• Uncategorized
  • 0

রবিবারে রবি-বার – এ মৃদুল শ্রীমানী

রাষ্ট্রনীতি, জনপ্রশাসন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কয়েকটি কবিতা

একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর আগে যে বিদেশি শক্তি ভারতে আসে নি, তা কিন্তু নয়। পাঠান এবং মোগলেরা ভারতে এসেছিল। কিন্তু তখন যুগটা ছিল অন‍্যরকম। তারা ভারতের আবহাওয়ায় মিলে মিশে ভারতীয়ই হয়ে গিয়েছিল। তা ছাড়া, আধুনিক অর্থে রাষ্ট্রচেতনা, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও নাগরিক অধিকার বলতে যা বোঝায়, তা ব্রিটিশপূর্ব ভারতে ছিল না। সত‍্যি কথা বলতে কি, দেশটা কেমন দেখতে, তা সাধারণ মানুষ জানত‌ই না। গুটিকয়েক ব‍্যবসাদার, এবং হাতে গোণা রাজপ্রতিনিধি পর্যটক লোক লস্কর নিয়ে হাতি ঘোড়া উটের পিঠে দেশভ্রমণ করতেন। আর দেশভ্রমণ করতেন ধর্মসংস্কারকেরা, প্রচারকেরা। অতি সাধারণ লোকে ঘর হতে আঙিনা বিদেশ জানত।
ব্রিটিশের বস্তুবাদী বিজ্ঞান প্রকৌশল এবং অনুসন্ধিৎসা কাশ্মীর থেকে কেরালা, আর আরাকান থেকে আরব সাগর তীর কেমন দেখতে তার ভূবৈজ্ঞানিক ধারণা দিয়েছিল। নদীর গতিপথ, মরুভূমির বিস্তার, পর্বতের উচ্চতা সাধারণ মানুষ জানত। কিন্তু সেটা ছিল ভাসা ভাসা ধারণা। ব্রিটিশ তাকে দিল গাণিতিক স্পষ্টতা। আর রেলপথ দিয়ে দেশের এক অংশের সাথে অন‍্য অংশের যোগসাধন করে দিল।
এর সাথে ইউরোপীয় পণ্ডিতদের হাতে ভারতীয় পুঁথিতে ধৃত মহাকাব‍্য, বেদ বেদান্ত, উপনিষদ, এইসব ধর্মগ্রন্থের অনুবাদ ও মুদ্রণ হ‌ওয়ায় তা সাধারণ লেখাপড়া জানা মানুষের হস্তগত হল।
জার্মান পণ্ডিত ম‍্যাক্সমূলার ( ০৬.১২. ১৮২৩ – ২৮.১০. ১৯০০) সহ এশিয়াটিক সোসাইটি (১৫.০১.১৭৮৪) র প্রতিষ্ঠাতা উ‌ইলিয়াম জোনস ( ২৮.০৯.১৭৪৬ – ২৭.০৪.১৭৯৪) এবং এশিয়া মহাদেশে আধুনিক কালে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম কেরি ( ১৭.০৮.১৭৬১ – ০৯.০৬.১৮৩৪) এ ব‍্যাপারে সর্বাগ্রগণ্য।
দেশের মাটিতে দেশমাতৃকার মূর্তি কলমের আঁচড়ে যে কবিরা গড়ে তুলেছিলেন, তাঁদের মধ্যে লুই হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিও ( ১৮.০৪.১৯০৯ – ২৮.১২.১৮৩১) এবং মাইকেল মধুসূদন দত্ত ( ২৫.০১.১৮২৪ – ২৯.০৬.১৮৭৩) কে স্মরণ করতে হয়।
মনে রাখতে হবে ইংরেজ সভ‍্যতা ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন তারিখে, পলাশীর যুদ্ধে হীনকৌশলে জয়লাভ করে ভারতে ক্ষমতা বিস্তারের প্রথম ধাপটি সেরে ফেলে। এই যুদ্ধে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির তরফে নেতৃত্ব দেন রবার্ট ক্লাইভ ( ২৯.০৯.১৭২৫ – ২২.১১.১৭৭৪)। ইংরেজের যুদ্ধের গোলা বারুদ সাজ সরঞ্জাম ছিল উন্নতমানের। যুদ্ধকৌশল‌ও ছিল আধুনিক। কিন্তু নবাব সিরাজ উদ্দৌলাকে হারাতে ক্লাইভকে ষড়যন্ত্র করতে হয়েছিল। ঘুষের প্রয়োগে নবাবের লোকেদের প্রভাবিত করে ইংরেজ পলাশীর যুদ্ধে জয় হাসিল করে। এই যুদ্ধে ইংরেজের বীরত্ব ও রণকৌশল নয়, নবাবের অজ্ঞতা আর ভারতীয়দের ঘুষ খাওয়ার জয় হয়েছিল।
মনে রাখতে হবে, রবার্ট ক্লাইভ বাংলাকে নির্মমভাবে লুঠ করে সাংঘাতিক দুর্ভিক্ষের মধ‍্যে ঠেলে দেন। ১৭৬৯ খ্রীস্টাব্দ থেকে ১৭৭৩ খ্রীস্টাব্দ অবধি বাংলার বিপুল সংখ্যক মানুষ অনাহারে, অর্ধাহারে অখাদ‍্য খেয়ে মারা পড়ে। একে আমরা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর হিসেবে চিনি। বাংলাকে এত ভয়ংকর ভাবে লুঠ করে, বিস্তর ধনসম্পত্তি কুক্ষিগত করেও রবার্ট ক্লাইভ শেষরক্ষা করতে পারেন নি। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তাঁর দুর্নীতি ও অবৈধভাবে ধনসম্পত্তি সংগ্রহ করা নিয়ে মামলা হয়েছিল। ক্লাইভ তাঁর লুঠতরাজের জন‍্য স্বজাতির ভদ্রলোকেদের কাছে নিন্দিত ও ধিকৃত হয়েছিলেন। বাংলার দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের হাহাকার ও কান্না ব্রিটেনে শোনা গিয়েছিল। ১৭৭৪ সালে নিঃসীম আত্মগ্লানিতে ক্লাইভ আত্মহত্যা করেন। তখন বয়স তাঁর পঞ্চাশ ছোঁয় নি।
ভারতে যাঁরা শাসন করতে এসেছেন, ভারতীয় শিক্ষিত অভিজাত ও ধনিকগোষ্ঠী তাঁদের সাথে হৃদ‍্যতা গড়ে তুলেছে। পাঠান ও মোগল আমলে অনেক সময়েই স্থানীয় ভূস্বামীরা প্রথাগত হিন্দুধর্ম পরিত্যাগ করে শাসকের ধর্ম গ্রহণ করেছেন। শাসকের বিশ্বাস অর্জনের খাতিরে তাঁর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়েছেন।
শাসকেরাও ভারতের রুচি সংস্কৃতি আত্মস্থ করার চেষ্টা করেছেন। ভারতীয় ধর্মশাস্ত্র ও সাহিত্যের অনুবাদ ঘটেছে আরবি ফারসিতে। হিন্দি ও আরবি ফারসির মেলবন্ধনে উর্দিপরা লোকের হাতে উর্দূ জন্ম নিয়েছে।
স্থাপত‍্যশৈলী ও রন্ধনশৈলীতেও মেলবন্ধন পাওয়া গিয়েছে। শাসকের সাথে এই হৃদ‍্যতার সম্পর্ক ইউরোপীয়দের ক্ষেত্রেও বন্ধ হয় নি। ভারতে প্রথম আসেন পর্তুগিজ নাবিকের দল। নেতৃত্বে ছিলেন ভাস্কো ডা গামা। ২০.০৫.১৪৯৮ তারিখে তিনি দলবল নিয়ে তিনি গোটা আফ্রিকার উপকূল বরাবর পাড়ি দিয়ে উত্তমাশা অন্তরীপ পার হয়ে কালিকট বন্দরে পৌঁছান।
মনে রাখি যে মাত্র কয়েকটি বৎসর আগে ১৪৯২ এর অক্টোবরে আরেকজন বিশ্ববিখ্যাত নাবিক অভিযাত্রী, ক্রিস্টোফার কলম্বাস, ইণ্ডিয়া ভেবে বাহামায় পা রেখেছেন।
