সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৩১)

আমার কথা
১২১
যে দেশে নিয়মিত ভোট হয়, মিলিটারি কর্তৃপক্ষ ক্ষমতা দখল করে নেয় নি, যে দেশে বহু সংখ্যক রাজনৈতিক দল ভোটে দাঁড়াতে পায়, আর তাদের প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে আইনসভায় যেতে পায়, সে সভায় কথা বলতে পায়, যে দেশে সুপ্রিম কোর্ট আছে ও রিট পিটিশন করা যায়, সেখানে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু আছে। যে দলগুলি ভোটে দাঁড়ায়, ভোটে জিতলে সরকারে যায়, আর সে রকম সরকারে গিয়ে দশকের পর দশক বারে বারে নির্বাচিত হয়ে আসতে পারে, সে রকম দলের দায়িত্ব থাকে, যে দেশের সরকার চালানোর দায়িত্বে তারা বছরের পর বছর ছিল, সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটিকে অক্ষুণ্ণ রাখা। নইলে তাদের নিয়মিত ভোটে দাঁড়ানো, ও ভোটে জিতলে সরকার গড়তে যাবার কোনো মানে নেই। আন্দোলন যদি তাকে করতেই হয়, তা পরিচালনা করতে হবে শান্তির পথে। কোনো রকম ধাক্কাধাক্কির পরিবেশ যাতে তৈরী না হয়, সেই সাবধানতা তাকে নিতে হবে। নইলে তার ভোটে নিয়মিত দাঁড়ানোর কোনো মানে নেই। তার ভোটে দাঁড়ানো, সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে কাজ করার প্রতিশ্রুতি একটা ফাঁকা, অসার বুলি মাত্র। তুচ্ছ লোকদেখানো ব্যাপার। ভোটে নিয়মিত দাঁড়ালেও ভেতরে ভেতরে সে নৈরাজ্যবাদী।
১২২
তরুণী আই পি এস অফিসার রুপান দেওল বাজাজ। একটি পার্টিতে পঞ্জাবের সর্বোচ্চ পুলিশ অফিসার কে পি এস গিল তার নিতম্বে চাপড় মারেন। মহিলার শরীরে সেই মহিলার অনুমতি ব্যতীত স্পর্শ অনৈতিক। অবৈধ। সোজা কথায় বেআইনি। কে পি এস গিল এর এই অসঙ্গত কাজের প্রতিবাদ করেন অল্প বয়সিনী আই পি এস। খুব বড় পুলিশ অফিসার গিল। মহিলা সহকর্মীর পাছায় চড় মারার মতো নোংরা আচরণেরও উপযুক্ত শাস্তি হয় নি। কিন্তু হেরে যাবার মেয়ে নয় রূপান দেওল বাজাজ। বিষয়টি জানল অনেকে। আমিও। সাহস করে আমার একটি বইতে বিস্তৃত লিখলাম কাকে বলে এস এইচ ডবল্যু । সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট অ্যাট ওয়ার্ক প্লেস। পুলিশ সম্পর্কে লাঠিচার্জ নিয়ে অভিযোগ আজ নতুন নয়। বাম আমলে ভাষা নিয়ে আন্দোলনে বাসভাড়া বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রীদের উপর লাঠি চলতে দেখেছি। মানুষ বাঁচার লড়াই গড়লে, সেটা যাঁরা ক্ষমতায় আসীন, তাঁদের ছক অনুযায়ী না হলে, গোঁসা হবেই। বাম আমলে হত, এখন না হবার কারণ নেই। আগামীদিনেও হবে। রাষ্ট্রের একটা শ্রেণীচরিত্র থাকে। সেই শ্রেণীবিভক্ত সমাজ থাকবে, শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে পার্টিরাজ থাকবে আর পুলিশের হাতে লাঠি থাকবে না , এ একেবারে দিনে দুপুরে গাঁজায় দম না দিলে বলা যায় না। দুষ্টু লোকে বলে ক্যাডারের পিঠে লাঠি পড়লে সেই অনুপাতে পার্টির পলিটিক্যাল মাইলেজ বাড়ে। অবিশ্যি পুলিশের খারাপ কাজের প্রতিবাদ করতে হয়। নইলে লোকের কাছে মান বাঁচে না। তবে প্রমোদ দাশগুপ্ত একবার বলেছিলেন পুলিশের বন্দুকে কি কনডোম পরানো ছিল? মনের কথা বেশ চাঁছাছোলা ভাবে বলার শিক্ষা তাঁর ছিল।রাজার মতো রাজা ছিলেন তিনি। রাম রাজা হয়ে সীতাকে আগুনের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিলেন আর রাজা রাম মোহন মেয়েদের আগুনে পুড়িয়ে মারা থেকে বাঁচিয়ে ছিলেন। হিন্দু ধর্মের নিকৃষ্ট বিধান ছিল বাল্যবিবাহ কুলীনপ্রথা বহুবিবাহ আর সতীদাহ। বহু বিপদের ঝুঁকি নিয়েও বিবেকের আহ্বানে তিনি সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। সংখ্যাগুরু ব্রাহ্মণ সমাজ তাঁকে নানা ভাবে হেয় করতে চেয়েছিল। সবাইকে খুশি করে আর যাই হোক সমাজ বদলের লড়াই গড়ে তোলা যায় না।সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা উৎসাহিত করেছিল তাঁকে। ফ্রান্সে বিপ্লব তাঁকে খুশি করেছিল। আনন্দে মেতেছিলেন ফরাসী বিপ্লবের সাফল্যে। আমাদের বাংলায় তিনি উপহার দিলেন যুক্তির ভাষা আর ইহমুখী কার্যক্রম। বিতর্ক বাদ প্রতিবাদে গড়ে উঠলো জনমত। আমরা পেলাম ভাবতে পারা আর ভাবা প্র্যাকটিস করার অভ্যাস। তিনি রাজা রামমোহন রায়। আজ তাঁর জন্মদিন।আদরের বড়ো মেয়েকে নামী পরিবারে বিয়ে দিয়েছেন । পাত্রের বাবা বিখ্যাত কবি। ভাল পাত্র, তাই অনেকটাকা বরপণ দাবি করলো ওরা। পাত্রের বাবাকে মেয়ের বাবা বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন। কষ্ট সহ্য করেও বর পণের টাকা মেটালেন। একবার আদরিনী মেয়ে অসুস্থ শুনে বাপ দেখতে গেলেন মেয়েকে। জামাই সাহেবি পোশাকে বুট জুতো পায়ে শ্বশুরের সামনেই চুরুট ফুঁকতে থাকলো। মেয়ে বাবার সাথে কথা বলবে না বলে পিছন ফিরে শুল। মেয়ের নাম মাধুরীলতা। মেয়ের বাবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিহারীলাল চক্রবর্তীর ছেলে শরৎ এর সাথে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।ছোট মা মরা মেয়েটাকে দেখে শুনেই পাত্রস্থ করে ছিলেন তিনি। তার পর জামাইকে নিজের ছেলের সমান আদরে বিলেতে পাঠিয়ে ছিলেন কৃষি বিদ্যা নিয়ে হাল আমলের ধারণা নিতে। মেয়ে জামাইয়ের সম্পর্ক সুখের হয় নি। আদরের মেয়েটি মাঝে মধ্যেই বরের হাতে মার ধর পর্যন্ত খেত। মার খেয়ে হজম করত মেয়ে। বাবার কাছে অভিযোগ টুকুও করতে লজ্জাবোধ করত। মেয়ের ঘরের এই অশান্তি কষ্ট দিত বাপকে। মেয়েকে চিঠি লিখেছেন সে সব নিয়ে উদ্বিগ্ন পিতাটি। মেয়ের ঘরের নাতিটিকে বিদেশে পড়তে পাঠালেন মুদ্রণ বিদ্যা নিয়ে। সেখানে নাতির অকালমৃত্যু হল। ছোট ছেলেকে হারিয়েছেন অনেক আগে। আবার নতুন এই ধাক্কা। মেয়েকে অসুখী দাম্পত্যে জ্বলে পুড়ে খাক হতে দেখেও মনুষ্যত্বের প্রতি ভরসা হারান নি তিনি। সে মানুষটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মেয়ের নাম মীরা বা অতসী।
দুধ তুমি কার?প্রসন্ন গোয়ালিনীর , না কি বিড়ালের? কমলাকান্তের দপ্তর কি বলে?বঙ্কিম সশরীরে থাকলে কি জমাটি একটা লেখাই না উপহার দিতেন।গরু নিয়ে সারা দেশ রঙ্গে মেতেছে, আর নকল দুধ বাজারে হই হই করে বিকোচ্ছে ।মিনিমাম গভরন্যান্স কথাটা কে কে শুনেছি? হে বঙ্কিম, হে সম্রাট, একবার কমলাকান্ত সেজে এক দলা আফিম ঠুসে দুধ আর গরু নিয়ে একটা জম্পেশ লেখো মাইরি!ধর্ষণ জিনিসটা কেবল একটা যৌন সংযোগ নয়। কেবল একটা ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করা নয়। ওটা একটা মানুষের সম্ভ্রমবোধ, আত্মবিশ্বাস, শুভ বোধকে গুঁড়িয়ে দেবার যন্ত্র । ওটা ব্যক্তি মানুষের সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার মতো মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ। ধর্ষণকে রাষ্ট্র বিরোধী অপরাধ ঘোষণা করা হোক। যে ব্যক্তি সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করে তাকে রাষ্ট্র যেমন বিপজ্জনক হিসাবে গণ্য করে, ধর্ষণকারীকে তেমনি বিপজ্জনক হিসেবে ঘোষণা করা হোক। কেননা মেয়েদের সম্মানরক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।