অ্যাডলফ হিটলারের মেইন ক্যাম্পফ: বেস্ট সেলার বইয়ের ভিতরের গল্প

অ্যাডলফ হিটলারের নাম কে না জানে! মানবতার এমন জঘন্য শত্রু পৃথিবীতে বেশি জন্মান নি। এই হিটলার একটা বইও লিখেছিলেন। মেইন ক্যাম্পফ নামে তা পরিচিত। জার্মান ভাষায় দুই খণ্ডে প্রকাশিত মেইন ক্যাম্পফের প্রথম খণ্ডটি, ১৯২৫ সালে আজকের দিনে প্রকাশিত হয়েছিল। দ্বিতীয় খণ্ডটি বেরিয়েছিল ১৯২৬ সালে। সংক্ষিপ্ত একটি ইংরেজি সংস্করণ বেরিয়েছিল ১৯৩৩ সালে আর পূর্ণায়ত ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৯ সালে। জাতিঘৃণা, উগ্র কমিউনিস্ট বিরোধিতা, আর ইহুদি বিরোধিতা, যে তিনটি হিটলারের রাজনৈতিক মতবাদের মূল বিষয়, তা ৭২০ পৃষ্ঠার এই বইতে ধরা আছে।
অ্যাডলফ হিটলারকে নিয়ে অনেক তলিয়ে ভাবার দায় আছে। কেন, কি করে হিটলারি মানসিকতা গড়ে ওঠে, তা তো জানতে হবে। আজ আমরা তীব্র নিন্দা করছি, ধিক্কার জানাচ্ছি, অথচ অত্যন্ত কুখ্যাত এই স্বৈরাচারী শাসক ক্ষমতায় থাকাকালীন জার্মানিতে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। ১৮৮৯ সালে ২০ এপ্রিল হিটলারের জন্ম। অস্ট্রিয়াতে। ১৯৪৫ সালের এপ্রিল মাসের ৩০ তারিখে জার্মানিতে সদ্য পরিণীতা দীর্ঘদিনের সঙ্গিনী ইভা ব্রাউনকে সাথে নিয়ে নিজের বন্দুক দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
আগেই বলেছি, হিটলারের বিখ্যাত বই “মেইন ক্যাম্পফ”। এতে ওঁর রাজনৈতিক দর্শনের হদিশ পাওয়া যায়। ১৯২৫ সালে জেলে বসে তিনি এই বইয়ের প্রথমাংশ লিখিয়েছেন। সমাজতন্ত্রের কথা বলতে বলতে ক্রমশঃ জাতিঘৃণা, জাতিবিদ্বেষ ও নিজের জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারে মনোনিবেশ করেন হিটলার।
কারান্তরীণ হিটলার মুখে মুখে বলে যেতেন তাঁর সংগ্রামের কথা। সংগ্রাম মানে আর কিছু না, কট্টর ইহুদি বিদ্বেষ আর উগ্রজাতীয়তাবাদী কথাবার্তা। তাই শ্রুতলিখন করতেন ওঁর শ্যোফার এমিল মরিস। পরে হিটলারের ডেপুটি রুডলফ হেস ওই কাজ করেছেন। হিটলার তাঁর বই উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর গুরুতুল্য ডায়েট্রিশ একার্টকে।
এখন বলি মেইন ক্যাম্পফ, কিন্তু বইটি প্রকাশিত হবার কালে এর নাম ছিল “ফোর অ্যাণ্ড এ হাফ ইয়ারস এগেইনস্ট লাইজ়, স্টুপিডিটি অ্যাণ্ড কাওয়ার্ডিস।” পরে প্রকাশকের ব্যবসাবুদ্ধিতে বইটির নাম পরিবর্তন করা হয়।
এগারো নভেম্বর, ১৯২৩ তারিখে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে হিটলার অ্যারেস্ট হন। বিচারের পর ১ এপ্রিল হিটলারকে পাঁচ বছর মেয়াদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু গোটা একটা বছর কাটতে না কাটতে হাওয়া ঘুরে যায়। বছরের শেষ দিকে ২০ ডিসেম্বর জেল থেকে মুক্তি পেয়ে যান হিটলার।
এই জেলে বসেই তাঁর পুস্তক রচনা। বইটির নাম মেইন ক্যাম্পফ বা মাই স্ট্রাগল হিসেবে জনপ্রিয়তা পেলেও প্রকৃতপক্ষে ওটি লেখকের দেওয়া নাম নয়। হিটলার তাঁর বইয়ের নাম রেখেছিলেন “মিথ্যা, নির্বুদ্ধিতা আর ভীরুতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের সাড়ে চারটি বছর”। প্রকাশক ম্যাক্স আম্মান সেটিকে ব্যবসার খাতিরে বদলে দিয়ে করলেন “মেইন ক্যাম্পফ” বানিয়ে দিলেন।