ভাস্কো ডা গামার অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে পর্তুগিজ সরকার তাঁকে ১৫২৪ সালে গভর্নর অফ ইণ্ডিয়া খেতাব দেন, ও ভাইসরয় পদে সম্মানিত করেন। ওই ১৫২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে চব্বিশ তারিখে এখনকার কোচিতে তিনি দেহরক্ষা করেন। ইউরোপীয় জাতিগুলির মধ‍্যে পর্তুগিজদের পরে ভারতে এসেছিলেন যথাক্রমে ইংরেজ, ডাচ, ডেনিশ আর ফরাসি। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি নামে এরা প্রত‍্যেকে প্রতিষ্ঠান খুলেছিলেন। ১৬০০ সালে ইংরেজদের, ১৬০২ তে ডাচদের, ১৬১৬তে ডেনমার্কের আর সবার শেষে ১৬৬৪ তে ফরাসিদের ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইতিমধ্যে ১৬১৯ নাগাদ কুশলী কূটনীতিক স‍্যর টমাস রো ( ১৫৮১ – ০৬.১১.১৬৪৪) কে আনিয়েছিলেন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। স‍্যর টমাস রো মোগল বাদশাহ জাহাঙ্গীর এর সভায় ব্রিটিশ স্বার্থের হয়ে দরবার করে সুরাটে ব‍্যবসা করার অনুমতি আদায় করেন।
ইংরেজদের প্রভাবে অন‍্য ইউরোপীয় জাতিগুলি ভারতে বিশেষ কিছু ক্ষমতা বিস্তার করতে পারে নি।
বণিকদের সাথে খ্রীস্টীয় ধর্মপ্রচারকগণ‌ও এদেশে এসেছেন। এদেশের মানুষ অশিক্ষা কুশিক্ষা র অন্ধকারে ডুবে আছে। এদেরকে আলোর সন্ধান দেবেন, উদ্ধার করবেন, খ্রীস্ট ধর্মের স্বাদ দিয়ে এদের জীবন সার্থক করবেন, এমন উদ্ভট মানসিক গঠন নিয়েই ধর্মপ্রচারকগণ ভারতে আসতেন।
এই সময় প্রযুক্তিবিদ ও ব‍্যবস্থাপকগণ‌ও ভারতে এসেছেন। ধর্মপ্রচারকগণ তাঁদের আসতে উৎসাহিত করেছেন। তাঁরা মুদ্রণযন্ত্র এনে সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র গড়ে তুলেছেন। ১৪৪০ সালে জোহান গুটেনবার্গ প্রথম আধুনিক অর্থে ছাপাখানা গড়ে তোলেন। অনেক দেরিতে ১৭৯৫ সালে এসেছে পুরোপুরি ধাতুর তৈরি প্রেস। ১৮০০ সালে এসেছে স্ট‍্যানহোপ প্রেস।
ধর্মপ্রচারকগণ এইসব মুদ্রণযন্ত্রে দেশীয় বিভিন্ন পুঁথি ছাপিয়ে তার অসারতা কুসংস্কারাচ্ছন্নতা তুলে ধরে দেখাতে গিয়ে দেশীয় মানুষের কাছে তার হারিয়ে যাওয়া অভিজ্ঞান পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন। ভারতে মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠায় উইলিয়াম কেরি ( ১৭৬১ – ১৮৩৪)র অবদান সর্বাগ্রগণ‍্য। ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতে খ্রীস্ট ধর্ম প্রচারে বাধা পেয়ে তিনি ডেনিশ উপনিবেশ শ্রীরামপুরে ১৮০০ সালের জানুয়ারি মাসের দশ তারিখে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এর আগে যদিও অ্যাণ্ড্রুজ সাহেবের আয়োজনে ব‍্যাণ্ডেল প্রেস থেকে ১৭৭৮ সালেই নাথানিএল ব্রাসি হালেদ সাহেবের ব‍্যাকরণ প্রকাশিত হয়েছে, তবুও কাজের ব‍্যাপ্তিতে ও গুণমানে শ্রীরামপুর প্রেস তুলনাহীন। কেরির আগ্রহে বিশিষ্ট ভাষাবিদ ও লিপিবিশারদ স‍্যর চার্লস উইলকিনস (১৭৪৯ – ১৩.০৫.১৮৩৬) বিভিন্ন পুঁথির হস্তলিপি পাঠ, পরীক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে বাংলা হরফের মান‍্য বয়ান তৈরি করে দেন। তারপর পঞ্চানন কর্মকার ও জামাতা মনোহর কর্মকার সেই অনুযায়ী লোহার হরফ তৈরি করেন। শ্রীরামপুর প্রেসে প্রথম মুদ্রক ছিলেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য।
ব্রিটিশেরা স্বজাতীয় কর্মচারীকে ভারতীয় ভাষাভাষী লোকের উপর শাসন, বিচার ও পরিচালনার যোগ্য করে তুলতে গিয়ে তাঁদেরকে দেশীয় ভাষা ও দেশীয় মূল‍্যবোধের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে উদ‍্যোগী হন। ১৮০০ সালের ১০ আগস্ট তারিখে লর্ড ওয়েলেসলির পৌরোহিত‍্যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আগেই ১৭৮১ সালে প্রতিষ্ঠা হয়েছে ক‍্যালকাটা মাদ্রাসা, আর ১৭৮৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বিভিন্ন ধ্রুপদী প্রাচ‍্যভাষার পাশাপাশি ভারতীয় ভাষা পড়ানোর গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এই কলেজের ফারসি ভাষাবিভাগের প্রধান অধ্যাপক ছিলেন নিল বি. এডমনস্টোন, আর তাঁর সহযোগী অধ‍্যাপক ছিলেন জন এইচ হ‍্যারিংটন ও ফ্রান্সিস গ্ল‍্যাড‌উইন।
আরবিক ভাষাশিক্ষা বিভাগের প্রধান ছিলেন লেফটেন্যান্ট জন বেইলি। উর্দূ ভাষা বিভাগের অধ‍্যাপক ছিলেন জন বর্থ‌উইক গিলক্রিস্ট। সেই সময় সংস্কৃত ছিল শিক্ষিত মানুষের পছন্দের ভাষা। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ছিলেন হেনরি টমাস কোলব্রুক। এইসব গুরুত্বপূর্ণ ধ্রুপদী ভাষার পাশাপাশি ভারতীয় ভাষা শিক্ষা দেবার ব‍্যবস্থা সেখানে ছিল। এই বিভাগের প্রধান ছিলেন উইলিয়াম কেরি ( ১৭.০৮.১৭৬১ – ০৯.০৬.১৮৩৪)। তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ইউরোপীয় সিভিল সারভেন্টদের বাংলা ভাষাশিক্ষা দেবার জন্য মৃত‍্যুঞ্জয় বিদ‍্যালঙ্কার, রামনাথ বাচস্পতি, রামরাম বসু প্রমুখকে পণ্ডিত হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ‍্যাসাগর ও মদনমোহন তর্কালঙ্কার মহাশয়‌ও পড়িয়েছেন।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা হবার পরে বুদ্ধিনাথ মুখার্জির আগ্রহে, ও ফোর্ট উইলিয়াম স্থিত সুপ্রিম কোর্টের চিফ জাস্টিস স‍্যর এড‌ওয়ার্ড হাইড ইস্ট মহাশয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁর বাড়িতে ২০ জানুয়ারি, ১৮১৭ তারিখে আহূত গুণী বিদ‍্যানুরাগীদের একটি সভায় প্রেসিডেন্সি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন নাম ছিল হিন্দু কলেজ। তেজচন্দ্র বাহাদুর এবং গোপীমোহন ঠাকুর হিন্দু কলেজের প্রথম গভর্নর হয়েছিলেন। সেক্রেটারি হয়েছিলেন বুদ্ধিনাথ মুখার্জি। একটি কমিটি হিন্দু কলেজের দৈনন্দিন ব‍্যবস্থাপনা দেখাশোনার জন‍্য নির্দিষ্ট হয়। ওই কমিটির শীর্ষে ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। প্রথমে গরাণহাটায় গোরাচাঁদ বসাকের বাড়িতে বিদ‍্যায়তনের কাজ শুরু হয়। পরে তা ফিরিঙ্গি কমল বোসের বাড়িতে উঠে আসে। ১৮১৮ সালের ১৫ জুলাই তারিখে উইলিয়াম কেরি সাহেবের উদ‍্যোগে ও উইলিয়াম ওয়ার্ড এবং জোশুয়া মার্শম‍্যানের সহযোগিতায় শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই সূত্রে আমরা লুই হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিও ( ১৮.