত্রীদের ডিটেলস একটা নোট বুক এ মেনটেইন করতেন। খাতা ধরে বৎসরের নির্দিষ্ট সময়ে পত্নী র পিতৃ গৃহে যেতেন ওই কুলীন বামুন । সেখানে যেতে হত এই কারণে যে ওই সব বিবাহিতা ব্রাহ্মণ কন্যাগণ পিতৃ গৃহেই থাকতে বাধ্য হতেন। পঞ্চাশ ষাটটি কন্যার পাণিগ্রহণ করা অসম্ভব ছিল না । বৃদ্ধ বিগত যৌবন কুলীন ব্রাহ্মণ শ্বশুর গৃহে একরাত্রির জন্য গিয়ে যত্ন আত্তি সেবা গ্রহণ করতেন । আর দক্ষিণা নিতেন। এই দক্ষিণাগ্রহণ ছিল ওই সব বামুনের পেশা। হ্যাঁ, সমাজস্বীকৃত পেশা ।
স্ত্রী গমন করাও ছিল স্বামিত্বের দায়িত্ব । বৃদ্ধ বিগতযৌবন কুলীন ব্রাহ্মণ বহু সময়েই যুবতী বা তরুণী বধূর যৌনচাহিদা মেটাতে শারীরিক ভাবে সমর্থ হতেন না । এজন্য প্রায় ক্ষেত্রেই ওইসব বৃদ্ধ বিগতযৌবন কুলীন ব্রাহ্মণ নিজের নাপিতকে সাথে নিয়ে ঘুরতেন। শারীরিক ভাবে অক্ষম বৃদ্ধের তরফে পত্নীগমনের কাজটি ওই নাপিত মহাশয়গণ সাধন করতেন।
কৈশোরেই ” বামুনের মেয়ে” পড়ে আমাদের বাড়ির পূজারী ব্রাহ্মণটির উপর খুব রাগ হয়েছিল। পরে তাদের বাড়ির একটি ছেলে আমার সমবয়সী হওয়ায় তাকে আমার নবার্জিত জ্ঞান বিতরণ করেছিলাম ।
৯৮
যখন থেকে বাংলা কবিতা পড়তে শিখেছি , আমার অভিভাবক আমাকে কবিতার গভীরে যেতে প্রাণিত করেছেন। আমার ছোটোবেলায় পড়া কবিতার মধ্যে বন্দে আলি মিঞার লেখা একটি কবিতা ছিল। কবিতাটি পড়ে সর্বদা একটি ঐক্য ও সমন্বয়ের সুর খুঁজে পেয়েছি। কখনো ভাবি নি ওটি মুসলমানের লেখা। আমার বাবা মা-ই আমাকে পড়াতেন। নিচের ক্লাসে মা, সেভেন থেকে টেন এর প্রথম অর্ধ অবধি বাবার কাছেই পুরো পড়া শোনা। সব বিষয় গুলিই বাবা দেখাতেন। ব্যাঙ্ককর্মী বাবার বিপুল জ্ঞান না থাকলেও প্রাণভরা আন্তরিকতায় তিনি সকল খামতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতেন। কাজী নজরুল ইসলাম আর সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা পড়তে সেই বালক বয়সে এত উৎসাহ পেতাম যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করাকে অন্যতম কবিধর্ম বলে মনে করতাম। শামসুর রহমানের কবিতা, নীরেন চক্রবর্তীর কবিতাতেও কবিকে শাসকের অনাচারের বিপ্রতীপে দাঁড়াতে দেখেছি। মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় , বীরেন্দ্র চট্টোপাধায় আর দিনেশ দাসের কবিতা আমায় বেশ ভাবাতো । আমার সেই ছোটবেলায় কবিরা এত রকমারী পুরস্কার পেতেন না । কবিদেরকে পলিটিক্যাল পকেটে পুরে ফেলার চেষ্টা বিপুল হতে দেখি নি। না খেয়ে, বা কম খেয়ে থাকতে হত অনেক কবিকে । মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় তো রীতিমতো কঠোর অর্থাভাবে দিন কাটাতেন । তিনি বরানগরের বাসিন্দা ছিলেন। কবিতা পত্রিকা মানুষের কাছে বিক্রি করতে হত। সরকারী আনুকূল্য পাবার জন্য কবিধর্মকে বাদ দেব, এমন স্বপ্ন তাঁরা দেখতেন না । অহংকার করে কোনো কবি বলেছিলেন – “হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছো মহান, তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীস্টের সম্মান।” মুসলমানের ঘরে জন্মানো কবিও অকুণ্ঠ চিত্তে খ্রীস্টের মহত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারতেন। কবিদের একটাই ধর্ম থাকতো, সে হল কবিধর্ম ।