মেইন ক্যাম্পফ বইয়ের বিক্রি প্রথম দিকে আহামরি কিছু ছিল না। কিন্তু ১৯৩৩ সালে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর বইটির বিক্রি বেড়ে যায়। ১৯৩৯ এ বইটির সাংঘাতিক বিক্রি। কেন? তা একটি ছোট্ট অঙ্কের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে।
১৯৩৩ সালে তিনি জার্মানির চ্যান্সেলর হন। ১৯৩৪ সালে নিজেই নিজেকে ফুয়েরার বা সর্বাধিনায়ক উপাধি দেন। ১৯৩৯ এ শুরু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
“মেইন ক্যাম্পফ” বইটির প্রথম খণ্ড বের হয় ১৯২৫ ও দ্বিতীয় খণ্ড বের হয় ১৯২৬ সালে। প্রথমে এই বইয়ের কাটতি ভাল না থাকলেও ১৯৩৩ সালে লেখক জার্মানির চ্যান্সেলর হলে বইটির বিক্রি সাংঘাতিক রকম বাড়ে ও বেস্ট সেলার হয়। দেখা গেছে, বড় রাজনৈতিক দলের তাবড় নেতারা কোনো বই লিখলে তা নিয়ে হইহই পড়ে যায়। ক্ষমতার অলিন্দের কাছে থাকতে চায় অনেকেই। হিটলার বড়ো জায়গায় চলে যেতেই বইটার কাটতি বেড়ে গেল।
এই সাংঘাতিক স্বৈরতন্ত্রী ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর তারিখে পোল্যাণ্ড আক্রমণ করে ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করেন।
হিটলার বা মুসোলিনি একলা পারেন নি। হিটলারের সাথে ছিল হিমলার। ছিল গোয়েরিং। সাথে ছিল ব্রাউন শার্ট, এস এস বাহিনী। আর ছিল তথাকথিত আর্যামির স্লোগান। জাতিবিদ্বেষ খুঁচিয়ে তোলার কৌশল। দেশপ্রেমের মিথ্যে চটক। বিরোধী শিবির ছিল ছন্নছাড়া। ওই যে বিরোধী শিবিরের ছন্নছাড়া দশা, ওতেই বাজার মাত করেছিলেন অ্যাডলফ হিটলার। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন মানে তো যৎসামান্য। জাতিঘৃণা জাতিঘৃণা আর জাতিঘৃণা। একেবারে অবৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা নিয়ে লেখা একটা বই। ছাত্র হিসেবেও ভাল ছিলেন না হিটলার। কেঁদে ককিয়ে স্কুলের গণ্ডি টপকানো লোকটা উচ্চশিক্ষার ধারেপাশেই ঘেঁষেননি কোনোদিন। যুক্তি সাজিয়ে বক্তব্য পেশ করতেও জানতেন না। ভাষার বুনোট কাকে বলে তাও জানতেন না। শুধু জানতেন গাঁজিয়ে তুলতে, ফেনিয়ে তুলতে। খেপিয়ে তুলতে। একই কথা অকারণে বারবার বলে গিয়েছেন তিনি। এইজন্য এমনকি হিটলারের সহযোগী ইটালির ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রনায়ক মুসোলিনিও বলেছিলেন, বইটা বড্ড বোরিং।
তাহলে কি করে অমন একটা পাতি বইয়ের অমন সাংঘাতিক বিক্রি সম্ভব হল? সম্ভব হল হিটলার ক্ষমতায় ছিলেন বলে। ১৯৩৩ সালে হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর, আর তাঁর বই হল বেস্ট সেলার। ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত বিক্রি হয়েছিল ৫,২০০,০০০ খানি বই। আর এগারোটা ভাষায় অনুবাদ। কিন্তু সরকার যদি লোককে কিনতে বলে? রাষ্ট্রনায়কের লেখা বই লোকজন না কিনে যাবে কোথায়? আর নববিবাহিত দম্পতিদের এই বই রাষ্ট্রের তরফে উপহার দেওয়াও হত। বেস্ট সেলারের হিসাব মিলল?