০৪.১৮০৯ – ২৮.১২.১৮৩১) কে স্মরণ করব। ডিরোজিও ছিলেন একজন অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান কবি শিক্ষাবিদ ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ। অত‍্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি নজর কেড়েছিলেন। বালক বয়সেই তিনি ইণ্ডিয়া গেজেটে কবিতা লিখতে শুরু করেন। জন কীটস, পি বি শেলি, ও বায়রণের চিন্তাধারার প্রভাব তাঁর কবিকৃতিতে খুঁজে পাওয়া যায়। ইণ্ডিয়া গেজেটের সম্পাদক জন গ্রাণ্ট ডিরোজিওর লিখনশৈলীতে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে সহ সম্পাদক হিসেবে আমন্ত্রণ জানান। ডিরোজিও তা স্বীকার করেন। পরে তিনি নিজেই ক‍্যালকাটা গেজেট নামে একটি পত্রিকা বের করেছেন।
মাত্র সতের বৎসর বয়সে ১৮২৬ সালের মে মাসে ডিরোজিও হিন্দু কলেজের ইংরেজি ও ইতিহাস বিভাগে সহ শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। পাঠদানের দক্ষতা ও ব‍্যক্তিত্বের সৌরভে অল্পদিনের মধ‍্যেই তিনি সহপ্রধান শিক্ষক পদে উন্নীত হন।
ছাত্রদের মধ‍্যে তাঁকে ঘিরে এক মহৎ উদ্দীপনা গড়ে ওঠে। ডিরোজিও ছাত্রদের মধ‍্যে জিজ্ঞাসা ও যুক্তিবোধির বীজ বপন করতে করতে ১৮২৮ সালে অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন নামে বিতর্ক সভা গড়ে তোলেন। জ্ঞানপিপাসা, যুক্তিবাদ, কুসংস্কার ও রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে প্রবল আক্রমণকে পুঁজি করে ডিরোজিওর ছাত্ররা কলকাতার বুকে এক প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলে। এই ছাত্ররা ইয়ং বেঙ্গল নামে বিখ্যাত হন। রক্ষণশীল সমাজ ছেড়ে কথা বলে নি। অত‍্যন্ত গুণী ছাত্রদরদী ডিরোজিওকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তাড়িয়ে ছেড়েছে। মাত্র বাইশ বছর বয়সে এই চিরস্মরণীয় চিরবরণীয় শিক্ষক কলেরায় ভুগে মৃত্যুমুখে পতিত হন। তাঁর পর ছাত্রদের দিশা দেখাবার দায়ভার গ্রহণ করেছিলেন আরেকজন শিক্ষানুরাগী মহাপ্রাণ ডেভিড হেয়ার।
খুব স্পষ্টতঃ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি নিজেদের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে সমকালীন বাংলা তথা ভারতকে গড়ে নিতে চেয়েছিলেন। কোম্পানি আর ব্রিটিশ পার্লামেন্ট অভিন্ন ছিল না। যদিও ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কোম্পানির কাজের উপর নজর রাখত। কোম্পানির লক্ষ্য ছিল বাংলার মানুষের উপর শাসন চালিয়ে আর্থিক লাভের নিশ্চিতি বিধান করা। সেই কারণে তারা স্থানীয় রক্ষণশীল হিন্দু সম্প্রদায়ের সমাজপতিদের নিজেদের পক্ষে রাখার নীতি গ্রহণ করেন। ঠিক ওই কারণেই কোম্পানির পরিচালকগণ কেরিকে ধর্মপ্রচারকের কাজে বাধা সৃষ্টি করে শ্রীরামপুর কলেজ গড়ে তুলতে বাধ‍্য করেন। আবার ডিরোজিও হিন্দু সম্প্রদায়ের সমাজপতিদের বিরাগভাজন হলে ডিরোজিওকে সুরক্ষাদানে তাঁরা নিস্পৃহ নির্লিপ্ত ভাব অবলম্বন করেন।
এই এক‌ই কারণে কোম্পানি চায় নি প্রথাগতভাবে চলে আসা শিক্ষা পদ্ধতিতে বদল করে আধুনিক যুগের উপযোগী জ্ঞান বিজ্ঞান গণিত ভূগোল জ‍্যোতির্বিদ‍্যা ইত‍্যাদির পাঠক্রম চালু হোক।
সংস্কৃত ও ফারসি, এই দুই ভাষায় প্রথাগত শিক্ষা চালু রাখার মধ‍্যেই কোম্পানি স্বস্তিবোধ করত। রক্ষণশীল প্রাচীনমনস্ক সনাতনী ভারতের কিছুমাত্র বিপক্ষতা করার আগ্রহ কোম্পানির পরিচালকদের ছিল না। তার সামান্য রদবদল হল গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ( ১৪.০৯.১৭৭৪ – ১৭.০৬.১৮৩৯) এর আমলে।
ভারতে শীর্ষ প্রশাসক তথা গভর্নর জেনারেল হিসেবে ০৪.০৭.১৮২৮ থেকে ২০.০৩.১৮৩৫ অবধি দায়িত্ব পালন করেছেন উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক । তিনি ক্ষমতায় আসার বৎসর খানেকের মধ‍্যেই বেঙ্গল সতী রেগুলেশন, ১৮২৯ জারি করে সতীদাহ নিষিদ্ধ করা হয়।
ভারতে শীর্ষ প্রশাসক তথা গভর্নর জেনারেল হিসেবে ০৪.০৭.১৮২৮ থেকে ২০.০৩.১৮৩৫ অবধি দায়িত্ব পালন করেছেন উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক । তিনি ক্ষমতায় আসার বৎসর খানেকের মধ‍্যেই বেঙ্গল সতী রেগুলেশন, ১৮২৯ জারি করে সতীদাহ নিষিদ্ধ করা হয়। চার্লস মেটকাফ (৩০.০১.১৭৮৫ – ০৫.০৯১৮৪৬), পরবর্তীতে এক বৎসরের জন‍্য যিনি কাজ চালানো গভর্নর হয়েছিলেন, তিনি আশঙ্কা করেছিলেন সতীদাহের বিরুদ্ধে কোম্পানি কথা বললে ভারতীয়গণ ভীষণ ভাবে বিরোধিতা করবেন।
০৪.১২. ১৮২৯ তারিখে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করা হলে রক্ষণশীল গোঁড়াপন্থী ভারতীয় রা বেন্টিঙ্কের রেগুলেশনের বিরুদ্ধে প্রিভি কাউন্সিলে মামলা দায়ের করেন। তবে সতীদাহের মতো বর্বর প্রথার বিরুদ্ধে কাউন্সিল রায় দেন। প্রগতিশীল মানসিক গঠন সম্পন্ন উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের আরো গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কাজ হল, নরবলি রদ, কন‍্যাভ্রূণ হত‍্যা নিষিদ্ধ করা, এবং ঠগী দমন।