৯৯
হিন্দুর ধর্ম কিসে প্রকাশিত হয়, কিসে বিকশিত হয়, সেটা জানা দরকার। সেটা মনে হয় ত্রিশূলে সীমিত নয়। ত্রিশূলকে প্রতীক হিসাবে ধরলেও আরো অনেক জনপ্রিয় প্রতীক থাকা সম্ভব, ও আছেও। কিন্তু হিন্দু পরিমণ্ডলে বড়ো হয়েও প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রাপ্তমনস্ক কেউ কেউ অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শে পথ চলেছেন। কেউ কেউ সমন্বয়ের পথে হেঁটেছেন । কেউ কেউ শিখ ও বৌদ্ধ এমন কি খ্রিস্টধর্মের উপাদান থেকে নিজের বোধকে শাণিত করেছেন। বাঙালি কবিদের কবিতা যেটুকু পড়েছি, তাতে হিন্দু মুসলমান উভয় পরিবেশে বড়ো হয়ে ওঠা কবিই মুক্তবুদ্ধির কথা বলতে দ্বিধা করেন নি। শাসকের কুৎসিত ছক হিসেবে ধর্মের অনুষঙ্গগুলি ব্যবহারের প্রতিবাদ করেছেন অনেক বাঙালি কবি। বাংলায় কবিদের মধ্যে প্রতিবাদী কবিতা লেখা এমন কি তার জন্যে জেলে পর্যন্ত যাবার অদম্য মানসিকতা দেখা যায়। সময়ের তুমুল ডাককে উপেক্ষা করেন নি অনেক বাঙালি কবি । শাসকের আনুকূল্য বা উচ্ছিষ্ট ভোজনকে ধিক্কার দিয়ে স্বাধীন জীবনে অনেক কবির আগ্রহ থাকে। সকলেই কিছু আর পুরস্কার পেয়ে বিগলিত হেঁহেঁ জীবনের অভিলাষী নন। বাঙালি কবিদের একটা বড়ো অংশ এমন কি মার্ক্সবাদেও বিশ্বাসী হয়েছেন, সমাজ বদলের স্বপ্নে আত্মনিয়োগ করেছেন । বাংলার সেরা কবি ধর্মকে ধর্মমোহের থেকে আলাদা করে দেখতেও শিখিয়েছেন।
১০০
কবিতার আসর – সে কতো জায়গায় গড়ে উঠছে নিত্যদিন। আমার যোগদান করা সাম্প্রতিকটি হয়ে গেল আদ্রার সুভাষ নগরে। এর আগে আমাদের রঘুনাথপুরে আমরা আড্ডা দিয়েছি, কবিতা পড়েছি, আবৃত্তিও । তারও আগে বরানগরে , দমদমে, সিঁথির ভেতরে, বনহুগলিতে, ডানলপে, আলমবাজারে, বালুরঘাটে, ফালাকাটায়, ইসলামপুরে, জলপাইগুড়িতে, আলিপুরদুয়ারে আর দিনহাটায় । যেখানেই কয়েকমাস টানা রাত কাটিয়েছি , দেখেছি শিক্ষক অধ্যাপক চিকিৎসক নার্স স্বাস্থ্যকর্মী , কেরানি, বীমা এজেন্ট, সেলস ম্যান, এমন কি জ্যোতিষী … সমস্ত পেশাগত পোশাক খুলে কেবল নিজের কবিধর্মটুকু নিয়ে কবিতা আসরের সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালতে আসছেন। তাদের চাহিদাও খুব কম। ভাঁড়ে একটু যা হোক চা যথেষ্ট । বিস্কুট দিলে তো খুব খুশি। কবি একটু উৎসাহ চায়। একটু স্বীকৃতি। বিচ্যুতি একেবারে দেখি নি, তা নয় । দলাদলি অনেক সময় মাথা তোলে । একঘরে করার চেষ্টা চলে। আর স্তাবকের হাতে মদ্য সরবরাহ হলে অনেক সময় অনেক শব্দজীবী তাল সামলাতে না পেরে উৎকট আচরণ করে ফেলেন। প্রকৃত কবিতাপ্রেমীরা স্তাবকদের হাত থেকে কবিদের সামলে রাখুন । আগলে রাখুন। কবিদের অল্পই ভালো । অল্প জোটাই ভালো ।