বেন্টিঙ্কের সময়ে, তাঁর শাসনের একেবারেই শেষের দিকে ১৮৩৫ সালের ২৮ জানুয়ারি তারিখে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল স্থাপিত হয়। আধুনিক চিকিৎসা বিদ‍্যায় গোটা এশিয়া মহাদেশের প্রথম মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা হয় পণ্ডিচেরীতে, কিন্তু ইংরেজি ভাষার মাধ‍্যমে আধুনিক চিকিৎসা বিদ‍্যাদান শুরু হয় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে। সাধারণ ভাবে কোম্পানি প্রশাসন এতদিন ধরে রক্ষণশীল গোঁড়াপন্থী ভারতীয়দের না চটাবার নীতি গ্রহণ করে সংস্কৃত ও ফারসি ভাষায় শিক্ষাদানের পক্ষে থাকলেও, উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এই সুবিধাবাদী অবস্থান মেনে নেন নি। তাঁর শাসনকালের শেষ বৎসরে ১৮৩৫ সালে তিনি ইংলিশ এডুকেশন অ্যাক্ট চালু করেন। এই কাজে তাঁর খুব বড় সহায় ছিলেন আরেক জন উচ্চশ্রেণির প্রশাসক টমাস ব‍্যাবিংটন মেকলে ( ২৫.১০.১৮০০ – ২৮.১২.১৮৫৯)।
মেকলে নিজের দেশে পার্লামেন্টে সদস‍্য ছিলেন। ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসবিদ স্কলার। ভারতে এসে তিনি কোম্পানির প্রশাসন চালনার উচ্চস্তরের সংস্থা বোর্ড অফ কন্ট্রোল এর সদস্য হন ও পরে এর সেক্রেটারি হন।
ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাদান সরকারের তরফে নীতি ও আইন হিসেবে গৃহীত হয়ে গেলে পড়াশুনা চর্চাভাবনা একটা সর্বভারতীয় চেহারা ও চারিত্র‍্য পেল।
এইপথে ১৭৫৭ তে ক্ষমতা দখলের পর ১৮৩৫ এ এসে ব্রিটিশ শাসকেরা আধুনিক চিন্তাভাবনার প্রতিফলন দেখাতে পারলেন। যাই হোক, যত দুর্বলতাই থাক, কোম্পানির শাসনেই আধুনিক শিক্ষা দীক্ষার সুযোগ ভারতে তৈরি হয়। মানবিক মূল্যবোধ প্রশাসনের অন‍্যতম পালনীয় নীতি হিসেবে গ্রাহ‍্য হয়। ইংরেজি ভাষা শিক্ষার মাধ‍্যম হিসেবে সরকারি সমর্থন লাভ করায় ভারতীয় অভিজাত ও উচ্চবিত্ত অংশ বিদেশি জ্ঞান বিজ্ঞান দর্শন গণিতের সন্ধান পান। এঁরা অনেকেই বিদেশে পাড়ি দিয়ে পড়াশুনা করে ব‍্যারিস্টার হয়েছেন, আইসিএস হয়েছেন। এই পথে দেশীয় লোকেদের মধ‍্য থেকে এক ধরনের মানুষ তৈরি হয়েছে, যাঁরা পেশার প্রয়োজনে উকিল, ব‍্যারিস্টার, সিভিল সারভেন্ট হয়ে দেশের নানা অংশে ছড়িয়ে পড়েছেন এবং এরা ইংরেজি ভাষায় শিক্ষিত হ‌ওয়ার কারণে মতপ্রকাশের একটা সুচারু বন্দোবস্ত হয়ে গেছে। অর্থাৎ ইংরেজ শাসনে দাসত্বের গভীর তলে দাসত্বমুক্তির শর্ত হিসাবে শিক্ষা, মতবিনিময় ও পারস্পরিক যোগাযোগের সাথে অতীত গৌরবের পুনরুজ্জীবন মিলেমিশে একটা নবীন জাতিগঠনের প্রক্রিয়া চলেছে। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে বিপরীত বস্তুর সহাবস্থান বা ইউনিটি অফ অপোজিটস বলে ধারণা আছে। ইংরেজ শাসনে উপরে উপরে দাসত্বের কঠোর বন্ধনের নিচের তলায় দাসত্বমুক্তির আয়োজন তার‌ই উদাহরণ বলে মনে করি।
এক‌ইসাথে প্রাচীন ভারত সম্পর্কে শ্রদ্ধাপূর্ণ পড়াশুনা এবং আধুনিক শিক্ষার সুযোগ যাঁদের মধ‍্যে সঞ্জীবিত হয়েছিল, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ‍্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং স্বামী বিবেকানন্দ তাঁদের মধ্যে অন‍্যতম। প্রাচীন ভারতে মানবাধিকার এবং ইহমুখী পার্থিব দৃষ্টিভঙ্গি অচেনা ছিল। (তা থাকাটাই স্বাভাবিক। কেননা, এই ধারণাগুলি ইতিহাসের একটা পর্যায়ে গড়ে উঠেছে। ) বিদ‍্যাসাগর মহাশয় তাঁর সীতার বনবাস এবং শকুন্তলা গ্রন্থে পাঠকের হৃদয়ে পরিচিত কাহিনির অনুষঙ্গে নারীজীবনের প্রতি সহমর্মিতা গড়ে তুললেন। এ জিনিস প্রাচীনকালে অজানা ছিল।
সে যুগের রাজা তার প্রজাদের কাছে ভাল সাজতে চেয়ে গর্ভবতী বধূকে বনবাসে পাঠাতে পেরেছে। জুয়ায় হেরে গিয়ে কুলবধূকে জনসমক্ষে লাঞ্ছিত হতে দিতে বাধা দেয় নি। বিবাহ করার পর পছন্দের নারীকেও ভুলে যেতে অসুবিধা বোধ করে নি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ‍্যাসাগর মহাশয় এই গল্প কাঠামো ব‍্যবহার করে তাতে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির বীজ বপন করলেন। সীতার আহত মন, শকুন্তলার প্রতারিত হ‌ওয়া পাঠকের মনকে ছুঁয়ে গেল। আগেও তো রামায়ণ পড়া হয়েছে। গানে কথকতায় রামকথা সাধারণ ভারতীয়ের কণ্ঠস্থ। বিদ‍্যাসাগরের লেখায় পাঠক একটু হলেও নাড়া খেল। সীতাকে গর্ভবতী অবস্থায় দূর করে দিয়েছিলেন রাম। গর্ভবতী শকুন্তলাকে আশ্রয়ভিক্ষা করতে দেখে উপহাস করেছিলেন দুষ‍্যন্ত।
দুর্বলকে রক্ষা করার দায় ছিল রাজার। যে রাজা সবলের অপরাধে দুর্বলকে নিপীড়ন করে, সে হেয়। আর যে রাজা নিজে সহজ সরল আশ্রমবালিকাকে নিয়ে যৌনতার খেলা খেলে তাকে ভুলে যেতে চায়, সে রাজা হলেও আসলে শঠ, প্রবঞ্চক, প্রতারক।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের কলমে রামায়ণী কথা আরো বড় রকম বাঁক নিল। সেখানে ইন্দ্রজিৎ দেশপ্রেমিক মহানায়ক, লক্ষ্মণ কুচক্রী অনুপ্রবেশকারী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কর্ণকুন্তী সংবাদে কর্ণের অত‍্যুচ্চ মহত্ত্বপরায়ণ ছবি আঁকলেন। গান্ধারীর আবেদনেও অন‍্য মাত্রা আনলেন। এ সব‌ই রামায়ণ মহাভারত থেকে নেওয়া চরিত্রগুলির নবনির্মাণ।
কিন্তু এই নির্মাণে র‌ইল পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবজনিত মূল‍্যবোধের স্পর্শ। মনে রাখা দরকার উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের আগে কোনো গভর্নর জেনারেল একসাথে সতীদাহ, কন‍্যাভ্রূণ হত‍্যা, নরবলি, ইংরেজি মাধ‍্যম শিক্ষা আর মেডিক্যাল কলেজের ভাবনা বাস্তবায়িত করে উঠতে পারেন নি। তিনিই পশ্চাৎপদ চূড়ামণি হিন্দু রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাহস করলেন। রামমোহন বিদ‍্যাসাগরকে এক এক পা অগ্রসর হতে গিয়ে হিন্দু সমাজপতিদের গোঁড়ামির ভয়ঙ্কর আঘাতের সম্মুখীন হতে হয়েছে।
কোম্পানির শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বের কার্যকরী সমর্থন থাকায় গোঁড়াদের সঙ্গে টক্কর দেওয়া গেল। কোম্পানি প্রশাসন সদর্থক ও গঠনমূলক ভূমিকা নিতেই সুফল ফলতে লাগল। যুগের দাবিকে বাস্তবায়িত করা সহজ হল। তাই সমাজকে পরিশুদ্ধ করতে শাসকের তরফে শুদ্ধ ও সদর্থক ভূমিকা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কয়েকটি কবিতার সূত্রে রাজনৈতিক ক্ষমতাবিন‍্যাস, প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব‍্যবস্থা, ও ন‍্যায়বিচার, যা ছিল যুগের দাবি, তাকে কবিতায় চিত্রায়িত করার চেষ্টা নিয়ে লিখতে চাইছি।


সামান্য ক্ষতি
নিরপেক্ষ ও নৈর্ব্যক্তিক রাজশাসন বলতে ঠিক কি বোঝায়, “সামান্য ক্ষতি” কবিতায় তা নিয়ে ইঙ্গিত দেন রবীন্দ্রনাথ। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ২৫ আশ্বিন তিনি কবিতাটি লিখেছেন। কাশীরাজের রাণী করুণা সখীদলবল সমভিব‍্যাহারে বরুণা নদীতে স্নান করতে গিয়েছিলেন। সেই স্নানের সময় যাতে রাণী ও তাঁর সঙ্গিনীদের আব্রু ও সম্ভ্রম কোনোভাবেই না বিপন্ন হয়, সেজন‍্য বরুণা নদীতীরবাসী নাগরিকদের সকাল বেলার জন‍্য এলাকা ত‍্যাগ করে অন‍্যত্র থাকতে বলা হয়েছিল। একজন রাণীর আব্রু রক্ষা র দায় তাঁর পরিচারিকাদের। কিন্তু সেজন‍্য সাধারণ মানুষকে নিজের নিজের কুটির ছেড়ে দূরে সরে থাকতে হল। প্রজাদের এইটুকু বিড়ম্বনায় ফেলেই রাণী করুণা সন্তুষ্ট থাকতে চাইলেন না।
স্নানের পর তিনি গা হাত পা সেঁকবেন বলে আগুন চাইলেন। কাঠকুটো যোগাড়ের চাইতে একটা কুটিরে আগুন লাগানো সুবিবেচনার পরিচয় মনে হল রাণীর। কুটিরে আগুন লাগানোর প্রস্তাবের বিপক্ষে একটি পরিচারিকা বক্তব্য রেখেছিল। কিন্তু তার যুক্তিপূর্ণ মানবিক আবেদন রক্ষিত হয় নি। বরং তাকে রাণী কটু মন্তব্যে বিঁধেছিলেন।
যাইহোক, একটি কুটিরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলে খানিকটা সময় পরে “গোটা গ্রামখানি লেহিয়া ল‌ইল প্রলয়লোলুপ রসনা”।
গৃহহারা বিপন্ন প্রজারা রাজসকাশে গিয়ে এহেন কুকর্মের বিরুদ্ধে সুবিচার চেয়েছিল।
রাণী স্নানলীলা সেরে ফিরলে সর্বসমক্ষে তাঁকে ডাকিয়ে আগুন লাগানোর কৈফিয়ত তলব করেছিলেন রাজা। রাজা জানতে চেয়েছিলেন, এরকম ব‍্যবহার তিনি করলেন কেন। দম্ভ ভরে রাণী বলেছিলেন, গরিবের প্রাণের ও সম্পত্তির কোনো মূল‍্য আছে বলেই মনে করেন না তিনি। অহমিকায় স্ফীত হয়ে রাণী আরো বললেন, রাজমহিষীর প্রমোদের পক্ষে এই গ্রাম ধ্বংসের মূল‍্য যৎসামান্য। রাণীর এই প্রগলভতায় রাজা অত‍্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে দণ্ড দিলেন জীর্ণ ছিন্ন বসন পরে ঘরে ঘরে ঘুরে ভিক্ষা করে রাণীকে এই ক্ষতিপূরণের অর্থ সংগ্রহ করে দিতে হবে। সময়সীমা দিলেন একবৎসর। রাজপরিবারের সদস্য বা ক্ষমতাবৃত্তে থাকা মানুষজনের সঙ্গে নিম্নকোটির জনগণের আদর্শ সম্পর্কবিন‍্যাসটি কি, তা স্পষ্ট করেন কবি। আজকের পৃথিবীতে উন্নয়নের নাম করে দরিদ্র, প্রান্তিক ও সংখ‍্যালঘুকে উচ্ছেদ একটা বাস্তব ঘটনা। গণতান্ত্রিক ব‍্যবস্থা আইনের চোখে সকলের সমান সুযোগ নিশ্চিত করে এবং দরিদ্র মানুষের সম্পত্তি রক্ষা, ও বিপর্যয় মোকাবিলায় ত্রাণ দেওয়া রাষ্ট্রীয় কর্তব‍্য বলে নির্দেশ করে। কথা ও কাহিনীর নানা কবিতায় এইভাবে রাষ্ট্রনীতি ও জনপ্রশাসনের ভারসাম‍্যমূলক পরিচয় রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরতে থাকেন।


প্রতিনিধি
১৩০৪ বঙ্গাব্দের ৬ কার্তিক, ১৮৯৭ সালের অক্টোবর মাসে মারাঠী গাথার ইংরেজি অনুবাদ গ্রন্থ থেকে তথ‍্যসংগ্রহ করে মারাঠা বীর শিবাজি ও তাঁর গুরু রামদাসের জীবন অবলম্বনে “প্রতিনিধি” নামে একটি কবিতা লেখেন রবীন্দ্রনাথ। গল্পাংশটি এ রকম: নিজের আধ‍্যাত্মিক গুরু রামদাসকে নগরীর দ্বারে দ্বারে অন্ন যাচ্ঞা করতে দেখে রাজা হিসেবে শিবাজির আত্মসম্ভ্রমে লাগে এবং গুরু রামদাসকে তিনি রাজক্ষমতা ও রাজত্ব অর্পণ করেন।
এরপর গুরু তাঁকে নির্দেশ দেন, শিবাজি যেন ভিক্ষুকের প্রতিনিধি হিসেবে রাজ‍্যশাসন করেন। শিবাজির রাজধর্ম হবে গুরুর প্রতিনিধি হিসেবে কৃত‍্য। রাজ‍্য নিয়েও তিনি রাজ‍্যহীন থাকবেন। সত‍্য মিথ‍্যা যাই হোক, আদর্শ হিসাবে এটি অনন্য। প্রকৃত গণতন্ত্রে শাসন ক্ষমতার শীর্ষে যিনি থাকেন, তিনি জনগণের প্রতিনিধি, নিয়মের দ্বারা চালিত আর জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। এর সাথে আরো শর্ত থাকে, তিনি ব‍্যক্তিগত লাভ ও সুবিধার দিকে চেয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিচালনা করবেন না। পদে থাকাকালীন অন‍্যত্র লাভজনক স্বার্থে জড়াবেন না। এবং তাঁর ক্ষমতা বংশপরম্পরায় প্রবাহিত হবে না। এই সবকটিই আধুনিক ধারণা, এবং গণতন্ত্র আসার আগে ভারতে শাসকদের মধ‍্যে এ ধরনের মানসিক গঠন খুঁজে পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু পরাধীনতার নাগপাশ থেকে যে দেশ ও জাতি মুক্তি পেতে চাইছে, তার নবীন রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষে যিনি থাকবেন, তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশাটি আমরা প্রতিনিধি কবিতায় দেখতে পাই।

বিচারক
১৩০৬ সালের ৪ অগ্রহায়ণ তারিখে “বিচারক” নামে একটি কবিতা লেখেন রবীন্দ্রনাথ। এই কবিতার গল্পাংশ তিনি সংগ্রহ করেছেন দুটি উৎস থেকে। একটি পণ্ডিত শম্ভুচন্দ্র বিদ‍্যারত্নের “চরিতমালা”, অন‍্যটি অ্যাক‌ওয়ার্থ সাহেবের “ব‍্যালাডস অফ দি মারাঠাস” ইংরেজি গ্রন্থ থেকে মারাঠা গাথা সংগ্রহ করে, তার কাহিনী ভাগ ব‍্যবহার করেছেন।
“বিচারক” কবিতায় মহীশূরের হায়দর আলির বিরুদ্ধে পেশোয়া রাজা রঘুনাথ রাও যুদ্ধ ঘোষণা করেন। কেন যুদ্ধ, যুদ্ধের মাধ‍্যমে ঠিক কি সমাধান হবে, যুদ্ধের কোনো বিকল্প আছে কি না, যুদ্ধের ফলে রাষ্ট্রকে শেষপর্যন্ত কতটা মূল‍্য দিতে হবে, এ সমস্ত ভেবে দেখার মতো কোনো নিরপেক্ষ ও স্বাধীন অস্তিত্ববান কোনো সংস্থা পেশোয়ার রাজ‍্যে নেই। রাজার এসব ভাবার দরকার ও শিক্ষা কোনোটাই নেই। মারাঠা জাত‍্যভিমানকে কাজে লাগিয়ে পেশোয়া রঘুনাথের এই যুদ্ধ প্রচেষ্টা। মহারাষ্ট্রের প্রত‍্যন্ত অঞ্চল থেকে মারাঠী অস্মিতার নামে আশিহাজার যোদ্ধার বাহিনী গড়ে উঠল। এই বিপুলসংখ্যক সৈন‍্যের দাপটে পেশোয়ার অহংকারও আকাশ ছুঁল।
পেশোয়া একজন বর্ণহিন্দু, মহীশূরের হায়দর আলি একজন মুসলমান। বিপক্ষের শাসক ধর্মপরিচয়ে মুসলমান বলেই এ যেন পেশোয়ার তরফে এক ধর্মযুদ্ধ। ধর্মযুদ্ধের প্রধান উপাদান উন্মাদনা। ধর্মযুদ্ধে জিতলেও লাভ, হারলেও লাভ। জিতলে ইহলৌকিক সম্পত্তি লুঠ করে ফুলে ফেঁপে ওঠার সুযোগ। হারলে সটান স্বর্গলাভ। সেখানে অক্ষয় সুখভোগের ব‍্যবস্থা।
বিচারক কবিতায় মারাঠাদের সর্বোচ্চ শাসক পেশোয়া রঘুনাথ রাওয়ের এই ধর্মযুদ্ধের উন্মাদনাকে ধাক্কা দিলেন ব্রাহ্মণ রামশাস্ত্রী। কিন্তু কে এই রামশাস্ত্রী, আর কিভাবেই বা তিনি ধর্মযুদ্ধের উন্মাদনাকে ধাক্কা দেবার সাহস করলেন? রামশাস্ত্রী বাস্তবে একজন গ্রামের মানুষ, ব‍্যক্তিজীবনে একজন দীন দরিদ্র ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। কিন্তু তিনি মারাঠা সাম্রাজ্যের ন‍্যায়াধীশ, অর্থাৎ সর্বোচ্চ বিচারক।
স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে রাজা নিজেকে সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান এবং সকল প্রশ্নের ঊর্ধ্বে ভাবেন।
কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্রে শাসক আইনের বাঁধনে পরিচালিত হন। প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্র গড়ে ওঠে। একজন নাগরিককে জনপ্রতিনিধি হবার আগে সাধারণ মানুষের কাছে ভোট চাইতে যেতে হয়। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচনে তাঁদের মধ‍্য থেকে একজন সর্বোচ্চ শাসক বাছাই করা হয়। একটা সময়সীমা মেনে আবার ভোটে গিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন। অর্থাৎ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে শাসকের তরফে নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিভূ বলে ঘোষণা করবার সুবিধা নেই। প্রশাসন চালায় মন্ত্রিসভা। মন্ত্রিসভা আবার আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকে। মন্ত্রিসভার কাজকর্ম নিয়ে আইনসভায় প্রশ্ন তোলা যায়। বিচার বিভাগের আলাদা অস্তিত্ব থাকে। মন্ত্রিসভার নেতৃত্বে গোটা প্রশাসন ও আইনসভা সংবিধানের রীতিপদ্ধতি সারবস্তু অনুযায়ী কাজ করছেন কি না, তা লক্ষ করার একতিয়ার থাকে বিচার বিভাগের। সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারকে সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে কি না, তা নজরদারির দায়িত্ব থাকে বিচার বিভাগের হাতে। সর্বোচ্চ শাসক‌ও সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস‍্যের কাছে দোষী প্রমাণিত হলে ইমপিচমেন্টের ব‍্যবস্থা আছে। ওই এক‌ই ইমপিচমেন্ট পদ্ধতির মধ‍্য দিয়ে বিচারপতিদেরকেও অপসারিত করা চলে।
কিন্তু রাজতন্ত্রে রাজা খুশি মতো ব‍্যক্তিকে বিভিন্ন পদ বিতরণ করেন। তাঁর ব‍্যক্তিগত খেয়াল খুশির উপরেই রাজ‍্যের বড় বড় পদে লোকনিয়োগ হয়, ও অপছন্দের কারণ ঘটলেই বিনাবাক‍্যব‍্যয়ে তাদেরকে অপসারিত করা চলে। আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার আগে রাজতান্ত্রিক পরিবেশে রাজার খেয়াল খুশিই ছিল রাষ্ট্রের পরিচালনানীতি, রাজার প্রয়োজনই ছিল রাষ্ট্রের প্রয়োজন। রাজার সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টির পলে বড় বড় পদে নিয়োগ বা অপসারণ চলত। অনেক সময় রাজাকে ঘিরে একদল অতিরিক্ত সুবিধাপ্রাপক মণ্ডলী গড়ে উঠত। এই অতিরিক্ত সুবিধাপ্রাপকের দল একযোগে অনেক সময় রাজাকে চালনা করত। একে বলা হত অভিজাততন্ত্র। যাই হোক, বিচারক কবিতার ব্রাহ্মণ পণ্ডিত রামশাস্ত্রী মারাঠা সাম্রাজ্যের ন‍্যায়াধীশ হলেও আসলে তাঁর নিয়োগ ও অপসারণের সমস্ত একতিয়ার ছিল রাজার হাতে। তবুও এই ন‍্যায়াধীশ রামশাস্ত্রী পেশোয়ার যুদ্ধোন্মাদনায় বাধা দিলেন, এবং একটা গভীর মৌলিক আইনগত প্রশ্ন তুলে দিলেন। ন‍্যায়াধীশ রামশাস্ত্রী পেশোয়ার রাজক্ষমতার বৈধতা আর আইনসিদ্ধতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে তাঁকে অভিযুক্ত করলেন।রঘুনাথের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি আপন ভ্রাতুষ্পুত্রকে বধ করে রাজক্ষমতা আত্মসাৎ করেছেন। সেকালের প্রেক্ষিতে এটা যে খুব একটা অজানা বিষয় ছিল তা কিন্তু নয়। সুলতানি আমলে ও মোগল আমলে অনেকেই এইভাবে অসির জোরে, বা গুপ্তহত্যার পথে ক্ষমতা হাসিল করেছেন। কিন্তু প্রকৃত গণতন্ত্রে গায়ের জোরে, বা খুন করে শাসনের আইনি অধিকার কেড়ে নেওয়া যায় না। গণতন্ত্রে বাহুবল নয়, সংবিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা চলে। ভোটে জিতে জনসমর্থন অর্জন করে তবেই শাসনক্ষমতায় বসা চলে। সেই শাসনকেও আবার আইন নির্দিষ্ট পথেই পরিচালিত হতে হয়। কিন্তু রামশাস্ত্রীর সপক্ষে আইনি প্রক্রিয়ার এত বড় একতিয়ার ছিল না। তিনি আগে থেকে ওই ন‍্যায়াধীশ পদে বৃত ছিলেন। এবং তাঁর মনে এটাও ছিল যেভাবে ভ্রাতুষ্পুত্রকে বধ করে রঘুনাথ রাও পেশোয়া হলেন, তা আইনের চোখে গর্হিত দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু শুধু তার বলেই নতুন পেশোয়াকে তিনি কারারুদ্ধ করাতে পারেন নি। তবে বিচার প্রক্রিয়ার একটা সূচনা যে হয়েছিল, তার সূক্ষ্ম ইঙ্গিত কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিয়ে রেখেছেন। এখন ভ্রাতুষ্পুত্র বা ভ্রাতা বা পিতাকে পিতৃব‍্যকে বধ করে শাসন ক্ষমতা দখল সে যুগে একটা চালু রীতি হলেও তা সামাজিক পরিসরে সম্মানীয় ছিল না। জ্ঞাতিরক্তপাত মানবসমাজে হেয় ও নিন্দনীয় ছিল বহুদিন ধরেই। সুতরাং রঘুনাথের তরফে ভ্রাতুষ্পুত্র হত‍্যাজনিত অপরাধের বিচার করতে হবে। সে বিচার করবেন ন‍্যায়শাস্ত্রী। রঘুনাথ রাও তা জানে। আর জানে বলেই ধর্মযুদ্ধের উন্মাদনা ছড়িয়ে অতীতকে অস্পষ্ট করে দিতে চায়। শাসকদের ওই এক চাল। যখনই তার কর্তৃত্ব কোনোভাবে কোনো প্রশ্নচিহ্নের সামনে, তখন তার অজুহাত হল ধর্মযুদ্ধ। এই যুদ্ধে জিততে পারলে অতীতের সমস্ত কলঙ্ক মুছে ফেলা যায়। তাই নতুন পেশোয়া বেশ আটঘাট বেঁধেই ধর্মযুদ্ধের জিগির তুলেছেন। আর ন‍্যায়শাস্ত্রী প্রশ্ন তুললেন ওই জায়গাটা লক্ষ করেই। তিনি বললেন, ধর্মযুদ্ধের আহ্বান সে দিতে পারে, যে অপরাধে অভিযুক্ত নয়। কিন্তু রঘুনাথ রাও নিজের ভ্রাতুষ্পুত্রকে হত‍্যার অভিযোগে অভিযুক্ত। এবং এই হত‍্যাকাণ্ড ঘটানোর অভিযোগ থেকে মুক্তি না পেলে, এইরকম ধর্মযুদ্ধের নেতৃত্ব দেবার নৈতিক অধিকার তাঁর নেই। ভ্রাতুষ্পুত্রকে হত‍্যার দায়ে অভিযুক্ত হবার কারণে রঘুনাথ রাওয়ের শাসনের একতিয়ারটাই বিচারাধীন রয়েছে। রঘুনাথ আপাততঃ ছাড়া থাকলেও, যতদিন না বিচার সমাধা হচ্ছে, এবং যতক্ষণ না আইনের চোখে নিরপরাধ বলে প্রমাণিত হচ্ছেন, ততদিন রঘুনাথ রাওয়ের আপন মর্জিতে চলাফেরার একতিয়ারটাই নেই। এই হল ন‍্যায়াধীশের বক্তব্য।
আশি হাজার নতুন উন্মত্ত সৈন‍্যের বলে বলীয়ান রঘুনাথ রাও জানেন, গণতন্ত্রের পরীক্ষা দিয়ে তাঁকে রাজ সিংহাসনে বসতে হয় নি। তিনি ক্ষমতা দখল করেছেন অসির ঝনৎকারে। সেই অহংকার থেকে রাম শাস্ত্রীর ন‍্যায়ের বিধানকে চ‍্যালেঞ্জ জানান নৃপতি রঘুনাথ রাও। তিনি বললেন, নৃপতি কারো বাঁধন, এমনকি আইনের বাঁধন পর্যন্ত মানেন না। যেন বিচারপতিকে মনে করিয়ে দিতে চাইলেন, স্বৈরতান্ত্রিক ব‍্যবস্থায় আইনকে মানা হবে কি না, মানলে কতটুকু মানা হবে, তা শাসকের খুশির উপর নির্ভর করে।
রঘুনাথ রাওয়ের দম্ভোক্তির একটা কঠিন জবাব দিলেন ন‍্যায়াধীশ রাম শাস্ত্রী। তিনি বিচারপতির আসন থেকে পদত্যাগ করলেন সেই মুহূর্তে। পদগৌরব ছেড়ে দিয়ে, রাজপ্রদত্ত সব সম্মান সম্পদ অবহেলায় পরিত্যাগ করে দীন দরিদ্রের মতো তিনি গ্রামের কুটিরে ফিরে গেলেন।
এর ভিতরে একটা সূক্ষ্ম ব‍্যঙ্গ ভরে দিয়েছেন কবি। রাজার বিচারশালাকে তিনি খেলাঘর হিসেবে চিনিয়ে দিয়েছেন। এই বিচারশালায় শুধুমাত্র দুর্বলের শাস্তিবিধান হয়। সবলকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ক্ষমতা এই বিচারশালার নেই। তাই এ একটা খেলাঘর। স্বৈরতান্ত্রিক ব‍্যবস্থায় বিচারপতির মর্যাদাও ওই মাপের।

দীনদান
১৩০৭ বঙ্গাব্দের ২০ শ্রাবণ, কাহিনী কাব‍্যগ্রন্থে “দীনদান” নামে একটি কবিতা পাই। বিশিষ্ট সাধু নরোত্তম রাজ‍্যে এসে রাজপ্রতিষ্ঠিত স্বর্ণমন্দিরে আশ্রয় না নিয়ে, পথপ্রান্তে গাছের ছায়ায় বসে নামসংকীর্তন করছেন, আর তাঁর পুণ‍্য সংস্পর্শের টানে
নরনারী নির্বিশেষে অসংখ্য ভক্ত জুটেছেন। রাজার কাছে এই খবর পৌঁছাতে রাজা নিজে এসে সাধুকে অনুরোধ করলেন তাঁর স্বর্ণমন্দিরে অবস্থান করতে। কিন্তু রাজাকে চকিত করে স্বর্ণমন্দিরে দেবতা নেই ঘোষণা করে সাধু নরোত্তম বললেন, প্রজাকে দুর্দিনে বঞ্চিত করে অনাহারে রেখে স্বর্ণমন্দির তৈরি করা হয়েছে। ওটা কোনো দেবমন্দির নয়, ও আসলে রাজার দম্ভের নিদর্শন। প্রকৃত ভক্ত রাজার এই দম্ভকে এড়িয়ে চলে।
সাধু নরোত্তমের স্পষ্ট ভাষণে রাজা বিরক্ত হন। এবং ক্রোধ প্রকাশ করে কুবাক‍্য বলে সাধুকে রাজ‍্য থেকে বিতাড়িত করেন।
যত্নশীল পাঠকের নজরে পড়বে দীনদান কবিতার রাজা রাজ‍্যের সংবাদ সংগ্রহের জন্য বেতনভুক ভৃত‍্য রেখেছেন। আর সাধু নরোত্তম যে মন্দিরে না ঢুকে পথপ্রান্তে গাছতলায় আশ্রয় নিতে ওইখানেই ভক্তরা ছুটেছে, পথের ধূলায় বসেই নরোত্তম প্রজাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে নিচ্ছেন, তা গোয়েন্দারা রাজার কানে তুলেছে। রাজা দৌড়ে এসেছেন সরেজমিনে পরিস্থিতির গভীরতা যাচাই করতে।
রাজক্ষমতা বজায় রাখার অন‍্যতম অঙ্গ গুপ্তচরি ব‍্যবস্থা সক্রিয় রাখা, এবং যে কোনো তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা, যা কিনা রাজার কর্তৃত্বকে কিছুমাত্র ক্ষুণ্ন করে, সেখানে জিরো টলারেন্স দেখিয়ে হস্তক্ষেপ করে। যত্নশীল পাঠক আরো লক্ষ করবেন, স্বর্ণমন্দিরে আশ্রয় না নিয়ে, রাস্তার ধারে বসে থেকেই জনতাকে আকৃষ্ট করায় নরোত্তম সাধু রাজার ক্ষোভ উৎপাদন করে ফেলেছেন। রাজার মন্দিরে বসে নরোত্তম ভক্তদের আকৃষ্ট করলে রাজা তাকে বিপজ্জনক ঠাউরাতেন না। প্রতিষ্ঠিত ব‍্যবস্থা য় তাতে আঁচড়টি পড়ত না। এই যে রাজমন্দিরের প্রাতিষ্ঠানিক গুরুত্ব কে অস্বীকার করে পথেধূলায় বসে নরোত্তম জনসংযোগে গুরুত্ব দিচ্ছেন, এতে রাজা বিপন্ন বোধ করছেন। নরোত্তমের আচরণকে ক্ষমতার ভরকেন্দ্রের প্রতি একটা চ‍্যালেঞ্জ বলে রাজা গণ‍্য করছেন। তার উপর নরোত্তম যখন স্পষ্ট ভাষায় রাজার সামনে উচ্চারণ করছেন, তথাকথিত স্বর্ণমন্দিরে দেবতা নেই, তখন রাজা তাঁকে সন্ন‍্যাসী জেনেও নাস্তিক বলে গালি দিচ্ছেন।
সন্ন‍্যাসী নরোত্তমের হারাবার কিছু নেই। কেন না, রাজশক্তির কাছে, প্রতিষ্ঠিত ব‍্যবস্থার কাছে তাঁর কোনোরকম চাহিদা নেই। আর তিনি যথার্থ সন্ন‍্যাসী, মৃত‍্যুভয় থেকে মুক্ত। এছাড়া তিনি জানেন, প্রজাদের অগ্নি দুর্ঘটনার দিনে রাজা তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে, তাদের অন্নসংস্থানের কথা না ভেবে, বিস্তর অর্থব‍্যয়ে স্বর্ণমন্দির বানানোর উদ‍্যোগ নিতে প্রজাদের মধ‍্যে রাজার গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে।
রাজা যে প্রজার দুর্দিনে প্রজার অন্নসংস্থানের চেষ্টা করেননি, তা প্রজার বিবেচনায় তাঁর রাজোচিত উচ্চতাকে খাটো করে দিয়েছে। প্রজারা জানে, রাজা তাদের বিষয়ে সংবেদনশীল নন,
প্রজার প্রতি রাজার কর্তব‍্যে ঘাটতি রয়েছে, এটা বিস্তর প্রজা জানে, বোঝে ও বিশ্বাস করে, আর এইসূত্রে জনমত রাজার বিপক্ষে রয়েছে।
এই তথ‍্য সাধু নরোত্তম জেনে ফেলেছেন। তিনি বুঝে গিয়েছেন যে, এ রাজা শুধুমাত্র লাঠিবাজি করে রাজত্বে আসীন, প্রজার হৃদয়ে এর কোনো স্থান নেই।
এইকথা জেনে ফেলেছেন বলেই সাধু নরোত্তম নিশ্চিন্তে শান্ত সংহত কণ্ঠে বলতে পেরেছেন, রাজার স্বর্ণমন্দিরে দেবতা নেই। এমনকি রাজার সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক করে যেতেও পিছপা হন না সাধু।
নরোত্তমের আচরণে রাজা সবার প্রথমে ক্ষুব্ধ। তারপরে সাধুর বক্তব্যে রুষ্ট। আর ব‍্যঙ্গবচনে রাজা ভ্রূকুঞ্চিত, এবং জনপ্রিয়তার প্রশ্নে রাজাকে চ‍্যালেঞ্জ জানালে, রাজা তীব্র রাগে জ্বলে উঠে সাধুকে রাজ‍্যছাড়া করার ব‍্যবস্থা করেন। এই দণ্ড সাধু ততোধিক শান্তভাবে গ্রহণ করে রাজাকে বললেন, তুমি ঈশ্বরকে যেখানে নির্বাসন দিয়েছ, আমাকেও সেইখানে নির্বাসন দাও।
কলমের আঁচড়ে কবি দেখান, প্রজার থেকে রাজস্বটুকু আদায় করেই রাজার কর্তব‍্য শেষ হয় না। রাজার দায়িত্ব হল, বিপর্যয়ের সময়ে প্রজাকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করা। যত্নশীল পাঠক লক্ষ করবেন, যে রাজা প্রজাকে অভুক্ত রাখতে অন্তরে বাধা পায় না, সেই রাজা রাষ্ট্রীয় তহবিল হতে লক্ষ কোটি টাকায় মন্দির বানায়। প্রজাকে বঞ্চিত করে মন্দির বানানোর রাজনীতিকে কবি মুখোশহীন করে দেখান। এই ধরনের রাজনীতির লক্ষ্য যে আসলে দম্ভপ্রদর্শন, সেটা বলতেও কবির বাধে না। একজন দাম্ভিক অহংসর্বস্ব শাসক সমালোচনাকে ভীষণরকম অপছন্দ করেন। প্রশ্ন তুললেই তাকে শত্রু ঠাউরে বসেন এ ধরনের রাজা। তাঁর রাজনীতির নোংরা চেহারাটা বেআব্রু হয়ে গেলে যে তেমন প্রশ্ন তোলে, তাকে নাস্তিক বলতে রাজা দ্বিধা করেন না। কেননা দাম্ভিক চূড়ামণি রাজা নিজেকেই ঈশ্বরের প্রতিভূ বলে প্রচার করেন। দিল্লীশ্বরোবা জগদীশ্বরোবা। ধর্ম রাজার পকেটের জিনিস। কে ধার্মিক, তা রাজা মার্কা মেরে ঠিক করে দেবেন। আর রাজার কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুললে নাস্তিকের তকমা জুটবে।
সাধু জানে ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ। মানুষের কল‍্যাণসাধনাই যে ধর্মের প্রকৃত লক্ষ‍্য ও উদ্দেশ‍্য হ‌ওয়া উচিত, তা সাধু স্পষ্ট ভাবে বলেন। আরো বলেন, স্বর্ণমন্দির রাজার দর্পের প্রতীক। এই দর্প আসলে কেমন, আর তার স্থায়িত্ব কতটুকু, তাও কবি কলমের মুন্সিয়ানায় ধরিয়ে দিয়েছেন। তাকে সমুদ্রের ফেনার মতো আর বুদবুদের মতো বলে এই মন্দির বানানোর অসারতাটি সাধু চিনিয়ে দেন। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব‍্যবস্থায় সুবিচারের কোনো জায়গা নেই। নিরপেক্ষ বিচার সেখানে কল্পনা মাত্র, আইননির্দিষ্ট পদ্ধতি বলে সেখানে কিছু নেই। সন্ন‍্যাসীর বিরুদ্ধে রাজাই অভিযোগকারী আর রাজা নিজেই বিচারক। বিচার ব‍্যবস্থা এখানে রাজার হাতের তালুর মধ‍্যে। তাই সন্ন‍্যাসীর বিরুদ্ধে নিজের অভিযোগের বিচার তিনি নিজেই করে, শাস্তি বাক‍্য উচ্চারণ করছেন, রাজ‍্য ত‍্যাগ করার নির্দেশ দিচ্ছেন। প্রকৃত গণতন্ত্রে আইনবিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের পৃথক পৃথক স্বাধীন ও অলঙ্ঘনীয় অস্তিত্ব থাকে। আদর্শ গণতন্ত্রে একে অপরের ক্ষেত্রাধিকার লঙ্ঘন না করার সুচারু ব‍্যবস্থা থাকে। কিন্তু স্বৈরশাসন ব‍্যবস্থায় বিচারশালা একনায়কের পকেটের জিনিস। ফ‍্যাসিস্টরা আজ্ঞাবহ বিচার ব‍্যবস্থা গড়ে তুলে এক সর্বগ্রাসী রাষ্ট্র গড়ে তোলে।
একটা স্বাধীনতা পেতে চলা দেশ অতীত ইতিহাস এবং পারিপার্শ্বিক থেকে কিভাবে শিক্ষা নিয়ে এগোবে, সেই দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্গুলিনির্দেশ করতে থাকেন।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।